জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৬১/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬১

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ

 শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ সম্পর্কে স্বামী চেতনানন্দজী তাঁর গ্রন্থ ‘GOD lived with them’-এ লিখছেন ---“This story begins with a loss of a gold watch. Sarada Prasanna, the son of a rich landlord, was admitted to the Metroplitan Institution in North Calcutta when he was in the seventh grade.
 For four years Sarada studied in that school, where M., the recorder of the gospel of Sri Ramakrishna, was headmaster. Sarada was a talented boy, and his teachers expected him to achieve a brilliant score in the Entrance examination and thereby obtain a scholarship; Sarada was also contemplating his bright future. But who can change Divine Providence? On the second day of the examination someone stole Sarada's gold watch while he was having refreshments. Sarada was extremely upset; he felt that because of his carelessness a highly vulnerable thing had been stolen. He could not concentrate on the remaining subjects of the test, and he failed to place in the first division.” যে সারদাপ্রসন্নের কথা লেখক এখানে বলেছেন তাঁর পুরো নাম সারদাপ্রসন্ন মিত্র, উত্তরকালে শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম অন্তরঙ্গ ত্যাগী পার্ষদ -- স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ।
 সোনার ঘড়ি হারানোয় বড় বেশি মুষড়ে পড়েছিল সারদাপ্রসন্ন। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন শ্রীম, তিনি খুব স্নেহ করতেন তাঁকে। ১৮৮৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর সারদাকে সঙ্গে নিয়ে যান দক্ষিণেশ্বরে। এটিই ছিল সারদার প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসা। ঠাকুর তাঁকে সেদিন ঠিক কী বলেছিলেন সেই বিষয়ক কোনও তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে কথামৃত অনুযায়ী মানব জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে সেদিন কথা বলেছিলেন। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ অনুসরণ করলে এই দিনটির এইরকম বর্ণনা পাওয়া যায় -- “আজ শনিবার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, ( ১৩ই পৌষ ) শুক্লা সপ্তমী তিথি। যীশুখ্রীষ্টের জন্ম উপলক্ষে ভক্তদের অবসর হইয়াছে। অনেকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিতে আসিয়াছেন। সকালেই অনেকে উপস্থিত হইয়াছেন। মাস্টার ও প্রসন্ন আসিয়া দেখিলেন ঠাকুর তাঁহার ঘরে দক্ষিণদিকের দালানে রহিয়াছেন। তাঁহারা আসিয়া তাঁহার চরণ বন্দনা করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে শ্রীযুক্ত সারদাপ্রসন্ন এই প্রথম দর্শন করেন।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
 ...কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর ভক্তসঙ্গে গিয়া বসিয়াছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে ঘেরিয়া রহিয়াছেন, কেহ বসিয়া -- কেহ দাঁড়াইয়া। ঠাকুর পঞ্চবটীমূলে ইষ্টকনির্মিত চাতালের উপর বসিয়া আছেন। দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে মুখ করিয়া বসিয়া আছেন। সহাস্যে মাস্টারকে বলিলেন, ‘বইখানা কি এনেছ?’
 মাস্টার -- আজ্ঞা, হাঁ
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- পড়ে আমায় একটু একটু শোনাও দেখি। ভক্তেরা আগ্রহের সহিত দেখিতেছেন কি পুস্তক। পুস্তকের নাম ‘দেবী চৌধুরানী’। ঠাকুর শুনিয়াছেন, দেবী চৌধুরানীতে নিষ্কাম কর্মের কথা আছে। লেখক শ্রীযুক্ত বঙ্কিমের সুখ্যাতিও শুনিয়াছিলেন। পুস্তকে তিনি কি লিখিয়াছেন, তাহা শুনিলে তাঁহার মনের অবস্থা বুঝিতে পারিবেন। 
 ...মাস্টার -- ভবানী ঠাকুর প্রফুল্লকে সাধন আরম্ভ করালেন ‘প্রথম বৎসর ভবানী ঠাকুর প্রফুল্লর বাড়িতে কোন পুরুষকে যাইতে দিতেন না বা তাহাকে বাড়ির বাহিরে কোন পুরুষের সঙ্গে আলাপ করিতে দিতেন না। দ্বিতীয় বৎসর আলাপ পক্ষে নিষেধ রহিত করিলেন। কিন্তু তাহার বাড়িতে কোন পুরুষকে যাইতে দিতেন না। পরে তৃতীয় বৎসরে যখন প্রফুল্ল মাথা মুড়াইল, তখন ভবানী ঠাকুর বাছা বাছা শিষ্য সঙ্গে লইয়া প্রফুল্লের নিকটে যাইতেন -- প্রফুল্ল নেড়া মাথায় অবনত মুখে তাহাদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় আলাপ করিত।
 ‘তারপর প্রফুল্লের বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ। ব্যাকরণ পড়া হল, রঘু, কুমার, নৈষধ, শকুন্তলা। একটু সাংখ্য, একটু বেদান্ত, একটু ন্যায়।’
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- এর মানে কি জানো? না পড়লে শুনলে জ্ঞান হয় না। যে লিখছে, এ-সব লোকের এই মত। এরা ভাবে, আগে লেখাপড়া, তারপর ঈশ্বর; ঈশ্বরকে জানতে হলে লেখাপড়া চাই। কিন্তু যদু মল্লিকের সঙ্গে যদি আলাপ করতে হয় তাহলে তার কখানা বাড়ি, কত টাকা, কত কোম্পানির কাগজ -- এসব আগে আমার অত খবরে কাজ কি? জো-সো করে -- স্তব করেই হোক, দ্বারবানদের ধাক্কা খেয়েই হোক; কোন মতে বাড়ির ভিতর ঢুকে যদু মল্লিকের সঙ্গে আলাপ করতে হয়। আর যদি টাকা-কড়ি ঐশ্বর্যের খবর জানতে ইচ্ছা হয়, তখন যদু মল্লিককে জিজ্ঞাসা কল্লেই হয়ে যাবে! খুব সহজে হয়ে যাবে। আগে রাম, তারপর রামের ঐশ্বর্য-জগৎ। তাই বাল্মীকি মরা মন্ত্র জপ করেছিলেন। ‘ম’ অর্থাৎ ঈশ্বর, তারপর ‘রা’ অর্থাৎ জগৎ -- তার ঐশ্বর্য! 
 ভক্তেরা অবাক হইয়া ঠাকুরের কথামৃত পান করিতেছেন।”
 শ্রীরামকৃষ্ণের কথা সারদাপ্রসন্নের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রথম দর্শনই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। 
 ১৮৬৫ সালের ৩০ জানুয়ারি ২৪ পরগণার নেওড়া ( পৈখাতি ) গ্রামে জন্ম সারদার। পিতামাতার বিশ্বাস দেবী দুর্গার কৃপাবলে তাঁদের এই সন্তান লাভ, সুতরাং তাঁরা পুত্রের নাম রাখলেন ‘সারদা’-- যা দেবী দুর্গার অপর নাম। জ্যোতিষীর গণনা অনুযায়ী অত্যন্ত শুভক্ষণে জন্ম সারদার, ভবিষ্যতে সারদা বড় যোগী পুরুষ হবে। সারদার মাতামহ নীলকমল সরকার পৈখাতি গ্রামের ক্ষমতাবান, ঐশ্বর্যসম্পন্ন জমিদার ছিলেন। পিতা শিবকৃষ্ণ মিত্রও ছিলেন ধনী জমিদার। সারদার যখন তিন বছর বয়স, সেই সময় কলকাতার নন্দনবাগানে সপরিবারে চলে আসেন।
 শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কয়েক মাস পরে, ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে সারদা মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষে খুব ভালো নম্বর পান এবং মেধাবী ছাত্র হিসাবে কলেজে চিহ্নিত হয়ে যান। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে তাঁর যাওয়া আসা যত বাড়তে থাকল, প্রথাগত শিক্ষালাভের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকল ততই। কোনও কোনও দিন ক্লাসে যেতেন না, ঠাকুরের কাছে চলে যেতেন। এই আন্তরিক, সরল, সৎ, ঈশ্বরবিশ্বাসী যুবকটিকে অধ্যাত্ম পথের আলো দেখাতেন ঠাকুর। তাঁকে পরম স্নেহভরে খাওয়াতেন, শ্রীশ্রীমা'কে বলতেন সারদার গাড়ি ভাড়া দিয়ে দিতে। মা নহবতের সিঁড়িতে ভাড়ার পয়সা রেখে দিতেন, কেননা তিনি জানতেন বাড়ির লোকের অগোচরে, পিতার চোখ ফাঁকি দিয়ে সারদা দক্ষিণেশ্বরে আসে। শ্রীরামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিক উপদেশ গ্রহণের জন্য সারদাকে শ্রীশ্রীমা'র কাছে পাঠিয়ে দিতেন। শ্রীশ্রীমা অনন্ত শক্তিরূপিনী, সেই বিষয়ে অবহিত করতেন। বলতেন-- ‘অনন্ত মায়ার কথা কহনে না যায় / কোটি কৃষ্ণ কোটি রাম হয় যায় রয়।’ সারদা যদিও শ্রীরামকৃষ্ণের ত্যাগী শিষ্য ছিলেন, কিন্তু তাঁর আনুষ্ঠানিক মন্ত্রদীক্ষা হয় শ্রীশ্রীমা'র কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণের দুই ত্যাগী সন্তান সারদা ( স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ ) ও যোগীন ( স্বামী যোগানন্দ )-এর মন্ত্রদীক্ষা লাভ হয়েছিল মায়ের কাছে।

Post a Comment

0 Comments