জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৫৭/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫৭ 

বাবলিরা যেখানে থাকে সেই জায়গাটার নাম অ্যাপেলডোর অ্যাভিনিউ। বাড়ির দুপাশে, সামনে ও পিছনে যারা বাস করেন তাঁরা প্রায় সবাই ব্রিটিশ। দুই পাশে দুই বৃদ্ধ বাস করেন। মি. ডেভিড আর মি. মরগ্যান। ডেভিডের স্ত্রী গত চার বছর ধরে হাসপাতালে আছেন। উনি কিন্তু একা হলেও বেশ গুছিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝেই ৩/৪ দিনের জন্য দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যান। হাঁটু পেতে বসে নিজেই ফুলের গাছ লাগান, যত্ন করেন। হাঁটু পেতে বসতে যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্য কী যেন একটা হাঁটুর নিচে রাখেন। এদেশে নিজেদেরই এসব কাজ করতে হয় বলে কাজের সুবিধার জন্য নানান জিনিস পাওয়া যায়। মরগ্যান স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন। মাঝে মাঝে ওই বাড়ি থেকে বাচ্চাদের কোলাহল শোনা যায়। নাতি নাতনিরা উইকেন্ডেএ বাবা-মায়ের সঙ্গে দাদু-দিদার কাছে সময় কাটাতে আসে, তবে সব উইকেন্ডে নয়।  একেবারে মুখোমুখি বাড়িতে হ্যানি নামে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা একাই থাকেন। খুব মিশুকে। সবার খোঁজ খবর রাখেন। এই ভদ্রমহিলা নিজে হার্টের রোগী। তাই বাড়ির মেন দরজাতে কোনও সময় ছিটকিনি লাগান না। যাতে ডাক্তারি পরিসেবা পেতে দেরি না হয়। হ্যানির দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে ব্যাঙ্কার, বড়মেয়ে বিয়ে করেননি। এই শহরেই বাড়িভাড়া করে থাকেন। প্রায় রোজ এসে মায়ের সমস্ত বাড়ির কাজ, বাগানের কাজ  করে দিয়ে যান। তবুও মায়ের কাছে থাকেননা, মাও কাছে রাখেন না। হ্যানি একদিন আলাপ করতে এসে দেখে গিয়ে ওনার বাঙালি বন্ধু পুস্প রায়কে বলেছিলেন, আমার সামনের বাড়িতে ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে  কলকাতা থেকে একটি মেয়ে এসেছে। তুমি যদি একবার দেখা করতে। হ্যানির ছেলে ও পুস্পদির ছেলে ছোট থেকে একে অপরের বন্ধু এবং পুস্পদির ছেলেও ব্যাংকার। স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে লন্ডনে থাকে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
    পুস্পদি তখন নটিংহামে থাকতেন। সদ্য স্বামীকে হারিয়েছেন, তবুও হ্যানির  কথা শুনে এসেছিলেন। ওনার মেয়ে ছিল না, বাবলিকে উনি মেয়ের মতই ভালবেসে ফেলেন। নিজমুখে সে কথা তিনি আমাকেও বলেছেন। পুস্পদিও খুব মিশুকে ও স্বাধীনচেতা মানুষ। সবার সঙ্গে  হই হুল্লোড় করে জীবন কাটাতে ভাল বাসেন। তাই স্বামীর মৃত্যুর পর নটিংহামে একা থেকে গেছলেন। ওনার মাধ্যমেই নটিংহামের আরও কয়েকটি বাঙালি ফ্যামিলির সঙ্গে মেয়ে জামাইয়ের আলাপ হয়। ওরা সবাই মিলে একটি অ্যাসোশিয়েশন গঠন করেন। এদের মধ্যে ইয়ং  জেনারেশনের সংখ্যাই বেশি এবং এরা বেশিরভাগই ডাক্তার। কেউ প্যাথলজিস্ট, কেউ রেজিস্টার, কেউ বা কনসালটটেন্ট। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কনসালটটেন্ট, এমন একাধিক ফ্যামিলি রয়েছে। এদের মধ্যে স্কুল টিচারও রয়েছে। বয়স্কাদের মধ্যে ডাক্তার ও নার্স রয়েছেন।
      নটিংহাম আসায় প্রায় প্রত্যেকের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ পেয়েছি। অঞ্জু আর নিনাদি বাবলিদের খুব কাথেই থাকেন। অঞ্জু স্কুলে আর ওর স্বামী কলেজে পড়ায়।ওদের একমাত্র ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে আ্মাদের সবার নিমন্ত্রণ ছিল। ওখানে অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে। নিনাদি(ডাক্তার, রমাদি, সুজাতাদি,মিতাদি, ও পুস্পদির সঙ্গে। পুস্পদির আসার খবর অনেকেই জানত না, আজ সরাসরি  লন্ডন থেকে এসেছেন। ওনাকে সামনে দেখেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। পুস্পদির সঙ্গে আগে সামনা সামনি  দেখা না হলেও ফোনে কথা হত।
    পুস্পদি হয়ত নটিংহামেই থেকে যেতেন। কিন্তু সেটা না হয়ার কারণ সুদের  মায়া। আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, ‘আসলের থেকে সুদের মায়া বেশি’। সন্তানের চেয়ে নাতি নাতনির প্রতি আমরা বেশি টান অনুভব করি। পুস্পদিরও তাই হয়েছে। উনি ছেলের কাছে থাকতে পারতেন না। কারণ ওনার ছেলের স্ত্রী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এবং পোশাক আসাকে অত্যাধুনিকা বললেও কম বলা হবে। উনি সব মেনে নিলেও বৌমা শাশুড়িকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেওয়া দূরে থাক, সুযোগ পেলে হেনস্তা করতেন। তবুও এই সুদের মায়াতেই, ছেলে যখন বলল,মা, এতদূরে থাকতে হবেনা, তুমি লন্ডন চল। উনি আপত্তি করেননি। ছেলে এখানকার বাড়ি বিক্রি করে লন্ডনে মাকে একটি ছোট্ট বাড়ি কিনে দিয়েছে।
    পুস্পদির ছেলে-বউমা দুজনেই চাকরি করে। সমস্যা হল বাচ্চাদের কার কাছে রেখে যাবে? সে দায়িত্ব পুস্পদি হাসিমুখে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তবে ছেলের বাড়িতে উনি থাকেন না। রোজ সকালে ছেলের বাড়িতে যান, সারাদিন নাতি নাতনিদের দেখাশোনা করে সন্ধ্যায় নিজের বাড়ি ফিরে যান। এভাবেই চলছে। আমরা নটিংহাম আসার পর অঞ্জু দুদিন দেখা করতে এসেছিল, ঘুমাচ্ছিলাম বলে আমাকে ওঠাইনি।আ জই প্রথম দেখা হল। বাবলি অঞ্জু ও আর  একটি ছিপছিপে সুন্দরী মেয়েকে আমার সামনে নিয়ে এসে বল্ল, মা এ হল মউসুমিদি (কনসালটটেন্ট)। পুস্পমাসি লন্ডন চলে যাওয়ার পর এই দুই দিদি আমাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে। শুনে খুব ভাল লাগল। এদেশে বাঙালি ও ভারতীয়রা নিজেদের এভাবেই বেঁধে বেঁধে রাখে।
    পুস্পদি এখানে এলে সুপ্রীতিদিদের বাড়িতেই ওঠেন। তাই ওঁদের দুজনকেই ডিনারে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুপুরেই বেশিরভাগ রান্না করে রাখলাম। মাছ, চিকেন, ফুলকপির রসা, বেগুনভাজা, চাটনি, এসব বাঙালি খাবারই রান্না করেছিলাম। শসা, গাজর, টম্যাটো, পাতাসহ কচি পেঁয়াজ দিয়ে একটা স্যালাড বানিয়েছিলাম, দারুণ দেখতে হয়েছিল। টম্যাটোর গোলাপ আর কচি পেঁয়াজের রজনীগন্ধা খুব সুন্দর হয়েছিল। পুস্পদি জারা আর আমার জন্য অনেক গিফট এনেছিলেন। সুপ্রীতিদি সন্দেশ বানিয়ে এনেছিলেন।
      পরদিন পুস্পদিসহ একটা বড় দল ডার্বি বেড়াতে গেলেন। আগে থেকেই ওখানে থাকার জন্য একটা পুরনো ক্যাসেল(এখন থাকার হোটেল) বুক করা ছিল। দীপের কাজ থাকায় আমরা গেলাম না।তাছাড়া খান সাহেব রাজি হতেন না।ওনার অসুবিধা হত। যাইহোক, আমরা দুদিন পর শনিবার ডার্বি গেলাম। প্রথমে একটা সপিংমলে, তারপর একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। এখানে লাঞ্চ করে পুস্পদিদের খোঁজে রওনা দিলাম। ফোন করে জানা গেল ওঁরা তখন একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করছেন। আমরা সেখানেই পৌঁছালাম। দেখলাম রেস্টুরেন্টের ভিতরে নয়, পেছনের দিকে খোলা আকাশের নিচে কিছু টেবিল ও বেঞ্চ পাতা আছে, সেখানেই সবাই হাল্কা রোদ্দুরে বসে হাল্কা মেজাজে লাঞ্চ করছেন। আমাদেরকে লাঞ্চের কথা বলা হলে, জানিয়ে দিলাম আমরা লাঞ্চ করে এসেছি। এই জায়গাটা খুব সুন্দর, আমরা যেখানে বসে আছি, তার পাশেই কিছুটা নিচ দিয়ে বেশ শব্দ করে নদী বয়ে চলেছে। শব্দটা জলের আছড়ে পড়ার শব্দ। এই জায়গায় জলের তলে  স্টেপিং করা আছে। তাই নদীর জল একটা ধাপ থেকে আর এক ধাপে শব্দ করে আছড়ে পড়ছে। নদীর ওপারে পাহাড়, পাহাড়ের কোলে গাড়ি চলাচল করার মত রাস্তা।
    এখান থেকে আমরা ওদের সঙ্গে ক্যাসেলে গেলাম। ভিতরটা কেমন যেন ভূতুড়ে ভূতুড়ে। পাহাড় কেটে এই ক্যাসেল তৈরি হয়েছে। এখানে ভূতের সিনেমার শুটিং করলে মন্দ হবে না। এখানে সুপ্রীতিদির হাতে তৈরি সন্দেশ খেলাম। সন্দেশের মত সুপ্রীতিদির গানের গলাটিও বেশ মিষ্টি। এখানে বেচা কেনার এক অদ্ভুত পদ্ধতির কথা শুনলাম। সকালে কয়েকজন মিলে বেড়াতে বেরিয়ে ছিলেন। তখনই দেখতে পান দরজার বাইরে কয়েকটি ডিম রাখা আছে, ডিমের গায়ে ডেট এবং দাম লেখা রয়েছে। ওরা হিসেব মত দাম রেখে ডিমগুলি নিয়ে এসেছে। বেশ অদ্ভুত কেনাবেচা না!
      আমাদের ভাল রাখার জন্য, খুশি রাখার জন্য মেয়ে জামাইয়ের চেষ্টার ত্রুটি নেই। যদিও ওরা তিনজনই সারাদিন ব্যস্ত থাকে। দীপের তো অনেক সময় শনি রবিবারেও ছুটি থাকে না। তার ওপর নাইট ডিউটি থাকে। ডাক্তারদের জীবন যেমন হয়। তবে পার্থক্য হল, এদেশে ডাক্তাররা সবকিছু সরকারি হাসপাতালেই করে, আমাদের দেশে একসাথে একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে অনেক বেশি আয় করা যায়। বিদেশে এটা হয় না। যত কাজই থাকনা কেন, কাজের ফাঁকেই আমাদের কাছে দূরে বেড়িয়ে আসে।
                                    ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments