জ্বলদর্চি

আবর্ত শেষ পর্যন্ত দিশা দেখায়/সৈয়দ কৃত্তিকা তাবাস্সুম

আবর্ত শেষ পর্যন্ত দিশা দেখায়
সৈয়দ কৃত্তিকা তাবাস্সুম

পুস্তক পর্যালোচনা

আবর্ত: রোশেনারা খান
"র" প্রকাশন
মূল্য ২৫০ টাকা।

সমকালীন বাঙালি সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিশ্লেষক হিসেবে রোশেনারা খান একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। তাঁর ৩৬টি প্রবন্ধের সাম্প্রতিকতম সংকলন, 'আবর্ত ', তাঁর গভীর জীবনবোধ এবং অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা ফসল। রোশেনারা খান শুধু বিশ্লেষকই নন, তিনি নারী এবং সমাজ সম্পর্কিত বহু সংস্কার আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মী । ফলে তত্ত্বকথার সঙ্গে,  তাঁর যে কোনো আলোচনার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া দুর্দান্ত সব উপলব্ধি ।
এই সংকলনের প্রবন্ধগুলি মূলত পাঁচটি বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা: নারী, মুসলমান সমাজ, গ্রামজীবন (অনেক প্রবন্ধই এই তিনটির মধ্যে একাধিক বিষয় ছুঁয়ে আছে), কোভিড লকডাউন এবং বিবিধ। বিষয় -অনুসারে বিন্যস্ত হলে সংকলনটি বিদ্যায়তনিক মানদণ্ডে অনেক  'গোছানো' হত ঠিকই; অন্যদিকে,  সমস্ত বিষয়গুলি মিলেমিশে থাকায় পাঠক অবশ্যই একটা অন্য ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন। রোশেনারা খানের জীবনে অগ্রগামিতার যে সহজাত অভিজ্ঞান আছে, সেই রকম তালেই এগিয়ে চলে তাঁর বই। পাঠককে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। বোঝা যায়, 'আবর্ত' লেখিকার পূর্বপ্রকাশিত ৩৬টি প্রবন্ধের সংকলন। অবশ্যই লেখাগুলির প্রকাশস্থান এবং রচনাকালের সূত্র পাওয়া গেলে ভালো হত; সেক্ষেত্রে সচেতন পাঠকের পক্ষে লেখাগুলির প্রাসঙ্গিকতা বোঝা সহজ হত। 
সবথেকে বেশি লেখা স্বভাবতই নারী বিষয়ক। নারী, গ্রামীণ নারী, মুসলমান নারী বিষয়ে লেখিকা অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন । তার  মধ্যে  নারী পাচার (১) থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন (৫), যৌন হেনস্থা, বৈবাহিক ধর্ষণ (১১), শাহিনবাগ ও  আন্তর্জাতিক নারী দিবস (২১), নারী স্বাধীনতা (২৭), নিম্নবর্গীয় নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রয়াস (৩,৩১), জাতীয় পরিসরে মুসলমান সমাজের তালাক প্রথা (৯,১০), এবং আন্তর্জাতিক মাত্রায় 'ফিমেল জেনাইটাল মিউটিলেশন' (১৩) - এর বিষয়গুলি উল্লেখযোগ্য।
লেখিকা কেবল সমস্যার স্বরূপ তুলে ধরেন নি; প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি একটা ইতিবাচক সমাধানের দিকনির্দেশ করেছেন ।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
দায়িত্বশীল সমাজ এবং রাষ্ট্রের কর্তব্য সম্পর্কেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন । এই সব সমস্যার উত্থাপন সত্ত্বেও তাঁর লেখার মধ্যে লেখিকার চরিত্রের 'পজিটিভ ভাইব'-টা প্রতিফলিত হয়, সঞ্চারিত হয় পাঠকের মধ্যেও। '' শৈশব থেকেই একটি মেয়েকে আত্মরক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে'', শুধু লেখিকার উক্তি নয়, পাঠকেরও প্রত্যয় হয়ে ওঠে।
তবে মহিলাদের হেনস্থার কারণ হিসেবে স্মার্টফোনকে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত কিনা (পৃ.২৫), তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তেমনই,  'নারী স্বাধীনতা' প্রবন্ধে এক শ্রেণীর মহিলার কাছে, "সাংসারিক জীবনকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে পার্টি, ক্লাব, শপিং ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকা, অর্ধ-উলঙ্গ পোশাক পরে বাইরে ঘোরা'', জাতীয় উক্তি এইরকম সংবেদনশীল একজন লেখিকার থেকে অভিপ্রেত ছিল না । একে নারীবাদীদের  স্বীকারোক্তি বলে দেগে দিয়ে ভবিষ্যতের সমাজকর্মীদের আক্রমণ করা সুবিধা হয়ে যায় ।
এই সংকলনে লকডাউন নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ আছে। লকডাউনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপর্যয় (৬), লকডাউন ও করোনা ভাইরাস  (২২), লকডাউনে রোজা (২৪), করোনা ভাইরাস বদলে দিল মানুষের জীবনযাত্রা  (২৫),  প্রবন্ধগুলি লেখিকার তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ এবং সমাজ বিশ্লেষণের পরিচয় বহন করে ।লকডাউন কিভাবে সমাজ ও অর্থনীতিকে ওলটপালট করে দিয়ে গেল, তারই এক রোজনামচা ফুটে ওঠে লেখাগুলিতে। মানুষের দুঃখদুর্দশা শুধু প্রত্যক্ষ করেন নি, মরমে অনুভব করেছেন লেখিকা। তার ফলেই তাঁর লেখায় আমরা এই প্রসঙ্গে জোরালো  'রাজনৈতিক বক্তব্য' পাই, ইংরাজিতে যাকে বলে, ' পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট '(পৃ ৮৫ দ্রষ্টব্য )।তবে তাঁর পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট গড়ে উঠেছে একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি থেকে; তা কখনোই কোনো 'রাজনৈতিক দল'-এর  চিন্তন দ্বারা প্রভাবিত নয়।
এই সংকলনের দুই মলাটের মধ্যে লেখিকা 'ঠাকুরবাড়ির পঞ্চনারী' (২৬)বিষয়ে লিখেছেন, আবার একেবারে সমকালীন 'পাঁচ (মুসলমান) কন্যার কাহিনি' (১৪)-ও আছে।
 যাঁরা মুসলমান সমাজ সম্পর্কে বিশেষ অবগত নন, কারবালার কাহিনি(৪), তালাক-এ- বিদ্দত (৯) প্রবন্ধগুলি তাঁদের আলোকিত করবে। বাংলার পিঠে, বা মেয়েদের হাতের কাজ, গ্রামীণ মেলার বিবরণ (যার অনেকটাই স্মৃতিচারণের আদলে লেখা) এই সংকলনের বিশেষ আকর্ষণ ।জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা 'নেসারন দাদির বড় পুজো'(২০) প্রবন্ধটি একটা যুগের গ্রাম সমাজের চিত্রকে তুলে ধরে। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে, এই সংকলন একটি  ঐতিহাসিক দলিল।
বেগম রোকেয়া (১২) থেকে জাহা হাদিদ(১৮)- ইতিহাসের রেখাপথে এ এক সুদীর্ঘ যাত্রা ।'পাবলিক মেমোরি' আসলেই ক্ষণস্থায়ী; লেখিকা আমাদের আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন ২০১৪ সালে অপহৃত আয়েশা র কথা (পৃ ১২), অমরনাথ যাত্রীদের প্রাণরক্ষাকারী কাশ্মীরি ড্রাইভার সেলিমের কথাও (পৃ ৩৬)। প্রসঙ্গক্রমে সামান্য উল্লেখ হলেও এই ডকুমেন্টেশন জরুরি ছিল।
 লেখিকার সমাজ পর্যবেক্ষণ অতি তীক্ষ্ম; দুই সম্প্রদায়ের চাপানউতোরের ফলে মহরম- রাম নবমী- বিশ্ব নবী দিবস ধর্মীয় -সামাজিক উৎসবের গণ্ডি ছাড়িয়ে কিভাবে সম্প্রদায় ভিত্তিক পরিচিতি প্রত্যয় (আইডেন্টিটি অ্যাসার্শন)-এর হাতিয়ার হয়ে উঠছে, তা তাঁর নজর এড়িয়ে যায় নি।
ঐতিহাসিক -প্রায় ঐতিহাসিক এবং সমকালীন এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি সুখপাঠ্য সংকলনের জন্য লেখিকাকে ধন্যবাদ ।
তবে প্রুফ সংশোধন বিষয়ে আর একটু মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল ।'দুর্দশাগ্রস্থ' (পৃ ২৮), 'পরিসেবা'(পৃ ৯৬)  চোখকে পীড়া দেয় ।একটি উচ্চমানের বাংলা বইয়ে আমরা 'জ্যোতিন্দ্রনাথ'(পৃ ১০৭), 'সিলাইদহ', 'বীরভুম' এবং 'সমীন্দ্রনাথ' (পৃ ১১৭)জাতীয় বানান আশা করি না। অনেক প্রবন্ধে সঙ্গের ছবিগুলো শুধু বিষয়কে পরিপুষ্ট করে না, সংকলনটিকে ও ঋদ্ধ করে। সেক্ষেত্রে ছবিগুলির তথ্যসূত্র থাকলে ভালো হত।
সব মিলিয়ে সমাজচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ খণ্ড নির্মাণের জন্য লেখিকাকে অকুণ্ঠ অভিনন্দন ।সবক'টি প্রবন্ধ পড়া হলে মনে হয়, সংকলনটি 'আবর্ত ' হিসেবে অবশ্যই সার্থকনামা; তবে সচেতন পাঠক একটা দিশাও নিশ্চয় পাবেন।


Post a Comment

0 Comments