জ্বলদর্চি

টুসু গানে গানে- টুসু সত্যাগ্রহ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৫২

টুসু গানে গানে- টুসু সত্যাগ্রহ

সূর্যকান্ত মাহাতো

"বন্দে মাতরম্"

"শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ দেখাই।
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।।"

"উপরের একটি 'শব্দ' আর গানের ঐ প্রথম লাইন এখনো পুরুলিয়াবাসীর রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দেয়। মনে জোশ আনে শরীরে বল বাড়াই। একটির রচয়িতা হলেন 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়', অন্যটির রচয়িতা হলেন 'ভজহরি মাহাত'। স্বাধীনতা আন্দোলন কর্মীদের 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনি আর অন্যদিকে পুরুলিয়ায় ভাষা আন্দোলন কর্মীদের 'শুন বিহারী ভাই/ তোরা রাখতে নারবি ডাঙ দেখাই' এই দুটোই যেন আন্দোলনকারীদের শরীরে ও মনে বাড়তি টনিকের কাজ করত।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের "অনান্দমঠ" উপন্যাসের 'বন্দেমাতরম্' তো আলাদা মাত্রা তৈরি করেছিল। কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ওই শব্দ ধ্বনিতেই আসমুদ্র হিমাচল জেগে উঠত। কিন্তু অন্যটি তো কখনো শুনিনি। এ গান কী ধরনের গান?"

বললাম, "এটাও একটা আন্দোলন ছিল। ভাষা আন্দোলন। আন্দোলন কর্মীদেরকে সর্বদা উজ্জীবিত করার একটি "টুসু গান"। নিজেদের মুখের ভাষাকে জোর করে কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে যে গন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, 'টুসু গান' ছিল তার মূল মহামন্ত্র।"

জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

শিক্ষামশাই বললেন, "স্বাধীনতার কিছু পূর্বকাল থেকেই বিহারীরা পুরুলিয়া সহ মানভূমের বাংলা ভাষাভাষীদের উপর একরকম জোর করেই হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দিচ্ছিল। মানভূমবাসীর মাতৃভাষাকে জোর করে রুদ্ধ করছিল বলে মানভূমবাসীরা ভাষার ভিত্তিতে আলাদা একটা রাজ্য গঠনের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল বলে পড়েছিলাম। "মানভূম কেশরী" হিসাবে বিখ্যাত অতুলচন্দ্র ঘোষ মানভূমকে বাংলায় যুক্ত করার জন্য এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। (ভাষা আন্দোলন ও টুসু গান/ডক্টর শান্তি সিংহ, অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া, ২য় পর্ব, দেবপ্রসাদ জানা, পৃষ্ঠা ১০৫)। এটাই কি সেই আন্দোলন?"

বললাম, "হ্যাঁ। আর ওই সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়েছিল টুসু গানে গানেই। টুসু গানকে হাতিয়ার করেই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বলে, এই আন্দোলনের নাম "টুসু সত্যাগ্রহ" রাখা হয়েছিল। ডঃ সুধীর কুমার করণ আরো সহজ ভাবে বলেছেন, "বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করার চক্রান্তকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মানভূম জেলায় লোক সেবক সংঘের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারই নাম খ্যাত হয়ে আছে টুসু সত্যাগ্রহ রূপে" (সীমান্ত বাংলার লোকযান/ডক্টর সুধীর কুমার করণ, পৃষ্ঠা ২০১)।

শিক্ষক মশাই বললেন, "কিন্তু এই ভাষা আন্দোলন কীভাবে টুসু সত্যাগ্রহ হল? টুসুর সঙ্গে এর সংযোগই বা কি!"

বললাম" "টুসুর সঙ্গে এই আন্দোলন এর যোগ এ কারণেই, কারণ এই ভাষা আন্দোলনের একমাত্র হাতিয়ার ছিল "টুসু গান"। এই গানের মধ্য দিয়েই সত্যাগ্রহীদের উদ্বুদ্ধ করা হত, গানে গানে প্রতিবাদ জানানো হত, এমনকি সংগ্রামে ডাক দেওয়া হতো,। ভজহরি মাহাত রচিত টুসু গানের ওই লাইন, 'শুন বিহারী ভাই/তোরা রাখতে নারবি ডাঙ দেখাই' গোটা মানভূমকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল। 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনির থেকেও যা কোন অংশে কম শক্তিশালী ছিল না।"

"কিন্তু 'টুসু' গানকেই কেন ব্যবহার করা হয়েছিল?"

"কারণ টুসু গান অন্তর থেকে উৎসারিত গান। আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, হতাশা-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট সবকিছুই  টুসু গানে গানেই প্রতিভাত হয়। এছাড়াও ছিল এ গানের জনপ্রিয়তা। টুসু গানের সহজ সরল সুরে গোটা মানভূম বাসী যেন এক সুতোয় বাঁধা থাকে। এমনকি তাদের আত্মসংস্কৃতির পরিচয়কও ছিল এই গান। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিহারীদের আগ্রাসনে যাতে কোনভাবেই অবরুদ্ধ না হয়ে পড়ে, কিংবা হারিয়ে না যায়, তার জন্যই এই আন্দোলন। আর আন্দোলনকে জাগিয়ে রাখতে তাই টুসু গানকেই হাতিয়ার করা হয়েছিল। তার প্রভাবও পড়েছিল দারুণ রকমের। জননেতা 'অতুলচন্দ্র ঘোষে'র পুত্র 'অরুণচন্দ্র ঘোষ' এই আন্দোলনে একটার পর একটা টুসু গান রচনা করে আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন। সেরকমই একটি গান হল---
"আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে
মারবি তোরা কে তারে
এই ভাষাতেই কাজ চলেছে
সাত পুরুষের আমলে
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা বলে।"

ভাষা আন্দোলনের সে সময় যে টুসু গানগুলি রচিত হয়েছিল সেগুলোকে একত্রিত করে একটি 'সংকলন' সম্পাদনা করেছিলেন অরুণচন্দ্র ঘোষ। সেই সংকলনের তিনি নাম দিয়েছিলেন "টুসুর গানে মানভূম"। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাতকারে তিনি ডঃ শান্তি সিংহকে জানান, টুসুর গানে মানভূম পুস্তিকাটি সে সময় নাকি এক লক্ষ কপি ছাপা হয়েছিল। এবং অল্পদিনে তা নিঃশেষিত হয়েছিল।( ভাষা আন্দোলন ও টুসু গান/ ডক্টর শান্তি সিংহ, অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া(২য় খন্ড) দেবপ্রসাদ জানা, পৃষ্ঠা- ১৩৬)। তবে এইসব রাজনৈতিক গানে লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য কতখানি উপস্থিত তা নিয়েও একাধিক মত তৈরি হয়েছে। আমি সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কেবল টুসু গানের প্রভাব ও ক্ষমতা, যে কতখানি হতে পারে সেই কথায় কেবল ব্যক্ত করলাম।"

চলবে...

Post a Comment

0 Comments