জ্বলদর্চি

দেশান্তরী -৪ /হিল্লোল রায়

দেশান্তরী -৪
হিল্লোল রায় 

প্রথম আলোর চরণধ্বনি, রইলো হয়ে চোখের মণি

ট্রাফিক পুলিশ হাত ওঠাতেই রাস্তা পেরিয়ে চৌরঙ্গীর মোড়ে এসে দাঁড়ালাম! ট্রাফিক পোলের 'লাল' সংকেত তখন 'সবুজ'। ঘড়ির বড় কাঁটা সবে মাত্র ৯ এবং ১০ এর মধ্যস্থ জায়গায় তিনচতুর্থাংশে অবস্থান করছে আর ছোটকাঁটাটা বড়কাঁটার নীচে ভয়ে জড়সড় হয়ে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বুঝলাম আমাদের সময় সংক্ষিপ্ত কারণ মার্কিণ দূতাবাস সকাল ৮টা থেকে ১২টা এবং বেলা ২II. থেকে ৫টা পর্য্যন্ত খোলা থাকে। কাজেই বারোটার আগে গিয়েই আমাদের মার্কিণ দূতাবাসে পৌঁছোতে হবে। অফিস যাত্রীদের অফিস পৌঁছাবার চিন্তাকে কমিয়ে দিয়ে কলকাতা পরিবহণ সংস্থার একটা দোতলা বাস হাতছানি দিল আমাকে ও সঞ্চয় ঘোষকে। দোতলায় জানলার পাশে জায়গা পেলাম আমরা। ক্ষণিক গল্পের সু্যোগ পেয়ে সঞ্চয় ও আমি বেশ উৎসাহের গোড়ায় ইন্ধন জুগিয়ে নিলাম। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ডবল ডেকার ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে আমাদের গন্তব্যস্থল বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে ঘেঁষে শেক্সপীয়ার সরণীর মুখে নামিয়ে দিয়ে হুঁশ করে বেরিয়ে চলে গেল। আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে যখন মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছালাম তখন সকাল ১০টা বেজে ৩০ মিনিট।

কনস্যুলেট অফিসে ঢুকতেই চোখে পড়লো একটা স্ট্যান্ডের গায়ে লাগানো ছোট বোর্ডে লেখা রয়েছে “অনুগ্রহ করে রিসেপ্সানিষ্ট-এর সংগে দেখা করুন।” সাদা বোর্ডের ওপরে কালো হরফে এই অক্ষরগুলো সাজানো। রিসেপ্সানিষ্ট-এর নির্দেশসূচী দিয়ে (ওঁর পরিচয় জ্ঞ্যাপক কিছু না থাকায় নাম অনুল্লেখ রইল)” স্টুডেন্ট এ্যাডভাইসর মিস আয়ার এর ঘরে আমাদের পদার্পণ।

-গুড মর্ণিং, মিস আয়ার।

-গুড মর্নিং! প্লিজ বি সীটেড! হাউ মে আই হেল্প ইউ?

-উই আর কামিং ফ্রম এসপ্ল্যানেড। হেয়ার ইস মাই ফ্রেন্ড, মিঃ হিল্লোল রে। দিস ইয়ার হি হ্যাজ গ্র্যাজুয়েটেড ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং উইথ ফার্স্ট ক্লাস এ্যান্ড ইন্টেন্ডস টু গো টু স্টেটস ফর হায়ার স্ট্যাডিস। কুড ইউ হেল্প আস ইন দিস রিগার্ড? উই আর রেডি টু হেল্প। হ্যাভ ইউ এভার এ্যাপিয়ারড ইন TOEFL (Test of English as a Foreign Language) and GRE (Graduate Record Examinations) মিঃ রে?

-নো, নট ইয়েট।

-দেন ইউ টেক দিস এক্সাম ফ্রাস্ট। আফটার দ্যাট ইউ নিড টু ফিল আপ সেভারাল ফর্মস(অবটেনাবল অন পেমেন্ট অফ রুপিস টু)। অ্যান্ড মেনশন সেভারাল ইউনিভার্সিটি ইন স্টেটস। হোয়্যার ইওর রেজাল্টস অব TOEFL & GRE উড বি সেন্ট।

-ইজ দেয়ার নো আদার অল্টারনেটিভ, মিস আয়ার?

-নো, মিঃ রে।

-ইমিগ্রেশন?

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
-নো, ইট হ্যাজ বিন টোট্যালি স্টপড আফটার নাইন্টিন সিক্সটি নাইন।-হোয়েন ইট উড বি ওপেন্ড?-সিন্স এমপ্লয়মেণ্ট সিচ্যুয়েশন ইন স্টেটস। ইজ নট সো গুড নাউ, উই ডোন্ট নো হোয়েন ইমিগ্রেশান উড বি স্টার্টেড।

-ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ মিস আয়ার।

-ইউ আর ওয়েলকাম মিঃ রে!


কি ব্যথা পড়লো ঝরে, আজকে কেন এমন করে


উৎসাহব্যঞ্জক কাজে উদ্দীপনা জোগাবার ব্যাপারে সঞ্চয় ঘোষের জুড়ি নেই। এটা আমি বরাবরই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। আগেই বলেছি যে কোন কাজে অত্যুৎসাহটা আমার জন্মগত বদ অভ্যাস। এ জন্যে, তিরস্কার যেমন পেয়েছি, পুরস্কার ও যে পাই নি এমন নয়। তবে এই তিরস্কার -পুরস্কারের পাল্লা কোন দিকে ভারী সেটা মনে করতে পারছি না, অনেক শৈশবকালের বলে। সে প্রসংগ না হয় উহ্যই থাক। কনস্যুলেট অফিস থেকে আমি ও সঞ্চয় ঘোষ বেরুচ্ছি। দুজন এর মুখেই বিষাদের ছায়া। যেন আমরা পরাজিত রণক্লান্ত সৈনিক। আমেরিকা যাওয়ার উৎসাহ তখন মনের মধ্যে তূষের আগুনের মতই ধিকিধিকি জ্বলছে। দুজনেই দুজনের মুখের দিকে চেয়ে অন্তর্যামী মনের হদিশ করছি। কিন্তু সেটা আপাততঃ নিরর্থক মনে হচ্ছে।

আমেরিকা আসার ব্যাপারটা তখন কেমন যেন পানসে -ফ্যাকাশে লাগছে। মানসিক প্রস্তুতি, ১০এপ্রিল ১৯৭৪ এর নিদ্রাহীণ রাত, কখনও বা তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে আপন মনে ইংরাজী কথোপকথন এর মহড়া, ১১ই এপ্রিল ১৯৭৪ এর সকালে ঠাকুরের কাছে আমার আকুল প্রার্থনা কি একেবারেই বিফলে গেল? এই সব দুশ্চিন্তা তখন মাথায় ঘুরছে। বেলা বারোটা। আর্গোসি থেকে আসবার সময়কার প্রাতঃকালীন ফলাহার তখন পাকস্থলীকে খালি করে হিমোগ্লোবিন তৈরীর কাজে ব্যস্ত। দুজনে হাঁটছি, কথা বলছি, পথ চলছি মুখ বুঁজে। আবার বাসে চেপে এসপ্ল্যানেড ফিরে ঢুকলাম সঞ্চয় ঘোষের অফিস চেম্বারে বেলা ১২-৪৫ নাগাদ।

আমার উৎসাহদাতাদের মধ্যে একজন হল সঞ্চয় ঘোষ, অন্য জনের নাম আপাততঃ উহ্য থাক। কারণ এই দুজন উৎসাহদাতার মধ্যে তর-তম র ব্যাপার থাকায় অপর নামটা মনোজগতে খোদাই করা আছে-সেটা তেমনই থাক। “ডোণ্ট লুজ হার্ট, হিরে; (আমার ইংরাজী নামের সংক্ষিপ্তকরণ Hillol(হি) Ray (রে)। "লাক মাস্ট ফেভার ইউ, এ্যাজ ইন এভরি কেস ইউ হ্যাভ সীন।” সঞ্চয়ের এই কথাগুলো বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির মতোই ঘা দিচ্ছে। মানুষের শরীরে চামড়ার নীচে মাংসের স্তর অতিক্রম করে যে হাড়গুলো হৃদয়দেশকে আলিঙ্গন করে রেখেছে তারমধ্যে যে বস্তুটার ক্রিয়া বন্ধ হলে বিশালকায় বপু ও নিঃশেষে কাবু হয়ে পড়ে, যে বস্তুটার ক্ষণে ক্ষণে লাল-নীল রং ধারণ করে সমস্ত শরীরটাকে জিইয়ে রাখার দায়িত্ব সহাস্যে জন্মগ্রহণের পর থেকেই নিয়েছে-তার অবস্থা বিশেষ করে আমার ক্ষেত্রে এখন বেশীমাত্রায় ধুকতে শুরু করেছে। ভাবছি “আমার সকল আশা চূর্ণ হল ধরার আসন তলে।”

মনের জোর কিছুটা থিতিয়ে গিয়েছে। সমস্ত জিনিষ বিস্বাদ মনে হচ্ছে। সঞ্চয়ের সংগে কথা বলতেও ভাল লাগছিল না। ওর টেবিলের ফাইলগুলো নাড়াচাড়া করে মনটাকে বিক্ষিপ্ত করবার বৃথা চেষ্টায় ব্যাপৃ্ত হলাম। এরপর বিষাদাচ্ছন্ন মনে ১২-৪৫ থেকে ১৫-৪৫ অর্থাৎ তিন ঘন্টার একটানা গল্পে ছেদ ঘটিয়ে একা একাই বেরিয়ে পড়লাম সঞ্চয়ের অফিস থেকে। চলে আসবার আগে নতুন করে ওর উৎসাহ অভ্যর্থনাকে সংগী করে নিতে ভুললাম না একটুও। স্থিরলক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রতিজ্ঞায় আমি চিরকালই অটল, অকুতোভয়। কারণ ছোটবেলায় গল্পচ্ছলে বলা আমার মায়ের একটা কথা চিরকাল আমার মনে থাকবে। এমনকি কথাটা উপদেশবাসী হিসাবে গ্রহণ করে আমার হৃদয়দেশে তাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছি। বাণীটা কবিতাকারে শোনা (সম্ভবতঃ কোনো কবির লেখা)- “জানি বিপদ আছে, জানি আঘাত আছে। তাই জেনে তো বক্ষে পরাণ নাচে।” এই কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করবার জন্য বিপদসংকুল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছি, ছিনিয়ে নিয়েছি বিজয়ীর বরমাল্য।

ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments