আমি আমার মতো
পর্ব -১১
সুকন্যা সাহা
বইমেলা
ফেব্রুয়ারিতে কত উৎসব ! বসন্ত সমাগম যে ! নব বসন্তের আগমনে মানুষে মানুষে মিলন মেলা ... চাঁদের হাট। বাঙ্গালীর বারো মাসে তেরো পার্বনের চতুর্দশ পার্বন বইমেলা। বইপ্রেমীদের কাছে তো বটেই অপ্রেমিকদের কাছেও বাৎসরিক উৎসব এই বইমেলা ।বইকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রকাশনা শিল্পের বৃহত্তম বাজারও বটে ।কত মানুষের সারা বছরের রূটি রুজি, তারা সম্বৎসরের এই কটা দিনের অপেক্ষায় দিন গোনে! লেখক ,পাঠক, পুস্তক বিক্রেতা প্রকাশন সংস্থার মালিক কে নেই এই বিকিকিনির হাটে!কত মানুষ সাত সমুদ্দুর তেরো নদী উজিয়ে আসে এই বইমেলার টানে !প্রতিবার দেশী বিদেশী নানান থিমে জমে ওঠে মেলা । বিশ্বের কত দেশ যে এই বইমেলার থিম দেশ হয়, তার ইয়ত্তা নেই।
সব মিলিয়ে কলকাতা বইমেলা সর্ব অর্থেই আর্ন্তজাতিক । বাঙালীর কাছে বইমেলা আর দুর্গাপুজোয় বিশেষ তফাৎ নেই। দুটোই উৎসব।এইবার কলকাতা আর্ন্তকাতিক বইমেলা ৪৬ তম বর্ষে পড়ল ।বইমেলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ পুরোনো ।সেই কলেজ জীবনের দিনগুলি থেকে । যখন বইমেলা পার্কস্ট্রীটে হত।সেই মেট্রো করে বইমেলা যাওয়া হত তখন । বইমেলা তখন আমায় টানত চুম্বকের মতো। অত বড় মেলা ,স্টলে স্টলে অজস্র নতুন বই...নতুন বইয়ের গন্ধ... সত্যি বলতে কি তখন বেশী বই কেনার মতো পকেটে রেস্ত ছিল না! তবে প্রচুর বই উল্টে পাল্টে দেখতাম... দেখার ফাঁকে ফাঁকে খানিক পড়ে নেওয়ার চেষ্টাও করতাম ।তারপর বই, লেখক আর প্রকাশনা সংস্থার নাম লিখে নিয়ে পরে খোঁজ করতাম কলেজস্ট্রীটের পুরোনো বইয়ের দোকানে।
এখনকার জেনারেশান শুনি বই পড়ে না ! কিন্তু বইমেলার উপচে পড়া ভীড় দেখলে তা কে বলবে ? আমাদের সময়ে সারা বছরের হাত খরচের টাকা জমানো থাকত এই বইমেলায় বই কেনার জন্য।তাছাড়া বইমেলায় বই কেনার জন্য আলাদা করে টাকা দিতেন মা ।প্রথমদিকে বইমেলা অভিযান হত একজন নির্ভেজাল পাঠক হিসেবে। খুব ছোটো থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতাম খুব । বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের ওপর আমার আগ্রহ ছিলঅপরিসীম । খুব ছোটোবেলায় বই সাপ্লাই দিত পাড়ার মুকুলমেলা লাইব্রেরী। তারও পরে অফিসের লাইব্রেরী থেকে মোটা মোটা উপন্যাস নিয়ে আসত মা। বলা বাহুল্য দু একদিনের মধ্যেই সেই বইগুলি গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম ।লেখালিখি করি আমি সেই ১৯৯৯ সাল থেকে । কিন্তু কোনোদিনই প্রকাশ করার তাগিদ অনুভব করি নি।মনে আছে অর্থোপেডিক সার্জন ডঃ সমীর গুপ্ত প্রথম আমার লেখা চেয়েছিলেন ; তার মিলে মিশে পত্রিকায় প্রথম আমার একটি কবিতা ছাপা হয়।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
এখন এই লেখালিখির জগতে আসার পর বইমেলার প্রতি আকর্ষন আরও বেড়ে গেছে । কত পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। আড্ডা হয়। তবে মজার ব্যাপার এখন দেখি সবাই লেখক ; সবাই কিছু না কিছু লিখছে ... বই প্রকাশ করছে ... বইমেলার প্রাক্কালে সারা ফেসবুক জুড়ে নিজের বইয়ের অ্যাড ।প্রকাশকের পাশাপাশি লেখকরাও খুব বাণিজ্য সচেতন । নিজের বইয়ের মার্কেটিং করতে ব্যস্ত সবাই। এত লেখকের ভীড়ে সিনসিয়ার পাঠক পাওয়াই মুস্কিল। পাঠকের সংখ্যা হাতে গোনায় এসে ঠেকেছে ।
লেখালিখি আর অফিসের চাপে পড়ার সময় কমে গেছে আমারও। আগে বইমেলায় কেনা প্রতিটি বই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়ে শেষ করতাম ।এখন সারা বছর কত বই পাই... অনুরোধ থাকে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে দেওয়ার ...কিন্তু বছর ঘুরে গেলেও পড়া হয়না অনেক বই ই। বইমেলার বাজারে এখন একটা কথা খুব চালু হয়েছে... পুশ সেল। নিজের বন্ধুদের মধ্যে নিজের বই কিছু জোর করে বিক্রি করা ... তাতে কিছুটা হলেও প্রকাশককে পয়সা ফেরত দেওয়া যায় । ইদানীং কালে দেখছি প্রকাশনার জগতে জোয়ার এসেছে ।পুরোনো প্রথিত যশা সংস্থাগুলির পাশাপাশি অনেক নতুন সংস্থা উঠে আসছে । আসছে প্রচুর নতুন ছেলে মেয়ে। ফেসবুকে তৈরী হচ্ছে পাঠক বৃত্ত; বন্ধু সার্কেল।আসলে ফেসবুক এসে সবাই নিজের নিজের কথা লেখার সুযোগ পাচ্ছে । তবে লিখতে গেলে আগে শতকরা একশো ভাগ সিন্সিয়ার পাঠক হতে হবে আগে ।আগে একা একাই ঘুরে বেড়াতাম বইমেলার প্রাঙ্গনে । ইদানীং মেয়েও আমার হাত ধরে বইমেলায় যাচ্ছে । ওর ইংরেজী বই কেনার ঝোঁক বেশি। যেভাবে গোগ্রাসে বই পড়ে ; ওকে দেখে আমার ছোটোবেলাটা মনে পড়ে যায় । তাছাড়া বইমেলায় ওর আরেকটা আকর্ষনের জায়গা প্রচুর পেন্টিং দেখার সুযোগ হয়... পেন্টিং এর বই কেনারও সুযোগ হয় ... বইমেলা চলাকালীন বিভিন্ন প্যাভেলিয়ানে হয় লিটেরারি মিট। স্বনামধন্য মানুষদের বক্তব্যে ঋদ্ধ হই আজও। পার্কস্ট্রীট থেকে মিলন মেলা পেরিয়ে এখন বইমেলার স্থায়ী ঠিকানা করুনাময়ীর মেলার মাঠ। আমার অফিসের এক্কেবারে কাছে । তাই অফিস ফেরতা প্রায়দিনই ঢুঁ মারা যায় বইমেলায়। যতই বির্তক চলুক এবং অনলাইন লেখালিখি যতই বইয়ের বাজার শেষ করে দিচ্ছে বলে গেল গেল রব উঠুক... আজও বইয়ের বিকল্প বই-ই ।
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments