জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- কারাতাইকা (রাশিয়া)চাঁদে হাত বাড়িও না /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- কারাতাইকা (রাশিয়া)
চাঁদে হাত বাড়িও না
চিন্ময় দাশ


দেশটার উত্তর দিক জুড়ে সমুদ্র। মাইলের পর মাইল সীমান জুড়ে। সেই রকমই সমুদ্রের পাড়ে এক গ্রাম। মাটির কুঁড়েঘর বানিয়ে বাস করে এক বুড়োবুড়ি। 
বুড়ো যায় সমুদ্রে মাছ ধরতে। ছোট মতন একটা ডিঙি নৌকা নিয়ে। বুড়ি চরকায় সূতো কাটে ঘরে বসে বসে। তাতে দুজনের দিন চলে যায় কোন রকমে। 
একদিন ছোট্ট একটা মাছ উঠল বুড়োর জালে। আহা, কী সুন্দর দেখতে মাছটা! ঝকঝকে সোনার মত রঙ তার গায়ের।
বুড়ো অবাক চোখে দেখছে, হঠাৎই মাছটা বলে উঠল—আমাকে ছেড়ে দাও গো, ভালোমানুষ। তার বদলে যা চাইবে, তাই দেব তোমাকে।
বুড়ো তো পড়ল আকাশ থেকে। মাছ আবার কথা বলে না কি? বাপ-ঠাকুর্দার আমলেও কেউ কোনদিন শোনেনি এমন আশ্চর্য কথা। 
বুড়ো মানুষ তো! অবাক হোল যেমন, ভয়ও পেল খানিক। তবে কি না, এমন সুন্দর মাছটাকে মেরে ফেলতেও মন চাইল না। ছেড়েই দিল সে মাছটাকে। বলল—ঘরে ফিরে যাও, সোনালি মাছ। কিছুই চাই না আমি তোমার কাছে।
সেদিন আর কাজে মন বসল না। ঘরে ফিরে এল বুড়ো। বুড়িকে সাতকাহন করে শোনাল, মাছের সোনালি রূপের কথা। 


খুশি হবে কী, উলটে বুড়ি রেগে কাঁই। বকাঝকা করতে লাগল বুড়োকে—আচ্ছা বেকুব লোক তো তুমি। বুদ্ধিশুদ্ধি বলে আছে কিছু তোমার মাথায়? বড় কিছু নাহয় না-ই চাইলে। আমাদের মাটির কুঁজোটা কবে থেকে ভাঙা। সেটা জানো না? নিদেন একটা কুঁজো তো চাইতে পারতে।
কী আর করে? ঘর ছেড়ে, বুড়ো আবার সমুদ্রের দিকে চলল। ছোট ছোট ঢেউ এসে ভাঙছে বালির তীরভূমিতে।
--শুনতে পাচ্ছো, সোনালি মাছ? বুড়োর কথা না ফুরোতেই, মাছ এসে হাজির।
মাছ বলল—বলো, কী চাই? 
মাথা সাধ্য মতো ঝুঁকিয়ে, মাছকে অভিবাদন জানালো বুড়ো। যেন কোন রাজার দরবারে এসেছে সে। বুড়ির বকাঝকার কথা জানিয়ে বলল—একটা কুঁজো পেলে, খুব উপকার হয় আমাদের। 
--এই কথা? ঘরে ফিরে যাও। পেয়ে যাবে। বলে, মাছ চলে গেল।
ফিরে এসে উঠোনে পা দিয়েছে, চোখে পড়ল, তাদের দাওয়ায় একটা নতুন কুঁজো। হাসি মুখে সবে দু’পা এগিয়েছে, বুড়ির চিল চিতকার—আচ্ছা হাঁদা তো। এই ভাঙা ঘরে নতুন কুঁজো মানায়? যাও, গিয়ে নতুন একটা বাড়ি দিতে বলো আমাদের। 
অগত্যা আবার সমুদ্রের পাড়ে এল বুড়ো। আকাশে যেন একটু কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে তখন। মাছকে ডেকে, একেবারে অপরাধীর গলায় বলল—বুড়ি এবার একটা নতুন বাড়ি দিতে বলছে।
মাছ বলল-- ভালো কথা। বাড়ি যাও, হয়ে যাবে।
ঘরে ফিরে বুড়ো অবাক। আনকোরা একটা নতুন বাড়ি তার সামনে। বাড়িটার দিক থেকে চোখ ফেরাবার আগেই বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল—সামান্য একজন চাষীবউ হয়ে থাকতে হবে না কি? সেটি হবে না। গিয়ে বলো, বড়লোক আর বনেদি বাড়ির গিন্নি হয়ে থাকব আমি। 
বেচারা বুড়ো! আবার এল সাগরের পাড়ে। ঢেউ একটু উঁচু হয়েছে। কালো রঙ ধরেছে আকাশে। ডাক দিতেই হাজির হয়ে গেল মাছটা। বুড়ো বলল—আমার বউটা পাগল হয়ে গেছে। এবার সে বনেদি গিন্নিমা হতে চাইছে। 
মাছ এবারও রাগ করলনা। বলল—ঠিক আছে। যাও, হয়ে যাবে। 
ঘরে ফিরে আবার বুড়ো অবাক। একটু আগের নতুন বাড়িটাও উধাও। আস্ত একখানা প্রাসাদ গজিয়ে উঠেছে সেখানে। হিরে জহরত বসানো ঝলমলে একটা সিংহাসনে বসে আছে বুড়ি।  
বুড়ির গায়ে রাজরানির মত পোষাক। সারা শরীরে হিরে-মুক্তো বসানো সোনার গয়না। লোক-লস্করের দল ছোটাছুটি করছে ব্যস্তসমস্ত হয়ে। দেখে, বুড়োর একটু মস্করা করবার সাধ হোল।
বুড়ির সামনে গিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে লম্বা একটা কুর্ণিশ করে বলল—রানিমার জয় হোক।
কোন জবাবই দিল না তার বউ। উলটে একটা চাকরকে হুকুম করল—এই হতচ্ছাড়া বুড়োটাকে বের করে নিয়ে যা এখান থেকে। পিছনের দিকের একটা ঘর খুলে দে ওর জন্য। 
সপ্তাহ দুই গেল নির্বিবাদে। একদিন একটা চাকর এসে বুড়োকে ডেকে নিয়ে গেল তার ঘর থেকে—চলো গো, কর্তামা ডেকেছে তোমাকে।
এবার বুড়ি বলল—অবস্থা যতই বদলাক না কেন। কারও না কারও প্রজা হিসাবেই তো আছি আমি। এভাবে চলবে না। সবার মাথার উপরে থাকতে চাই। আমারই অধীনে থাকবে সবাই। এখুনি যাও। ব্যবস্থা করতে বলো।
বুড়োর মাথা ঘুরে গেল কথা শুনে। বলল—মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। বড় হওয়ার আদব কায়দাও জানো না তুমি। লোকে হাসাহাসি করবে তোমাকে নিয়ে।
বুড়ি কট্মট করে চাইল একবার বুড়োর দিকে। মুখে কিছু বলল না। সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিল বুড়োটার গালে। চিৎকার বলল—বেশি রাগিয়ো না আমাকে। যা বলছি, তাই করো। 
বুড়ো বেচারা কী আর করে? আবার এসে হাজির হোল জলের কিনারায়। সেদিন সমুদ্র ভারি উত্তাল। গম্ভীর গর্জন করতে করতে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। কালো মেঘে আকাশ ঢাকা। সমুদ্রের জল দেখা যায় কি যায় না, এমন অন্ধকার।
ডাক দিতেই,মাছ এসে হাজির। বুড়ো মানুষটার ভারি সঙ্কোচ হচ্ছে বলতে। কাঁচুমাচু গলায় বলল—আমার বউ এখন গোটা দেশের রানি হতে চায়। 
মাছ বরাবরের মত বলল—হয়ে যাবে, বাড়ি যাও। 
বাড়ি ফিরে মানুষটার চোখ ছানাবড়া। বিশাল এক প্রাসাদ গজিয়ে উঠেছে। ঝলমলে সিংহাসনে সাম্রাজ্ঞীর মত বসে আছে তার বউ। ধারালো অস্ত্র হাতে পাহারাদাররা ঘিরে আছে তাকে। মন্ত্রী-শান্ত্রী, উজির-নাজির, লোক-লস্করে ঘর ভর্তি। 
বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল বুড়োর। সাহসে ভর করে সামনে গিয়ে বলল—অভিনন্দন জানাই। এবার নিশ্চয়ই খুশি?
বুড়ি কোন উত্তর দিল না। ভুরু নাচাতেই, এক পাহারাদার এসে সরিয়ে নিয়ে গেল বুড়োকে। 
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। বেশ চলছে জীবন। কোন ঝুটঝামেলা নাই। বুড়োর মনে শান্তি। নিশ্চয় চাহিদা ফুরিয়েছে বুড়ির।
মাছের কাছে হাত পাততে যাওয়ার হয়রানিটা গিয়েছে, এই ভেবে বুড়ো নিশ্চিন্ত। কিন্তু তার জানা ছিল না, দুর্ভোগ তখনও শেষ হয়নি। 
ক’দিন না যেতেই, আবার পেয়াদা এসে হাজির। আবার ডেকে নিয়ে যাওয়া হল বুড়োকে। বলা হোল, বুড়ি এবার সমুদ্রেরও মালকিন হতে চায়। সেই সাথে সোনালি মাছকেও সাথে আনতে হবে। রানির কাছে খাস বাঁদি হয়ে থাকবে সে।
বুড়োর তো ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে। আবার তর্ক করতেও সাহস হোল না। রেগে গিয়ে হয়ত গারদেই ভরে দেবে বুড়োকে। 
দুরুদুরু বুকে আবার মাছের কাছে এসে হাজির হোল বুড়োটি। 
সেদিন সেখানে ভয়ানক দুর্যোগ। বৃষ্টি হচ্ছে মুষল্ধারে। বাজ পড়ছে চরাচর কাঁপিয়ে। আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যাবার জোগাড়। ঢেউগুলো উঠে আসছে এক একটা দৈত্যের মত।
বেশ কয়েক বার জোর গলায় চেঁচিয়ে, তবে কানে গেল মাছের। ভেসে উঠল সোনালি মাছটা। বুড়ো জানালো সব কথা। কিন্তু সেদিন কোন জবাব এল না মাছের কাছ থেকে। 
রঙীন পাখনা দুলিয়ে, মাছটা আবার তলিয়ে গেল সাগরের জলে। 
জবাবের জন্য কতক্ষণ বালির উপর দাঁড়িয়ে রইল বুড়োটা। কিন্তু হা-পিত্যেসই সার হোল। না মাছ, না তার জবাব—কিছুরই দেখা পাওয়া গেল না।
অবশেষে হতাশ হয়ে, ক্লান্ত শরীরে বাড়ির মুখে হেঁটে চলল বুড়ো। কিন্তু সে জানতো না, বাড়িতে কোন চমক অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। 
বাড়ির সামনে পৌঁছে, যাকে বলে হতভম্ব হয়ে গেল মানুষটা। এ কী দেখছে সে চোখের সামনে? নিজের চোখকেই ইশ্বাস হচ্ছে না তার। 
খানিক আগেই রাজার প্রাসাদ ছিল এখানটিতেই। লোক-লস্করে গমগম করছিল পুরো জায়গাটা। রানির মত একটা সিংহাসনে বসে হুকুমদারি করছিল তার বুড়ি বউ। 
সেসব কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে ভোজবাজির মত। আগের সেই ভাঙাচোরা মাটির একটা কুঁড়েঘর। তারই দাওয়ায় বসে সূতো কাটছে একটা বুড়িমানুষ। 
সম্বিত ফিরতে একটু সময় লাগল বুড়োটার। তখন হালকা একটু হাসি ফুটল তার মুখে। স্বস্তির হাসি।  
বুড়ি কিছু বুঝেছে কি না কে জানে! বুড়ো কিন্তু বুঝে গেল, যা পেয়েছো, তাতেই খুশি থাকো। চাঁদে হাত বাড়াতে নেই। তাতে পস্তাতে হয়। 

[ একটা প্রবাদও আছে রাশিয়ায়— “হাত বাড়ালে চাঁদে, / পড়বে নিজের ফাঁদে।“
সারা রাশিয়া দেশ জুড়ে প্রচারিত আছে রূপকথার এই গল্পটি। ভারি জনপ্রিয়ও। এটা তো কেবল গল্পই নয়। নীতিকথার মিষ্টি রূপকও। 

সোনালি মাছের রূপকথাটিকে নিয়ে ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছিল রাশিয়ায়। ১৯৭৫ সালে ২০ কোপেক দামের টিকিটটি প্রকাশ করেছিল সেসময়ের সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সরকার। 
(রাশিয়ার সরকারি মুদ্রা হোল রূবল। ১ রূবল = ১০০ কোপেক।)]


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

1 Comments

  1. স্বচ্ছন্দ অনুবাদ।

    ReplyDelete