জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প – চিলি (দক্ষিণ আমেরিকা)মেঘ বালিকার বর /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূর দেশের লোকগল্প – চিলি (দক্ষিণ আমেরিকা)
মেঘ বালিকার বর

চিন্ময় দাশ

পেরু—দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশ। ভারি আশ্চর্য সিড়িঙ্গে গড়ন দেশটার। উত্তর দক্ষিণে লম্বা। একেবারে বুড়ো মানুষের হাতে ধরা একটা লাঠির মতন।
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ছড়িয়ে আছে সে দেশের পশ্চিম দিক জুড়ে। বিস্তির্ণ বালুকাবেলা। ঠিক মনে হয়, যেন সমুদ্রবেলায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে দেশটা। 
সান্তিয়াগো হোল চিলির রাজধানি শহর। মানচিত্রে তাকালেই দেখা যায়, সেটা গড়ে উঠেছে দেশের একেবারে মাঝামাঝি জায়গায়। তার উত্তরে যতখানি এলাকা, ততখানিই দক্ষিণেও। বলতে গেলে, শরীরের ঠিক নাভি এলাকা। বা বলতে পারো, শরীরের যে এলাকায় লাঠিটাকে ধরে রাখে বুড়ো মানুষের হাত। 
সেই সান্তিয়াগো থেকেই শুরু হয়েছে বন আর পাহাড়। একেবারে দক্ষিণের সীমানা পর্যন্ত। কত হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সেসব পাহাড়। নামটুকু পর্যন্ত না-জানা কত মহীরুহ। ঘণ সবুজের পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্দূরের গায়ে গা লাগিয়ে। 
তবে, সান্তিয়াগো শহরটা সমুদ্র থেকে অনেকখানিই ভেতরে। সেখান থেকে পশ্চিম মুখ বরাবর মাইল কয়েক দূরে সান আন্তনিও। সমুদ্র সেখানে কাছেই। চারদিকে পাহাড়। পাহাড় আর বন। বন আর নদী-নালা।
হু-হু করে বাতাস বয় সারা দিন। বাতাস বয়ে যায় সারা রাত। বাতাস বয়, আর মেঘ ভেসে যায়। পেঁজা তুলোর মতন হাল্কা মেঘ। ডানা নেই তাদের। বাতাসই তাদের ডানা। সেই ডানায় ভর করে, তারা ভেসে যায়, ভেসেই যায় মেঘের দল। 
আর যখন বাতাস নেই, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মেঘের দল। কখনো তারা থাকে উপরে, মাঝ আকাশে। কখনো বা পাহাড়ের মাথায় মেঘ। গাছেদের মাথায় মেঘ। নদী-ঝোরাতেও নেমে এসেছে মেঘের দল। সে ভারি সুন্দর ছবি। 



 
একবার এক কাণ্ড! অনেকক্ষণ বাতাস নাই। স্থির ভেসে আছে মেঘের দল। দেখতে দেখতে একটা মেঘকে ভারি পছন্দ হয়ে একটা পাহাড়ের। আহা, কী সুন্দর দেখতে মেঘখানা! পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা বরফের মত, ধবধবে সাদা। সদ্য দোয়া দুধের ফেনার মত হালকা। মাখনের মত তুলতুলে নরম। মেঘটাকে ভালো লেগে গেল পাহাড়ের। 
হোল কী, পাহাড়টাকে ভালো লেগে গেল মেঘেরও। আহা, কী ঋজু চেহারা। মাথা ছাড়িয়ে গিয়েছে আরও কতো কতো সব পাহাড়কে। ঘণ গাছপালায় ঢাকা। 
দুজনেরই দুজনকে ভালো লাগলে যা হয়! ভারি আনন্দের ঘটনা। বিয়েই হয়ে গেল দুজনের। 
ক’দিন না যেতে, মনে ভারি ভয় হোল পাহাড়ের। যেমন তেমন ভয় নয়। একেবারে বউ হারানোর ভয়। পাহাড়ের মনে হোল, উড়ে বেড়ানোই তো মেঘেদের স্বভাব।  তার মেঘ-বউ যদি উড়ে চলে যায় কোনদিন! 
ভাবনা থেকে ভয়। আর, ভয় বলে ভয়! পাহাড়ের দিন কাটে না। রাত কাটে না। মনে একটাই চিন্তা, যদি বউ চলে যায়। চিন্তা করতে করতে, একটা ফন্দি এসে গেল পাহাড়ের মাথায়। করল কী, বড়সড় একটা গুহা দেখে, বউকে তার ভিতর ঢুকিয়ে রেখে দিল। 
এভাবে দিন যায়। দিন গেলে, মাস যায়। মাস গেলে, বছরও যায়। এদিকে একটি মেয়েও হয়েছে মেঘ-পাহাড়ের। তাতে ভারি আনন্দ পাহাড়ের মনে। ভরা সংসার এখন তার।
কিন্তু মন ভালো নাই মেঘের। বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে বেড়াবার জীবন ছিল তার। বাতাসে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে কতো দূর দূর দেশে বেড়িয়ে বেড়াত সে। আর, এখন? বছর ঘুরে গেল, সে বন্দী হয়ে আটকে আছে। একটা অন্ধ কূপের মত এই গূহা। এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। দম আটকে আসছে মেঘের। 
কিন্তু এভাবে তো চিরকাল আটকে থাকা যায় না। মনে মনে ফন্দী আঁটতে লাগল মেঘও। যে করেই হোক সরে পড়তে হবে এখান থেকে। 
তক্কে তক্কে ছিল। একদিন ফাঁক বুঝে, মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো গুহা থেকে। আহা, কতো আলো। কতো বাতাস বাইরে। সোনা রোদে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। বুক ভরে দম নিল মেঘ। 


এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে, বাতাসে গা ভাসিয়ে দিল মেঘ। নিজে চলেছে সামনে। পিছনে মেয়েটি। 
কিন্তু পাহাড়ের খপ্পর থেকে সরে পড়া কি আর সোজা কথা? পাহাড় ঠিক টের পেয়ে গেছে। 
ভয়াণক রাগ হয়ে গেল পাহাড়ের। চিৎকার করে উঠল—আরে হতভাগী, পালাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়া বলছি। 
কানে গিয়েছে ধমকটা। কিন্তু তাতে মেঘ কি আর দাঁড়ায়? উলটে গতি বাড়িয়ে দিল মেঘ। বাবার গলা শুনে, তার মেয়েটি একটু থমকে গিয়েছিল। আর যায় কোথায়? খপ করে মেয়েটাইকে ধরে ফেলেছে পাহাড়। 
পালাতে পালাতে মেঘ দেখল, তার বাচ্চাটাকে পাহাড় ধরে ফেলেছে। কী আর করা যাবে? না থেমে, আরও দূরে সরে পড়তে লাগল সে। 
মেঘের চলে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখল পাহাড়। কিন্তু করবার আর কিছু রইল না তার। তার মেঘ-বউ হারিয়ে গেল চিরকালের জন্য। 
এবার আর কোন ভুল নয়। কোন আলগা ভাব নয়। একটুখানিও বিশ্বাস নয় আর। বাচ্চাটার জন্য পাহারার ব্যবস্থা করল পাহাড়। খুঁজে খুঁজে একটা ভোঁদড়কে জোগাড় করল পাহারাদার হিসাবে। 
বাচ্চাটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে, ভোঁদড়কে পাহারায় বসিয়ে দিল গুহার মুখে । ভোঁদড়ের বেতন? সে এক আজব কথা। পাহাড় ভোঁদড়কে বলল—আজ থেকে একটাই কাজ তোর। দিন রাত অষ্ট প্রহর বসে থাকবি দোরগোড়ায়। সব সময় চোখে চোখে রাখবি। মায়ের মতো পালিয়ে না যায় বদমায়েসি করে। 
তার পর বলল—আর শোন, খাবার দবারের ভাবনা নাই তোর। সে ভার আমার। পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবি শুধু। খাবার পেয়ে যাবি পেট ভরে। তা বলে ভাববি না। পেটভাতাতেই কাজ করতে হবে আমার। তোর একটা হিল্লেও করে দেব আমি। লক্ষ্য-নজর রাখ ঠিক মতো। মেয়ে বড়ো হলে, তোর সাথেই বিয়ে দেব মেয়েটার। কপাল খুলে যাবে তোর, বুঝলি? এই তো তোর চেহারা। অমন সুন্দরী বউ পেয়ে যাবি। 
বউ নিয়ে তেমন ভাবনা নাই ভোঁদড়ের। তার মনে পুলক অন্য কারণে। ছোট্ট পুঁচকে একটা জীব সে। সে কি না পাহাড়ের জামাই হয়ে যাবে? দেমাকে মাটিতে পা পড়বে না তখন তার। ভাবতেই পারছে না সে ব্যাপারটা? 
সব কথাই শুনছে মেঘবালিকা। তার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। একেবারে কবে কত দিনে সে বড় হবে। সেই তখন পর্যন্ত তাকে বন্দী হয়ে থাকতে হবে এই অন্ধকার গর্তটার ভিতর? আর তারপর কিনা বিয়ে করতে হবে এই রকম বিতিকিচ্ছিরি একটা জীবকে।
মা ছেড়ে চলে যাওয়াতে, মনে মনে ভারি রাগ হয়েছিল মেয়েটির। এখন বুঝতে পারল, ঠিক কাজই করেছে মা। পালিয়ে বেঁচেছে এখান থেকে। নইলে, মাকেও তো বন্দী হয়েই থাকতে হোত।
দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। বড়ও হতে থাকে মেয়েটি। ফন্দি এঁটে, ভোঁদড়ের সাথে ভাব করে নিয়েছে মেঘবালিকা। এটা ওটা নিয়ে গল্প করে তার সাথে। মনে যে পালাবার ছক, সেটা বুঝতেই দেয় না পুঁচকেটাকে। 
ভোঁদড় জানে, বড় হলে বিয়ে করবে এই মেয়েকে। মনে ভারি আহ্লাদ তার। খোলা মনে গল্পগুজব করে মেঘবালিকার সাথে। 
একদিন মেয়েটি বলল—এই অন্ধকার গুহায় দিন কাটাতে ভালো লাগে তোমার? 
--কী আর করা যাবে বলো। পাহাড়ের হুকুম তো মেনে চলতেই হবে।
--সে অবশ্য ঠিক কথা। মেয়েটি বলল—কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে, তখন আমাকে তো তোমার সাথেই থাকতে হবে। তোমার বাড়ি দেখাবে না আমাকে?
কথা শুনে, ভোঁদড় তো আহ্লাদে আটখানা। আমার বাড়ি দেখবে তুমি?
--দেখবো না? যেখানে থাকতে হবে, সেটা দেখতে কার না মন চায়, বলো? তা তোমার বাড়ি কোথায়?
--এই পাহাড়ের ঠিক নীচেই তো আমার বাড়ি। চলো, দেখে আসবে।
মেঘবালিকা তো এটাই চাইছিল। 
দুজনে গুহা থেকে বেরিয়ে, নীচে নেমে গেল। অন্ধকার গুহাটার ভিতরে জন্ম হয়েছে মেয়েটির। এখানে চারদিকেই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সে দেখেনি আগে। নাম না জানা কতো গাছপালা চার দিকে। সে দেখেনি আগে। গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি। সে শোনেনি কখনও আগে। 
ভারি ভালো লেগে গেল মেয়েটির। মনে ভাবল, এবার পালাই মায়ের মত। পুঁচকেটা আমাকে আটকাতেই পারবে না। উড়বে উড়বে করছে, হালকা একটা শোঁ-শোঁ আওয়াজ কানে এলো এবার। 
শুনল কান খাড়া করে। কিছু বুঝতে পারল না। বলল—কিসের আওয়াজ গো এটা? 
ভোঁদড় বলল—কীসের আবার? সমুদ্রের। এই খানিক দূরেই তো সমুদ্র। কত বিশাল। কূল নাই। কিনারা নাই। একূল ওকূল দেখা যায় না। শুধু জল আর জল। আমি তো মাঝেমাঝেই চলে যাই মাছের খোঁজে। 
--তুমি যাও সমুদ্রের কাছে? কী করে যাও তুমি? এই এত্তো বড় বড় সব পাহাড় পেরোও কী করে? 
-- পাহাড় ডিঙাতে যাবো কোন দুঃখে? পাহাড়গুলোর জোড়মুখ ধরে ধরেই রাস্তা আছে। সেই পথ ধরেই চলে যাই। সামান্যটুকু তো রাস্তা। 
আর যায় কোথায়? এক মূহুর্তও দেরি করল না মেয়েটি। ছিল মেঘ, এবার ঝরণা হয়ে গেল মেঘবালিকা। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল মাটিতে। পড়েই বইতে বইতে ছুটে চলল নীচের দিকে। 
পথ তো তেমন বেশি নয়। পাহাড়গুলোর এই বাঁক ওই বাঁক পেরিয়ে, খানিক বাদেই পৌঁছে গেল সমুদ্রের কাছে। তখন কী খুশি, কী খুশি? ঐ পুঁচকে ভোঁদড়টা কখনও মেঘবালিকার বর হতে পারে? তার চেয়ে কতো বড় এই সমুদ্র! সমুদ্রকেই পছন্দ হয়ে গেল মেঘবালিকার। ছিল বন্দিনী মেঘ। তা থেকে হোল ঝরণা। তারপর বয়ে এল তিরতিরে ছোট্ট একটা নদী হয়ে।
এখন সমুদ্রকে বর পেয়ে, মনে ভারি পুলক মেঘবালিকার। ঝুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরে।

পেজে লাইক দিন👇
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

1 Comments