জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ- ২৬ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ

পর্ব – ২৬

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

সাতের দশকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে দেখতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার অগ্নিবর্ষী আহ্বান বাংলা কবিতাকে দিয়েছিল অন্য এক মাত্রা।এই উত্তাল সময়ের আবর্তে আলোড়িত হয়েছিল মানুষের চিন্তা চেতনা।তৈরি হয়েছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ স্বরপ্রক্ষেপণের নতুন এক আত্মভাষা।বাংলা কবিতায় কবি শ্যামলকান্তি দাশের আবির্ভাব এরকম এক প্রেক্ষিতের মধ্য দিয়ে। যেকোন শিল্পীর অন্বেষণ সময়কে ছুঁয়ে গণ আন্দোলনের ইতিহাসকে ছুঁয়ে নিজস্ব মাতৃভূমির অন্বেষণ।কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতায় বিপ্লব ও বারুদের গন্ধ সেভাবে উপস্থিত না থাকলেও তিনিই একমাত্র কবি যাঁর কবিতায় প্রকৃত অর্থে গ্রাম দিয়ে শহরকে ফিরে ফেলার কাজ সার্বিকভাবে সফল হয়েছে।গ্রামীণ শালুক পদ্মের  অমলতাকে নাগরিক কোলাহলের মধ্যে  তিনি অম্লান আলোয় বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন।‘ ব্যাঁকা, কুজো থ্যাবড়া বাটির মতো’ অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামজীবনকে  করে তুলেছেন বসন্তকুমারী।‘ তারায় তারায় গাছপাথর’ আঁকতে আঁকতে কবিতায় ভরে দিয়েছেন নতুন এক জাগরণচিহ্ন।দূরাভিসারী কল্পনার আবেশে  আবিষ্ট নয় তাঁর কবিজন্ম, মৃত্তিকাসংলগ্ন মৃদু সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়া এবং ছোটখাটো অনাবিল সৌন্দর্য দিয়ে সাজানো তাঁর কবিতার বাসভূমি। যেখানে তিনি দেখেন-  মাটির ভিতরেও অদ্ভুত একটা কান্না আছে,/সারাদিন গুমরে গুমরে ওঠে।/সেই কান্না তুলে এনে একদিন/ঘরে, রামায়ণ মহাভারতের পাশে সাজিয়ে রাখি।

এই কান্নাকেই শ্যামলকান্তি সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর কবিতায়। সাজিয়ে রেখেছেন কি? না কি এই কান্না জড়িয়ে গেছে তাঁর কবিতার সাথে? কৃষি এবং নদীমাতৃক গ্রামবাংলার সংগ্রামী জীবন, মাটির ধুলোর মাঝে সেই জীবনের চালচিত্র শ্যামলকান্তির ঐন্দ্রজালিক বিচ্ছুরণে এক মায়াবী পৃথিবী হয়ে উঠেছে। আবার কখনও কখনও গ্রাম ও দারিদ্র একাকার হয়ে গেছে। ‘ভাত’ শব্দটি তাঁর কবিতায় বিভিন্ন রূপে ও রেখায় ফুটে উঠেছে। 



জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
 আজ আমাদের ভাত হবে না,

ভাত নেই-

চালে বিজিবিজ করছে পোকা।

মা দেশে-বিদেশে উনুন খুঁজতে গেছে,

উনুনে কত আগুন, কত সাদাকালো ভাত,

আমরা প্রাণভরে খাব। ( ভাত)

ভাতের গরম ভাপে টসটস করে ওঠে

কাঙালের জিভ।

 ৩
সাজিয়ে দিয়েছি নরম গলা ভাত,

ভাতের মণ্ড ( মা তুমি খাও)

শ্যামলকান্তির কবিতার কারুকৃতি জুড়ে ঘরবাড়ি গড়ে উঠে শব্দ আর অনুভবের এক মায়াবী স্থাপত্যে।একটার পর একটা লাইন পেরিয়ে আমরা কবির বাড়ির দিকে যাই।যেখানে ছায়া ছায়া ধানখেত,‘নবীন ধানের গান’‘মেঘে জলে কত কী ফোয়ারা’।স্বপ্নচোর নিশি পাওয়া ভূতের মতন দাঁড়িয়ে থাকে সন্ধ্যার নদীকূলে।এসব শব্দহীন অথচ নন্দিত ধ্বনি প্রতিধ্বনির ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমরা দেখি জাগতিক এবং স্যুররিয়াল দৃশ্যের শর্তময় ওঠানামা এবং এই দৃশ্যের নিয়তির ভেতর আমরা দেখতে পাই বাড়ি, যেখানে

‘ বাবাও আমার মতো চুপচাপ, আমিও বাবার মতো স্থির।

 দুজনেই ভদ্রলোক, কমবেশি ঢ্যাঙা ও বাঁটুল।

বাবা ও আমার কোনও পাখা নেই, পাখসাট নেই।

অপূর্ব শরৎকাল, গ্রামের নিকষ পথে দুজনেরই সাইকেল

বহুদূর যায়।‘(দুজনেই রবিবাবু, দুজনেই অতুলপ্রসাদ)

সাইকেলের শব্দ শুনতে পাই আমরা।কিছুটা প্রত্যক্ষ,কিছুটা অপ্রত্যক্ষ এই চলচল।যাদের অনুশীলন আছে শব্দের ভেতর যারা ভাসিয়ে দিতে পারেন নিজস্ব চোখ,তাঁরা তাঁদের মানসপথে দেখতে পাবেন অক্ষরের  ভেতর দিয়ে স্পষ্ট  আদল তৈরি হয় এই চলাচলের। কেউ কেউ সেই দৃশ্য দেখতে পান অনায়াসেই।এই যেমন এখন ভেসে উঠছে

একটা ভাঙা নড়বড়ে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছি।

নীচে জল যাচ্ছে।কানা দামোদর যাচ্ছে।কালের ধ্বনি যাচ্ছে।

আকাশে একটু একটু কালো রঙের চাঁদনি ফুটছে,

আর সেই কখন থেকে নিম গাছের হাওয়া দিচ্ছে। ফুরফুর! ফুরফুর!

কেউ কবিতার মতো বলছে  হাওয়া স্পর্শ করো! ( রথের চাকা)

এই হাওয়া স্পর্শ করার ক্ষমতা যাদের আছে তারাই পৌঁছে যেতে পারেন সেই বাড়ির কাছে। দিগন্তের ওপারে সেই বাড়িটি কেমন।এই পৃথিবীর আলো হাওয়ায় কেমন লাগে সেই বাড়ির বস্তুরহস্য।শব্দের ওঠানামায় তার অফুরাণ স্বাদ লেগে থাকে আমাদের অনুভবে।আমরা দেখি  কাকচঞ্চু পুষ্করিণীর গাঁ ছুঁয়ে  গাছের বেড়ে ওঠা, তার ডালে অপর্যাপ্ত পাখির সমাবেশ।আমরা সম্মোহনের ভেতর দিয়ে এই কবিতার কাছে আসি। কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা এরকমই স্বতঃস্ফূর্ত কারুকাজে  গ্রাম এবং শহরের মাঝখান দিয়ে এক সৃষ্টিছাড়া রাস্তা বানিয়ে নেয়।তাঁর কবিতায় প্রতীকের সম্পন্ন ব্যবহার আমাদের বোধ এবং পাঠভিজ্ঞতাকে তুমুল উদ্দীপিত করে।   

তুমি তো জানো যে পল্লিগ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে

এক শহরতলিতে আমার বসবাস।

আমি আর সেখান ছেড়ে কোথাও যাব না।

সেখানে আমি ভিজে মাটিতে গাছ পুঁতেছি।

ডালে পাতায় লাগিয়েছি অপর্যাপ্ত পাখি।

আমার মনের গহনে যে কাকচঞ্চু পুষ্করিণী, সেখানে রাজহাঁসের ডিম

সাদাশুভ্রতায় জল ঝরিয়ে দেয়।( দিগন্তের ওপারে)

শ্যামলদার মুখে বারবার শুনেছি যে কবিতা এবং আজও তাঁর যে কবিতা প্রথমেই পড়ি তা হল – ইচ্ছাপত্র। মৃদু অথচ মর্মভেদী সে কবিতা আমাদের চেতনায় রেখে যায় চিরকালীন লিপির স্বাক্ষর।

"টাকা মাটি। মাটি টাকা।অঢেল অজস্র টাকা।কাকে দেব এখনও ভাবিনি

অপূর্ব কাঁঠালবনে কাকচক্ষু সরোবর ।প্রাণাধিক ছেলেমেয়ে পাবে।

সোনা ফলাবার জন্য দু’কাঠা পতিত জমি প্রিয়তমা তোমাকে দিলাম।

তুমি ক্ষুদ্র পিপীলিকা।চিরজীবিতেষু।সংসারের নাট্যরস চেটেপুটে খাবে।(ইচ্ছাপত্র)

 কিছু কিছু কবিতা থাকে যা পুরানো হয় না। ক্ষয়ে যায় না।বরং প্রতিবার উচ্চারণে কাচা কাপড়ের মতো ঝলমল করে ওঠে। প্রথমবার যখন শুনি তখন মনে হয়েছিল কত সহজভাবে জীবনের সরল সত্য ধরা আছে এই কবিতায়। জীবনের রহস্যময় সত্যকে নিরাভরণ শব্দমালায় কীভাবে তুলে আনতে হয় তিনি জানেন।মাটির ভেতর থেকে যেভাবে বেরিয়ে আসে উদ্ভিদ সেভাবেই শব্দের বুদ্বুদ তার ভাবনার ভেতর এসে যায় স্বতস্ফুর্ত ভাবে। খুঁড়তে হয় না। ছিঁড়ে নিতে হয় না।
চার লাইনের এই কবিতা। অথচ কী গভীর ও নিপুণ দক্ষতায় উঠে এসেছে একজন সৃজনশিল্পীর জীবনের যাবতীয় বৈভব। কবিতার চিন্তাবীজ প্রাত্যহিক উপলব্ধি থেকে উৎসারিত।চারটি লাইন যেন চতুর্দিক থেকে একজন শিল্পীর  জীবনের সামগ্রিকতাকে কেন্দ্রীভূত করেছে এক অমোঘ সত্যের কাছে।কবিতাটি উঠে আসছে মাটি থেকে “টাকা মাটি মাটি টাকা”উচ্চারণের ভেতর দিয়ে, উঠে আসছে সাধনার সৃজনভূমি থেকে। আবার কবিতাটির উপসংহার  মাটির ভেতরেই ব্যপ্ত করে দিচ্ছে তার সম্পন্নতা।পিঁপড়েরা রস চেটেপুটে ফিরে আসছে মহাকালের গর্তে।

মানুষের দায় কোথায়?পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সে সঞ্চিত করে যায় তার সম্পদ। শ্রম দিয়ে, মেহনত দিয়ে, মেধা দিয়ে বাণিজ্যিক কৌশল দিয়ে।কখনও কখনও সে প্রতারণা ছলনা এবং অবৈধ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও হস্তগত করে অর্থ।এই সংগৃহীত রাশিই তুলে দেয় তার উত্তর প্রজন্মের কাছে।স্থাবর বা অস্থাবর এই সম্পদ ‘অপূর্ব কাঁঠালবনে কাকচক্ষু সরবোর” দিয়ে পিপাসা মেটাতে চায় আগামীর।এও তার  অর্জন। এই অর্জনটুকু বংশ পরম্পরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। প্রিয়তমা নারীকে দিয়ে যেতে চায় সুবর্ণ মৃত্তিকার অধিকার।দিয়ে যেতে চায় শস্যশ্যামল এক পৃথিবী। বস্তুবিশ্বের জন্য যা অপরিহার্য।

একজন কবি যে শব্দপৃথিবী নির্মান করেন কাকে  তিনি এই বিশ্বের অধিকার? একজন সুরশিল্পী  ক্রমাগত নিজেকে নিংড়ে নিংড়ে  যে নির্যাস উৎপাদন করেন যা প্রাণদায়ী অমৃত।কাকে দেবেন তিনি এই অমৃতলোকের অনুসন্ধান?এই সম্পদ লিখে দেওয়া যায় না। আত্মিক উপলব্ধির  মর্মে তাকে ধারণ করতে হয়। 

হৃদয়কে হৃদয় দিয়ে স্পর্শ  করতে হয়। চৈতন্যের দরজা খুলে কবিকে আত্মস্থ করেন পাঠক।সুরের সমুদ্র ছুঁয়ে যায় শ্রোতাকে।‘ যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে না মানো মণি”তারই অংশভাগ দাবি করেন পাঠক। দাবি নয় এ তার অর্জন ।শিল্পের এই রসটুকুই তার কাছে পার্থিব সম্পদের অধিক।

‘যে ছিল চাঁদের মতো চাঁদ তাকে অক্ষত রাখে নি’ আমাদের কবিজন্ম নিজেকে বিদীর্ণ করে জ্যোৎস্না প্লাবিত করার আয়োজন।হর্ষ আর বিষাদের যুগলবন্দী।উপেক্ষা অবহেলা আর অনাদরের মাঝেও চিরহরিৎ এক অপেক্ষা। তারই জন্য শিল্পের সুষমা ছড়িয়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন রক্তাক্ত করেছেন যে শিল্পী প্রতিদিন।সেই রক্তক্ষরণের  বিন্দু বিন্দু শব্দ, সুর আর চিত্রলিপিই তাঁর শিল্পের  অভিজ্ঞান। সমস্ত যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে একজন শিল্পীর নতুন দিকনির্ণয়ের  জীবন সন্ধিৎসা।আত্মক্ষয়ের দ্বিধাদীর্ণ মানসিকতার অভ্যন্তরে তিনি নিরন্তর  আবিস্কার করেন চেতনার আলোকময় উচ্চারণ।‘ সাদা পাতায় রক্ত ঢালতে আর আমার ভালো লাগে না” স্বগতোক্তির মতো শ্যামলকান্তি বলেছিলেন একসময়।কিন্তু তিনি পালন করেন নি এই বার্তাকে। ক্রমাগত নিজেকে পুড়িয়ে অগ্নিশুদ্ধ করেছেন,  রক্তাক্ত করেছেন।একজন সত্যিকারের পাঠক সেই ক্ষতচিহ্ন  দেখতে পান।দেখতে পান স্রোত এবং প্রতিস্রোতের বিভঙ্গে আলোড়িত অভিঘাত।যা চূর্ণ করেদেয়, বিচূর্ণ করে দেয়, ভেঙে তছনছ করে দেয়।আবার নতুন করে গড়ে  তোলে সৃষ্টির অন্তর্বস্তু। রহস্যের এই ধূসর জগত থেকে বিচ্ছুরিত  আলোর মতো নেমে আসে  শাব্দিক নির্মাণ।‘ মুর্খের মতো সাপ ও জ্যোৎস্নার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে অক্ষরের মাণিক্য’।কবি কোন হিসেবের ধার ধারেন না। লাভক্ষতির জটিল অঙ্ক তাঁর অনায়ত্ত। তাই সাপ আর জ্যোৎস্নার কোন বিভেদসীমা তিনি মানতে পারেন না।  তিনি এও জানেন না  কেউ একদিন স্পর্শ করবে তার সৃষ্টি । কিন্তু আমরা জানি একজন প্রকৃত কবিকে অনুভব করার জন্য তার শিল্পসম্পদকে পরিপূর্ণ করে তোলার বৌদ্ধিক পাঠক যুগে যুগেই আসবে।এরা চিরজীবিতেষু।পিঁপড়ের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীকে এক বৃহত্তর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন কবি শ্যামলকান্তি দাশ-‘ পিঁপড়ের মৃত্যু নেই

পিঁপড়ের আরেক নাম অবিনাশ’ এই জন্যই যেকোন শিল্পরস পেয়ে যায় অমৃতের স্বাদ।  ( ক্রমশ)

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর মূল‍্যায়ন, চলতে থাকুক।

    ReplyDelete