জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র/নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র

ড.নির্মল বর্মন

"অগ্রণী" পত্রিকার সম্পাদক, স্নাতকোত্তরে স্তরে বিষ্ণু দে'র বন্ধু ও জাতীয় নেতা যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রে'র পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র'র জন্ম১৯১১। প্রখ্যাত গায়ক ও সাম্যবাদী কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র 'র 'বিয়োগান্ত'(১৯৩৫) নামক প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় পরিচয় পত্রিকায়। কেবলমাত্র কবি হিসেবে নয়, সুরকার সঙ্গীতজ্ঞ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফ্যাসি বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা তিনি ছিলেন। পূর্ব জার্মানি ,সোভিয়েত ইউনিয়নে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন ১৯৭৭ এ ২৫শেশে অক্টোবর হায়দ্রাবাদ থেকে কলকাতা ফেরার পথে ট্রেনের কামরায় ঘুমের ঘোরে জীবনাবসান ঘটে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের কবিতায় যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা নগর জীবনের অবক্ষয়িত নিঃসঙ্গতা ও হতাশা বোধ উঠে আসে। তার কাব্য সংকলন গুলি হল "মধুবংশীর গলি"(১৯৪৪),"রাজধানী ও মধুবংশীর গলি "(১৯৭১),"যে পথেই যাও"(১৯৭৩)।
"বিংশোত্তরী" ও" বহুব্রীহি" কবিতা দুটি বিষ্ণু দে, সমর সেন, জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথের ছায়া থাকলেও 'মধুবংশীর গলি' জনপ্রিয়তার স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দেন। 'স্বস্তিবাচন' কবিতায় শহর কেন্দ্রিক জীবন যাপনের অন্তঃসারশূন্যতাকে টি.এস. এলিয়ট সাহেবের মতো এভাবে তুলে ধরেছেন---
'হোটেলওয়ালারা সব পাজি।
দৈনিক দ্বাদশ মুদ্রা গুনে নেবে ঠিক,
তবু যদি শালাদের লোভ কিছু কমে,
বিয়ারেতে এক্সট্রা ফি নেবে এক টাকা'!
"মধুবংশীর গলি "প্রথম কবিতা সংকলনের যুথবদ্ধ সমালোচনা করে জনৈক সমালোচক বিমলচন্দ্র সিং লিখেছিলেন---
"বর্তমান সমাজসংকটের ছায়া তাঁর প্রত্যেক কবিতাতেই ।মন্বন্তর ও মহামারী ছায়াও পড়েছে।----- এই সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতা, তিক্ততা, হতাশা , আর সেই সঙ্গে বর্তমান ভন্ডামির প্রতি তীব্র ক্রোধ ও নতুন সমাজ গড়বার আগ্রহ ---এসব ক-টির সন্ধান মেলে 'মধুবংশীর গলি ' কবিতাটিতে"।
শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট সমালোচক বুদ্ধদেব বসু "মধুবংশীর গলি"সম্পর্কে জানিয়েছিলেন ---"এ -- বইয়ে লেখক চাতুর্যের পরিচয় যতটা দিয়েছেন, কবিত্বের পরিচয় ততটা দিতে পারেননি"। তবে তিনি কবির  গদ্যছন্দের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। তাই কবির ইতিবাচক স্পষ্ট উচ্চরণ--
"হে ধনিক, হে বণিক, আর্য, অনার্য
করো শিরোধার্য-----
বৃদ্ধ যুগের গলির শবের পাশে
প্রাণ কল্লোলে ঐ নবযুগ আসে"!

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
মধুবংশীর গলি', 'নগর সংকীর্তন', 'আর কেন', 'একটি প্রেমের কবিতা', 'পিতৃলোক', 'বহুব্রীহি', 'স্বস্তিবাচন', 'বিংশোত্তরী' এই আটটি কবিতা নিয়ে মধুবংশীর গলি কাব্য সংকলন প্রকাশিত।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের দ্বিতীয় কাব্য সংকলন "রাজধানী ও মধুবংশীর গলি" ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো 'রাজধানী ,' 'ইন্দ্রপ্রস্থ ' , 'বালাক' , ও 'অজন্তা' ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই কবিতাগুলোর ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা, ভিয়েতনামের দ্বন্দ্ব বিক্ষুব্ধ ঘটনার ছবি ও ইতিহাস ফুটে উঠেছে। যেমন --+ "রাজধানী" কবিতায় কবি প্রাচীন প্রেক্ষাপটকে  বর্তমানের পাতায় রেখে লিখেছেন--
"অনেক দূরের পথ -- ইন্দ্রপ্রস্থ পার হয়ে,
অতিবৃদ্ধ পিতামহ রাজধানী পাশা খেলা হেরে,
যুগে যুগে পাঠান মুঘল রাজ্যের যুধিষ্ঠির হয়ে
মিশে গেছে ইংরাজের কালে"।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র স্বরচিত কবিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন---
"এপারে ওপারে এক সেতুবন্ধনে মোরা নেমেছি।
দানবের কারাগার চূর্ণ হয়েছে এক হুংকারে---
আমরা তোমার সহ-মন সহ -- প্রাণ সহ --চিত্তে
সংগ্রামী বাংলা আমাদেরই বাংলা
উজ্জ্বল ঐক্যের বিত্তে"।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের তৃতীয় কাব্য সংকলন "যে পথেই যাও" দিল্লি থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। দিল্লিতে বসবাস কালের সময় ও সমাজ সচেতন ভাবনা এই কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে। অভাব , পীড়িত সংসারের ছবি ,বিস্মৃত মানুষের মানসিকতা, নিঃসর্গ চিত্র এই কাব্যে র সারমর্ম ---যেমন "অভিরাম পাল " কবিতায় দুঃখ যন্ত্রণা দরিদ্রের সংসারের ছবি সুস্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে---
"অনশন অর্দ্ধাশন বিরোধ বিদ্রোহ আর মিছিলের সং
সব ভুলে গিয়ে আসে আশ্বিনের সোনার সকাল
দাগ সাজ প্রতিমার রং দেয় অভিরাম পাল"!
কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র বিভিন্ন ঘটনায় বিচলিত হয়ে বন্দী জীবনযাপন করার সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তখনই তিনি 'প্রভু'র কাছে  প্রার্থনা জানিয়ে 'গুহার গান' রচনা করেন । দৃষ্টান্ত স্বরূপ----
প্রভু!
তোমার মাথায় পড়ে স্বচ্ছ শুভ্র রাতের কণিকা।
তোমাকে রয়েছে ঘিরে আঁধারের নীরব আলোক।
আমি আছি অতল গুহায় ।
বুকের উপর চেপে রয়েছে অজ্ঞতা,
গভীর সে -- রাত,
স্তূপীকৃত পাহাড়ের সমাধির মতো"।
সুরকার , সংগীতশিক্ষক এবং কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ১৯৭৬ এ 'বার্লিনের হাত ধরে সুরের মেজাজে' কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিল । বার্লিন ভ্রনের ,স্মৃতিসত্তা , মস্কোর কথা ও নাৎসি অত্যাচারের রূপ স্থান লাভ করেছে । দৃষ্টান্ত স্বরূপ ---"বার্লিনের কথা"--+
"এখানে সকলে প্রত্যয়ে নামে রাস্তায় ট্রাম
স্থির বিশ্বাস ,অন্ধটা নয়"!
কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সাম্যবাদী চেতনায় উজ্জীবিত ভাবনায় মানুষের উত্থানের কাহিনী বিভিন্ন কবিতার মাধ্যমে শুনিয়েছেন। মানুষের অভাব ,দারিদ্র্য ,অভিযোগ ,যন্ত্রণা যেমন আছে তেমনি মানব জীবন বাঁচার জন্য ছটফট করছে।সেই মন্ত্র সঞ্জীবনের মন্ত্র। সঞ্জীবনী জীবনের কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র।


Post a Comment

0 Comments