জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র -৪/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                         দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী   
                                       
 চতুর্থ পর্ব       
                 
হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সুহৃদ সুত অধিরথ সস্ত্রীক এসেছিলেন গঙ্গাস্নানে। সারথি জাতের অধিরথের স্ত্রী রাধা অতীব সুন্দরী। কিন্তু বহু যাগযজ্ঞ করে, কবচ ধারণ করেও রাধার কোন সন্তানাদি হয়নি। রাধা গঙ্গায় নেমে দেখলেন একটি পেটিকা ঢেউয়ের দোলায় তার কাছে এসে থেমে গেল। তিনি সঙ্গীদের নিয়ে সেই পেটিকাটি ধরে স্বামী অধিরথকে কাছে ডেকে জল থেকে পেটিকাটি তুলে ডাঙ্গায় এনে তুললেন। ডাঙ্গায় তোলার পরে অধিরথ পেটিকোট খুলে দেখলেন তার মধ্যে শায়িত এক নবজাতক যার সর্বাঙ্গে সোনার বর্ম, কর্ণে স্বর্ণকুণ্ডল এবং বাহুতে দিব্য কবচ। তিনি রাধাকে বললেন "দেখ এত যাগযজ্ঞ করেও তোমার কোন সন্তান লাভ হয়নি, কিন্তু আজ মনে হয় স্বয়ং ভগবান তোমার কাছে এই রুপবান দেবশিশুকে পাঠিয়েছেন"। এই বলে সেই শিশুকে স্নেহাতুর রাধার কোলে তুলে দিলেন। অধিরথ ও রাধা শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে যেয়ে লালন-পালন করতে লাগলেন। শিশুর নামকরণের সময়ে ব্রাহ্মণেরা শিশুর অঙ্গে সোনার বর্ম ও কর্ণে কুণ্ডল দেখে তার নাম দিলেন বসুষেণ। বসু শব্দের অর্থ সোনা অর্থাৎ সোনার ছেলে। রাধার পালিত সন্তান বলে তার আর এক নাম হলো রাধেয় এবং তিনি সর্বত্র সেই নামেই পরিচয় দিতেন।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

এবারে আমরা কর্ণের জন্মের সময়ের তৎকালীন শাস্ত্র বা সমাজনীতি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করব। মহাভারত পূর্বের যুগে বর্ণসঙ্কর জন্মে কোন অখ্যাতি ছিল না। প্রথমে আমরা উদাহরণ দিই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মের কথা দিয়ে। কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করার পরে দৈব নির্দেশে বসুদেব যমুনাপারে গোপপল্লীতে যেয়ে নন্দ রাজা ও মা যশোদার কাছে সন্তানকে রেখে এসেছিলেন লালন-পালন করার জন্য। শ্রীকৃষ্ণ কৈশোরে অগ্রজ বলরামকে সঙ্গে নিয়ে কংসের কারাগার থেকে পিতা বসুদেব মা দেবকীকে মুক্ত করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে কিন্তু তার জন্ম পরিচয় নিয়ে কেউ তাকে তির্যক মন্তব্য করেনি বা রাজ পরিবারের সন্তান না হওয়ার জন্য তাকে সারা জীবনে কোনো মনোকষ্টে ভুগতে হয়নি। ভীমার্জ্জুন ও দ্রৌপদী সারা জীবন সুতপুত্র বলে কর্ণকে খোঁটা দিতেন তা সর্বৈব মিথ্যা। সন্তানের জন্মের ক্ষেত্রে আমাদের আরও পিছনে যেয়ে দেখতে হবে মনুর বিধান কি?  সেখানে মনু বলেছেন ক্ষত্রিয় যদি ব্রাহ্মণের পানি গ্রহণ করে তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে সেই পুত্রকে সুতপুত্র বলা হয়। "ক্ষত্রিয়াদ্ বিপ্রকণ্যায়াং সূতো ভবতি জাতিতঃ"। এক্ষেত্রে কর্ণ কিন্তু সেই অর্থে সুতপুত্র নয়। এবারে বলি কৌরব, পান্ডব যারা চন্দ্রবংশজাত বা ভারতবর্ষের তৎকালীন অনেক গৌরবোজ্জ্বল বংশের আদি পুরুষ হলেন রাজা নহুশের পুত্র যযাতি। যজাতি ও দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর বংশধরেরা হলেন যদু এবং তুর্বসু। এই যদুর থেকে যাদব বংশের উৎপত্তি। আবার যযাতি ও অসুর বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠার প্রনয়ের ফলে তিন পুত্রের জন্ম হয়। তারা হলেন দ্রুহু, অনু এবং পুরু। এই পুরুর বংশধর হলেন হস্তিনাপুরের কৌরব ও পান্ডবেরা। তাহলে কেবলমাত্র বসুষেণকে কেন সুতপুত্র বলে তির্যক মন্তব্য করা হয়েছিল সেটাই বোধগম্য নয়। এক্ষেত্রে একটাই কারণ, সত্য প্রকাশ পেলে পৃথিবী ক্ষত্রিয় মুক্ত হয়ে দ্বাপর যুগের শেষে কলি যুগের সূচনা হতো না যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং তার জন্যই তিনি মর্ত্যধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
কর্ণের শিক্ষালাভের জন্য অধিরথ বসুষেণকে নিয়ে হস্তিনাপুরে মিত্র ধৃতরাষ্ট্রের আবাসে গেলেন যাতে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডুর পুত্রদের সাথে বসুষেণ গুরু দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্যের কাছে শাস্ত্র ও শস্ত্রশিক্ষা লাভ করতে পারে। কিন্তু সেখানেও তার বংশ পরিচয়ের গ্লানি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তাঁর ছিল ঈশ্বর প্রদত্ত আশীর্বাদ যার বলে তিনি অর্জুনের সমকক্ষ হয়েছিলেন। কিন্তু জননী কুন্তী বা পিতামহ ভীষ্মের কাছে সুযোগ ঘটে ছিল কর্ণের জন্মের সত্য প্রকাশ করার, যেদিন গুরু দ্রোণাচার্য তাঁর প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের অস্ত্র পরীক্ষার জন্য রঙ্গভূমি স্থলে সকলকে মিলিত করেছিলেন। প্রথমে ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ হলো, দেখা গেল দুজনেই প্রায় সমান সমান। এরপরে অর্জুনের পালা। তিনি যত প্রকার শিক্ষা লাভ করেছিলেন গুরুর কাছে তার সবগুলোই প্রদর্শন করার পরে সকলেই বাহবা দিতে লাগল। এমন সময় রঙ্গভূমিতে কবচকুণ্ডলশোভিত দীপ্তিমান পুরুষ কর্ণ এসে বললেন - "আমি গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে যদিও সমস্ত শিক্ষা লাভ করতে পারিনি তথাপি নিজের অধ্যবসায়ে যা শিক্ষা করেছি তার আমি প্রর্দশন করতে চাই"। দ্রোণ ভাবলেন সত্যিই তো বসুষেণকে আমি সব শিক্ষাদান করিনি, দেখা যাক সে নিজের অধ্যবসায়ে কি শিখেছে। তিনি অনুমতি দিলেন। অর্জুন যা যা প্রদর্শন করেছিলেন কর্ণ সেগুলি প্রদর্শন করে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্বে আঘাত হানলেন। এতে অর্জুন অপমানিত বোধ করে বললেন "এই রঙ্গভূমি কেবলমাত্র রাজকুমারদের জন্য স্থিরীকৃত। তুমি অহেতুক রবাহুত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছ"। কর্ণ বললেন "রঙ্গভূমিতে সকলেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ কর"। দুই পুত্রের সম্মুখযুদ্ধে কাউকে কিছু না বলতে পেরে মানসিক যন্ত্রনায় কুন্তী মূর্চ্ছা গেলেন। এমন সময় কৃপাচার্য বললেন "বংশগরিমায় সমানে সমানে নাহলে প্রতিদ্বন্দিতা কিভাবে হবে? অর্জুন পান্ডু রাজা ও কুন্তীর নন্দন, কিন্তু তোমার বংশ পরিচয় দিয়ে তুমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা কর"। এই কথা শুনে কর্ণ বিরস বদনে হেঁটমুণ্ড হয়ে রইলেন। এমনসময় দুর্যোধন রঙ্গভূমিতে ঘোষণা করলেন "বংশ পরিচয় যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হয়, সেক্ষেত্রে আমি এই স্থলে মহাবীর কর্ণকে যথোচিত মর্যাদায় অঙ্গরাজ্য দান করে তাকে অঙ্গরাজ বলে ঘোষণা করছি এবং আজ থেকে আমৃত্যু সে আমার সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হল। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তার আর কোনো অসুবিধা হবে না"। এই কথা শুনে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রমুখ প্রমাদ গনলেন। ইত্যবসরে সূর্যদেব অস্তাচলে, এই সুযোগে সেদিনের মত শিক্ষার্থীদের অস্ত্র পরীক্ষা প্রদর্শন বন্ধ হয়ে গেল। 
প্রশ্ন এখানেই যে সেদিন যদি কুরু পিতামহ বা বয়োজ্যেষ্ঠরা শাস্ত্রের নিয়মানুসারে কর্ণের জন্ম পরিচয় দিতেন অথবা কুন্তী সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করতেন তাহলে সারা জীবনে কর্ণকে বংশ পরিচয়ের গ্লানি বহন করতে হতনা। স্বয়ং মহাভারতকার ব্যাসদেব সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও কর্ণকে বংশপরিচয়ের গ্লানি থেকে মুক্ত করার কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্ত তথ্য গোপন করে তাঁরা কর্ণের জীবনের অভিশাপের কারণ হয়ে ছিলেন অথবা ভাগ্য কর্ণের সহায় ছিলনা? এইখানেই কর্ণের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন হয়ে গেল এবং সেখান থেকে আজন্ম তিনি পান্ডবদের বিশেষতঃ অর্জুনকে সহ্য করতে পারতেন না এবং তাদেরকে কিভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা যায় সেই চেষ্টায় দুর্যোধন ও কৌরবদের সাথী হয়েছিলেন।                              
ভাগ্য! জন্মলগ্নে প্রতিকূল গ্রহ-নক্ষত্রের সহাবস্থানের জন্য দেব অংশে জন্মগ্রহণ করেও তিনি পিতৃপরিচয়ে বঞ্চিত। কুন্তীর কানীন পুত্র তিনি, কিন্তু সে পরিচয় কর্ণ নিজেও জানতেন না অবশ্য জানলেও যিনি জন্মক্ষণে পরিত্যক্ত এবং শিশুকাল থেকে যে পালক পিতা মাতা তাঁকে লালনপালন করেছেন তাদেরকে অস্বীকার কর্ণ কোনদিন করতেন কিনা সন্দেহ! সে প্রকৃতির অকৃতজ্ঞ তিনি ছিলেন না। অথচ এই পরিচয়ের জন্য পাঞ্চাল রাজের স্বয়ম্বরসভায় দ্রৌপদী তাকে মর্মান্তিক অপমান করেছিলেন। সর্বপ্রকার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্বয়ংবরের যোগ্যতা পরীক্ষা করার ন্যায্য সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়নি। অবশ্য ধৃষ্টদ্যুম্নের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী তিনি নিজের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, কিন্তু তাঁর সে প্রবৃত্তি হয়নি। তিনি শুধুমাত্র দ্রৌপদীকে করুন মধুর হাস্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন "কল্যাণী, তুমি সুখী হও। আমার জন্য তোমাকে অকালে জীবন নষ্ট করতে হবে না"। কর্ণের এই মার্জিত ভদ্র ব্যবহার দ্রৌপদীর উপলব্ধি হয়েছিল বহু বৎসর পরে যা তিনি তাঁর একান্ত সখা বাসুদেবকে বলেছিলেন।
  
………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

1 Comments