জ্বলদর্চি

অজানা পথে ( চতুর্থ পর্ব )/ মিলি ঘোষ

অজানা পথে ( চতুর্থ পর্ব )
 মিলি ঘোষ
 
 "দিদি, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তো আপনি একদম একা হয়ে যাবেন।"
মনামী ভাত নামাচ্ছিল। রাহীর দিকে না তাকিয়েই বলল, "এসব কথা বিভিন্ন মানুষ, বিভিন্ন সময়ে আমাকে ভাবাতে চেয়েছে। আমি ভাবিনি। যখন যেমন পরিস্থিতি আসবে, তখন তেমন চলব।"
রাহী ঘাড় নেড়ে সমর্থন করে মনামীকে।
মনামী আবার বলল, "বেশি নেগেটিভ চিন্তা করলে, এগোনো মুশকিল।"

মনামীর এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। কয়েক মাস পরেই মধুরার বিয়ে।
প্রচুর কেনাকাটা চলছে। রাহী, ফিরেও দেখে না সে'সব। 
কিন্তু মনামী যখন বলে, "রাহী, এটা তুলে দাও। ওটা নামিয়ে দাও।"
রাহী উৎসাহ নিয়ে করে দেয়। 
যেদিন কাজ বেশি থাকে, রাহীর সময়ের কথা ভেবে মনামী সেদিন ওকে শুধু বাসন মাজিয়েই ছুটি দিতে চায়। 
বলে, "তোমার অনেক সময় নষ্ট হলো। আজ আর ঘর মুছতে হবে না।"
রাহী ঝাঁটা হাতে নিয়ে এসে বলে, "ঘরটা ঝাঁট দিয়ে দিই দিদি ?" 

সারাদিনে একটু বিশ্রাম নেই যার, সে এত উৎসাহ কোথা থেকে পায়। এতটুকু বিরক্তি নেই। 
সৃষ্টিকর্তা রাহীর শারীরিক ও মানসিক শক্তির লেভেল, হয়তো অন্যদের থেকে বেশ উঁচুতেই রেখেছেন। শারীরিক শক্তি বিদ্রোহ যে করেনা, তা নয়। তবে অবাক হতে হয়, ওর মানসিক শক্তি দেখে।
মনামী বলে রেখেছিল, "এখন যা যা বলব, একটু করে দিও। বিয়ের পরে আমি তোমাকে যা দেবার দেব।"
সে রাহী জানে, দিদি এমনি এমনি কিছু করিয়ে নেবে না। 
রাহীর নামে কার্ড দিয়ে মনামী বলেছিল, "সবাইকে  নিয়ে এসো।"
কার্ড পেয়ে যারপরনাই খুশি রাহী।
হাসতে হাসতে বলল, "আমাকে আবার কার্ড দিলেন কেন ? মুখে বলে দিলেই তো হতো।" 

মধুরার বিয়ে যত এগিয়ে আসতে লাগল, রাহীর ব্যস্ততা বেড়ে গেল। মনামীর সৌভাগ্য, ওই সময়টাতে পলির কোনও ফোন আসেনি। নাহলে, সব ফেলে রেখে রাহীকে ছুটতে হতো।
আসেনি যখন পলির ফোন, মনামীর হাতে হাতে সব করে যেতে রাহীর কোনও বাধাই থাকল না। মনামী যা বলছে তাই। যেন, এ রাহীরই বাড়ির কারোর বিয়ে। মনামী আর সকলের জন্য যে শাড়ি কিনেছে, রাহীকেও তাইই দিয়েছে। শাড়ি আর টাকা পেয়ে বিস্তর খুশি রাহী। 
রাহীর চেয়েও বেশি খুশি ওর মেয়ে। 
শাড়ি দেখেই বলল, "মা, তোমারই তো বাজার। কী ভালো শাড়ি পেয়েছ। আমি কিন্তু এটা সরস্বতী পুজোর দিন পরব।"

এদিকে মধুরা বলছে, "মা, যা একটা অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়েছ না তুমি। ফাটিয়ে কাজ করল।"
মনামীও বলল, "সত্যি, রাহী যা সার্ভিস দিল, ভাবা যায় না। টাকা দিলেই কি সবাই এভাবে করবে ?" 
মধুরার বিয়ের পরে মনামী, নিজের কাজে একটু বেশি মাত্রাতেই ডুবে গেছে।
রাহী জানে, মনামী টিভি সিরিয়াল দেখে না। তাই সেদিকে মারায় না রাহী। 
জিজ্ঞাসা করে, "কাল, 'সা-রে-গা-মা-পা' শুনেছেন দিদি ? ওই ছোটো চুলের মেয়েটা কী সুন্দর গাইল না ?"
বা, কোনওদিন হয়তো জানতে চাইল, "দিদি, কাল খেলা দেখেছেন ? আমার তো ভোরে উঠতে হয়, তাই রাত জাগতে পারি না। ওরা তিনজন দেখেছে রাত জেগে।"
এরকম টুকটাক গল্প চলতেই থাকে এবং যা বলে রাহী, সবটাই মনামীর টেস্ট বুঝে।

রাহী এতটাই বিশ্বাসী, ওর কাছে নিশ্চিন্তে ঘর ফেলে রেখে মনামী স্নান করতে যায়। 
কোনওদিন বলে যায়, "রাহী গ্যাস আসতে পারে। এখানে বই রেখে গেলাম। সই করে নিও।"
     "অনলাইন পে করা আছে, দিদি ?"
     "হ্যাঁ, পে করা আছে। শুধু ডেলিভারি ম্যানকে এই টাকাটা দিয়ে দিও।"
 এরকম আরো কত জিনিস, রাহী ওপর থেকে ব্যাগ ফেলে ফেলে তুলে নেয়। তবে যেগুলো সই করে নেয়, সেগুলোর ব্যপারে মনামীর একটু চিন্তা থাকে। সে ওই রাহীর হাতের লেখার জন্য। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
একদিন রাহী বলল, "দিদি, কাল কি স্কুল থেকে সোজা এসে কাজ করে যাব ? নাহলে অনেকটা দেরি হবে আসতে।"
     "কেন, কাল কোথায় যাবে ?"
     "ওই আমাদের ফ্ল্যাটটার ব্যপারে একজনের সঙ্গে কথা বলতে যাব। এই প্রোমোটার বোধহয় আর করতে পারবে না।"
     "একাই যাবে ? না, দাদাও থাকবে ?"
     "দাদাও থাকবে। আরো দু'একজন যাবে, যাদের থেকে টাকা নিয়েছে।"
     "না, না, তুমি এসব কাজ মিটিয়ে তারপর এসো। ওই কাজটা হওয়া জরুরী।"

বেলার দিকে এসে বলল রাহী, "কাল কথা বলেছি, জানেন তো দিদি।"
       "কার সঙ্গে কথা বললে তোমরা ?"
       ওই যে রোডের দিকে যেতে যে বাচ্চাদের স্কুলটা আছে না, ওখানে ওয়ার্ড অফিস থেকে দু'জন লোক বসেছে। অনেকেই যাচ্ছে, যার যার সমস্যা বলছে।"
       "তোমাদের কী বলল ?"
       "বলল, আমাদের প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলবে। নাম, ফোন নম্বর নিয়ে নিল।"
       "কথা আদৌ বলেছে কি না, জানবে কী করে ?"
       "সামনের শনিবার আবার যেতে বলেছে।"
       "দেখো, লেগে থেকে যদি কাজটা উদ্ধার হয়।"
       "কেউ তো গেল না। শুধু আমি আর দাদা গেলাম। কী লাইন পড়েছিল!" 

পরের শনিবারও রাহী গেল ফ্ল্যাটের বিষয়ে কথা বলতে।
আসার পরে মনামী জানতে চাইল, "কতদূর এগোল ?"
      "না, ও আর পারবে না। অন্য প্রোমোটারকে দেবে।"
      "তাই হোক। কাজটা হওয়া নিয়ে কথা।"
 এরপরেও রাহী শনিবার দেখে ওই স্কুলে কথা বলতে গেছে। কিন্তু মনামীর সঙ্গে এই নিয়ে আর কোনও কথা হয়নি। মনামী, নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সব সময় মনেও থাকে না।

মধুরার বিয়ের পরে মনামীর একা থাকাটা অভ্যেসে পরিণত হতে লাগল। জীবন মানুষকে বোধহয়, এভাবেই গড়ে তোলে। 
তবু অনেকেই মনামীকে বলেছে, "তুমি এভাবে একা থেকো না। রাহীকে বলো রাতে শুতে।"
রাহীকে যারা দেখেছে, সামান্য হলেও চিনেছে, তারা রাহীর নামটাই করবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাহীর জীবনযাত্রা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মনামী, রাহীকে এই প্রস্তাব দিতে দ্বিধাবোধ করেছে।
বাড়িতে তো সারাদিন থাকেই না রাহী। রাতটুকুও কেড়ে নেবে ? নাহ্, থাক।
মনামী বললই না রাহীকে। 
ভাবল, "একটা বছর তো কাটিয়ে দিলাম। বাকি জীবনটাও চলে যাবে।" 

এরপর একদিন, এমন একটা ঘটনা ঘটল, মনামীর রাতের ঘুম উড়ে গেল।
সেদিন রাত করে খেলা দেখে মনামীর শুতে শুতে প্রায় আড়াইটা। তারপরেও ঘুম ঠিক আসছিল না। জেগেই ছিল। হঠাৎ মনে হলো ছাদে যেন কার পায়ের আওয়াজ। খুব সাবধানী পা। মনামী সচেতন হলো। একটু পরে মনে হলো ছাদের দরজায় কারোর হাত পড়ছে। এবার মনামী উঠে বসল। অল্প সময় পরেই ছাদের দরজার তালা খোলার চেষ্টা এবং তা মোটামুটি জোরেই। মনামী গিয়ে সিঁড়ির লাইট জ্বালল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দ বন্ধ। 
মনামী একটু অপেক্ষা করল, যদি বিদায় নেয় তো ভালো। কিন্তু মনামীকে অবাক করে দিয়ে সিঁড়ির লাইট জ্বালা অবস্থায় আবারো তালা খোলার চেষ্টা।
এবার মনামী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে, ঘরে এসে ভালো করে দরজা দিয়ে এক তলার একটা ছেলেকে ফোন করল। যেই রিং হলো, শব্দ বন্ধ।
নিচের ছেলেরা দৌড়ে এসে ছাদে গিয়ে মোবাইলের টর্চ মেরে এদিক ওদিক অনেক দেখল। ততক্ষণে তো ছাদ খালি। 
এরপর আর ঘুম আসে ? মনামী, ঘরের সব দরজা জানলার ছিটকিনি ঠিকঠাক দেওয়া আছে কিনা দেখতে গিয়ে দেখে, বেড রুমের জানলার ছিটকিনি অল্প নামানো, মনামী ঠেলল, খুলে গেল।
ভয়ে গা হিম হয়ে এল মনামীর। 

(চলবে)

Post a Comment

0 Comments