জ্বলদর্চি

নাট্যকার চন্দন সেন | সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিনোদ মন্ডল

নাট্যকার চন্দন সেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিনোদ মন্ডল


প্রয়োগগুণের সমান্তরাল সাহিত্যগুণের রসাস্বাদী বাংলা নাটক সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে কয়েকজন নাট্যকারের নাম সহজেই উচ্চারিত হয়, তাঁদের অন্যতম অগ্রগণ্য -চন্দন সেন। মফস্সলের নাট্যদল চাকদহ হ য ব র ল'তে অভিনয় করতেন। মঞ্চের প্রয়োজনে কলম ধরলেন গত শতকের সাতের দশকে।

তাঁর প্রথম মৌলিক একাঙ্ক নাটক 'নিহত সংলাপ' (১৯৬৭)। প্রথম মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘দর্পণে ইতিহাস' (১৯৭৩)। চাকদহ হ য ব র ল গোষ্ঠীর প্রযোজনায় 'হে শঙ্খচিল', 'অলৌকিক আয়না', এবং ‘অনিকেত সন্ধ্যা' দুই বাংলায় তাঁকে নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। পরবর্তী কালে কলকাতার সায়কগোষ্ঠী এবং তার প্রয়োগশিল্পী মেঘনাদ ভট্টাচার্য্য দেশে-বিদেশে চন্দন সেনকে জনপ্রিয় ও স্মরণীয় মর্যাদায় স্থাপন করেছেন।

১১ জানুয়ারি ২০২৩-এ শ্রী চন্দন সেনের আশিতম জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনে সশ্রদ্ধ নমস্কার ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের লক্ষ্যে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হচ্ছে। দূরভাষের মাধ্যমে তাঁর সাথে আলাপচারিতায় মেতে উঠেছিলেন IPTA, কৃষ্টিসংসদ, মেদিনীপুরের একদা নাট্যকর্মী, সাহিত্যিক বিনোদ মন্ডল। বহু প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। দেশ-কাল-রাজনীতির পাশে উচ্চারিত হয়েছে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ নাট্যকার চন্দন সেনের ব্যক্তিজীবনের অনিবার্য প্রসঙ্গ। তারই সারাৎসার সংকলিত হলো জ্বলদর্চির উভয় মাধ্যমে!

চন্দন সেন।।
হ্যালো!

বিনোদ।। 
হ্যালো। নমস্কার। আমি বিনোদ মন্ডল। জ্বলদর্চি পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে প্রণাম জানাই । ভালো আছেন তো আপনি ?

চন্দন।। 
এই বয়সে কি আর ভালো থাকা যায় ? আমি আটাত্তর পার হয়ে উনআশি তে ৷

 বিনোদ ।। 
আপনার জন্মদিন ?

চন্দন।। 
১১ জানুয়ারি, ১৯৪৪!

বিনোদ।। 
ওরে বাবা! একেবারে উত্তাল চল্লিশে এসেছেন! আমাকে যদি আপনার জন্মস্থান, মানে শেকড়ের কথা দু'একটি বলেন!

চন্দন।। 
আমাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল পূর্ব বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রমপুর সাবডিভিশানের সোনারম গ্রামে। এই গ্রামে অমর্ত্য সেনের ঠাকুরদা পুলিনবিহারী সেন জন্মেছিলেন। জন্মেছি, মামাবাড়িতে। বরিশালে, বি.এন. কলেজের পাশে। বাবা-ডা. অমূল্য সেন। মা-জ্যোতিপ্রভা সেন ।

 বিনোদ।। 
পড়াশুনো নিয়ে কিছু বলুন।


চন্দন।।
সাতচল্লিশে কলকাতায় এসে রিফিউজি ক্যাম্পে উঠি। বাঁশদ্রোণীতে। পরে বাবা ডাক্তারিতে যোগ দেন। বেথুয়াডহরি কোয়ার্টারে চলে যাই, সবাই। সেখানেই প্রাথমিক পাঠ। বাবা নতুন হাসপাতাল-পলাশীর দায়িত্বে আসেন। আমার ভাই জহর সেন, এখন উত্তরপাড়ায় থাকেন ।

বিনোদ।।
আপনার মিসেস ? ছেলেমেয়েরা ?

চন্দন।।
আমার মিসেস কল্যাণী সেন। দুটি ছেলে। একজন অনির্বাণ। একজন অনিন্দ্য। অনির্বাণ ইয়ং নাট্যকার হিসেবে কাজ করছে। নাট্যদল-পারমিক। এই ব্যারাকপুরেই থাকে।

বিনোদ।।
কলেজে পড়ার কথা বলুন।

চন্দন।। 
কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে মালদা কলেজে গিয়ে ভর্তি হই। ইংরেজি অনার্স । বাংলা ইংরেজি এবং সংস্কৃত নিয়ে পড়েছি। তারপর আর মাস্টার্স করা হয়নি। পেশাজীবনে প্রবেশ করি। দিল্লীতে চলে যাই। আমার চেয়ে উনিশ বছরের বড়ো, বড়দির বাড়িতে। উদ্যোগ ভবনে যোগ দিই। লাইসেন্সিং বিভাগে। সেই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসি। নিউ আলিপুরে একটি স্কুলে জয়েন করি। পরে বিখ্যাত সাংবাদিক নারায়ণ বোসের তৈরী স্কুলে জয়েন করি। ততদিনে নাটকের
ভূত পুরোদমে ঘাড়ে চেপে বসেছে। অভিনয় করছি।

 বিনোদ।। 
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে কবে যুক্ত হন ? পুরস্কার?

চন্দন।। 
আশির দশকের শেষ থেকে যুক্ত। প্রথমে রাজ্য-সংগীত চারুকলা একাডেমিতে দু'বার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে সম্মানিত হই। পরে বাংলা আকাদেমি সম্মান (১৯৯৩)।

বিনোদ।। 
মেদিনীপুরে এসেছেন ? শ্রীজীব গোস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ?

 চন্দন।। 
হ্যাঁ বহুবার গেছি। এখন সব ভুলে গেছি। ছিল। যোগাযোগ ছিল।

বিনোদ।।
মেদিনীপুরের অনির্বাণকে কেমন লাগে আপনার ?

চন্দন।। 
ভালো। খুব ভালো। শুধু অভিনয়ে নয়, ওর যে প্রতিভা-যেমন একটা ফিল্ম তৈরী করেছে বাদল সরকারের নাটক থেকে, অসাধারণ।

বিনোদ।। 
বল্লভপুরের রূপকথা ?

চন্দন।। 
হ্যাঁ। বাদলদার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল। ওনার সব নাটক আমি দেখেছি।

 বিনোদ।।
 উৎপল দত্তের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল ? IPTA -র মেম্বার ছিলেন, কখনো ?

চন্দন।।
ভালো ছিল, খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। এখনো অল ইন্ডিয়া IPTA-র এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বার। তবে পশ্চিমবঙ্গের IPTA-র সঙ্গে যুক্ত নই। ২০২০ কলকাতা 'রঙ্গপট' পত্রিকায় আমার সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন। ওখানে সব দেওয়া আছে।

বিনোদ।।
পুতুল নাটক সম্পর্কে কিছু বলুন। হীরেণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল ? 

চন্দন।।
হ্যাঁ, আমার সাথে পরিচয় ছিল।
সারা পৃথিবীতে পাপেট নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় ব্যঙ্গ করার জন্য পাপেট নাটকে কাজ করা হচ্ছে।

বিনোদ।। 
যাত্রা মাধ্যম নিয়ে আপনার মতামত ?

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

চন্দন।।
একটা সময় ছিল যখন থিয়েটারের অগ্রগণ্য নাট্যকারদের কাছে যাত্রার লোকেরা আসতেন। যেমন বিভাস চক্রবর্তীর কাছে এসেছিলেন। উৎপল দত্ত তো যাত্রা করেছেন। নিজে দলও করেছেন। অরুণ মুখার্জীর কাছে এসেছিলেন। ঠিক তেমনি আমার কাছেও এসেছিল, নট্ট কোম্পানী। তার আগে লোকনাট্য এসেছিল। তখন আমি তাদের তিনটা যাত্রাপালা দিয়েছিলাম। নাম-টাম সব ভুলে গেছি। মাখনলাল নট্ট ডেকে বলেছিলেন, আপনি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু যাত্রাই লিখে যান। আপনার কোটি কোটি টাকা হবে। আমি তখন বললাম -- না, আমি প্রথম ভালোবেসেছি যে মেয়েটিকে তাকে ছেড়ে নতুন প্রেমিকা খুঁজব কেন ? আমার থিয়েটার নিয়েই ঘর করব।

বিনোদ।। 
এখন সেজন্য কোনো খেদ হয় ?

চন্দন।। 
কোনো খেদ হয় না। খেদ হয় না সেজন্যে, একসময় জন্মভূমি সিরিয়ালটা, আমাকে নিয়ে গেছিলেন, ইন্দর সেন, জন্মভূমি যখন খুব পপুলার, প্রথম ৭০-৭৫ টা এপিসোড, অধিকাংশই আমার লেখা ছিল। তখন আমায় তারা বলেছিল, সব ছেড়ে দিয়ে চলে আসুন, প্রতিদিন তিনটি করে সন্তান প্রসব করুন- কুড়ি মিনিটের... তাহলে কিছু লাগবে না... তো আমি এতো টাকা পেলাম তখন.... সব ক্ষেত্রেই আমাকে একটা প্রলোভন গ্রাস করতে এল। আমি বললাম সরি...

বিনোদ।। 
আপনাকে কখনো আনন্দবাজার চাকরি দিতে চায়নি ? 

চন্দন।।
আনন্দবাজারে একসময় লিখেছি। তারা আমাকে ডাক দেয়নি, কারণ তারা জানত,
আমি যাবনা কখনো।

বিনোদ ৷। 
আপনাকে এখন কোনো মিছিলে দেখা যায়না কেন ?

চন্দন।।
একসময় আমি মিছিলের সামনে থাকতাম। ষাটের দশক সেটা। যখন আমি ছাত্র আন্দোলন করি, মালদা কলেজে পড়বার সময় তখন ওখানে অন্য কেউ দাঁত ফোটাতে পারেনি।

বিনোদ।। 
কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ নেননি ?

 চন্দন।। 
নিয়েছি। সোমনাথ লাহিড়ী আমাকে মেম্বারশিপ দিয়েছিলেন। তখন তাঁর লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ। তারও আগে আমি নাটক করেছি চাকদহ হ য ব র ল' তে। এখনও আমি যার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছি। নাটক লেখার আগে অভিনয়ও করতাম। লিখতাম না। তখন করেছি... রাজনীতি। তখন আমি ঐ আদিবাসী সমাজকে সংগঠিত করে জমি দখল করেছি। আমি এখনও পর্যন্ত জীবিত নাট্যকার যে সর্বসাকুল্যে বারো-তেরো মাস জেল খেটেছি। ৬৫-৬৬ এরকম সময়ে। পার্টি ভাগ হয়ে গেছে। আমি তখন সি পি আই করি। সোমনাথ লাহিড়ী আমায় বললেন যে, দেখো, তুমি সি পি আই এমে, যেতেই পারো। তুমি যেরকম পপুলার...

বিনোদ।। 
তাহলে তো হীরেণ মুখার্জীর সঙ্গে আপনার ভালো যোগাযোগ ছিল। 

চন্দন।।
হ্যাঁ, যোগাযোগ ছিল। হীরেণ মুখার্জীর সঙ্গে ছিল, অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ছিল ... তারপর মেদিনীপুর জুড়ে যাঁরা ছিলেন সেনগুপ্ত (সুকুমার) থেকে শুরু করে যাঁরা ছিলেন, এমনকি যে সুশীল ধাড়া, বাংলা কংগ্রেসের; অজয় মুখার্জী, গীতা মুখার্জী, বিশ্বনাথ মুখার্জী তো আমার ঘনিষ্ঠতম লোক ... আমি তখন পার্টিরও স্টেট কাউন্সিল মেম্বার... নামকরা নেতা তখন আমি....

 বিনোদ।। 
তাহলে বুদ্ধবাবুর সঙ্গেও (ভট্টাচার্য) আপনার
সৌহার্দ্য ছিল- 

চন্দন।। 
বুদ্ধবাবু আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন, মূল্য দিতেন। তার জন্য হত কি, নাট্য আকাদেমির যখনই কোনও সঙ্কট হতো, তখনই সচিব থেকে শুরু করে সবাই আমাকে পাঠাত ... সঙ্কটে আমি সমাধান ছিলাম .....

বিনোদ।। 
পার্টিটাও করেছেন.... এসে সামাল দিতে পারতেন....

 চন্দন।।
তার জন্য নয়, আমাকে বলতেন যে আমি বুঝি যে, পার্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। মানে থিয়েটার, থিয়েটারটা যখন আমি লিখি তখন আমার সামনে যে লোকরা থাকে, তারা যে কোনো পার্টির লোক হতে পারে। আমি আজ পর্যন্ত একটা নাটকেও কোনো রাজনৈতিক দলের জয়গান গাইনি, কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার কথা নেই আমার কোনো নাটকে। আমি বলেছি যে, মানুষ তার রাস্তা দেখে নিক, আমি জীবনের যেটা ভালো যেটা মন্দ, সেটা বলছি...

বিনোদ।। 
তার মানে আপনার নাটক পাঁচশো বছর পরেও অভিনয় করবার চান্স আছে,
বাকিগুলোতে ইতিহাস হিসেবে এক আধটা শো হবে।

চন্দন।। 
সেই। তার ফলে, আমাকে দিয়ে কেউ কখনো লেখাতে পারেনি। মাঝে মাঝে পথ
- নাটকের আগে পরে প্রার্থীর হয়ে প্রচারে বক্তব্য রেখেছি।

বিনোদ।।
কবিতা পড়েন এখনো ? জীবনানন্দ ? চোখ সায় দেয় ?

চন্দন।।
না না। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। আমার মনে হয় যে, আসলে এই সমস্ত ব্যাপারটাই হচ্ছে পপুলিস্ট রাজনীতির অঙ্গ। পপুলিস্ট রাজনীতি মানে হচ্ছে যে, জনগণ যেভাবে যেটাকে খাবে, সেটাকে খাওয়ানো। পৃথিবীতে যারা ভালো নাটক লিখেছেন, ভালো কবিতা লিখেছেন, ভালো গান গেয়েছেন, তারা শুধুমাত্র জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য গাননি, তারা জনগণের সামনের দিনগুলোতে পথ দেখাবার রাস্তাটাও খুলে দিয়েছেন। এখন যেটা হচ্ছে... যেটা মানুষ চাইছে, সেটা মানুষ পাচ্ছে না, মানুষকে চাওয়ানো হচ্ছে অন্যভাবে, তার ফলটা হচ্ছে যে, রাজনীতি যদি এমন হয়, যে আমি ক'টা ভোট পাব, তার উপর নির্ভর করে আমার রাজনীতি করতে হবে, তাহলে সেখানে খুব বেশি ...

বিনোদ।।
এখন যেটুকু বাইরে যান, দেওয়ালে কখনও দুনিয়ার মজদুর এক হও, দেখা যায় না। এটাকে কি আপনি ক্রাইসিস মনে করেন ?

চন্দন।।
ক্রাইসিস তো বটেই। ক্রাইসিসটা হচ্ছে এটাই যে, যাদের সঙ্গে লড়াই করে আমরা একটা সময় আমাদের রাজনীতি শুরু করেছিলাম, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এখন লড়াই করতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে কথা বলে একসময় জেল খেটেছিলাম, অত্যাচার সহ্য করেছিলাম, এমনকি লাঠিচার্জও হয়েছিল, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এখন আমাদের ভোট সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এটা একটা অদৃষ্টের পরিহাস, তাদেরও, আমাদেরও। যারা রাজনীতির সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনে রয়েছে। তার চেয়ে বরঞ্চ এমন কিছু করা যেটা এই সময়ে দাঁড়িয়ে চিরায়ত কিছু সত্যের কথা বলবে।

এমন কিছু কথা বলবে, যাতে সত্যিকারের শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষের পক্ষে যায়। আর সেজন্যে যে কথাটা বলতে হয়, সে কথাটা ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে বললে অসুবিধা আছে। কারণ ভোট পাওয়ার কৌশলটা বদলে গেছে। ফ্যাসীবাদ যেমন বদলে গেছে, এখন আর আগের ফ্যাসীবাদ নেই; এখন যে ফ্যাসীবাদটা সেটা হচ্ছে... ধনতান্ত্রিক শক্তি নিয়ন্ত্রিত ফ্যাসীবাদ, অর্থাৎ যে ফ্যাসীবাদটার টোটালটাই একদল মানুষ যা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ফ্যাসীবাদ। ঐ ফ্যাসীবাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ফ্যাসীবাদ যেটা হিটলার বা মুসোলিনী করেছিলেন, সে ফ্যাসীবাদের মিল নেই। তার ফলে রেলিজিয়ানটা তার একটা অস্ত্র মাত্র ...

বিনোদ।।
বামপন্থীদের, এই রাজ্যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা আছে কী ? বিশেষ করে বিজেপি যেভাবে স্থায়ী ক্ষত তৈরী করছে...

চন্দন।।
এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। এটুকু মনে করি যে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা আসল লড়াই নয়। আসল লড়াইটা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার উৎসটা কোথায়, মানুষ সাম্প্রদায়িক হয় কখন ? মানুষ সাম্প্রদায়িক হয় তখনই, যখন কোনো একটা বড় সম্প্রদায়ের ভোটটাকে দখল করতে চায়। কিংবা অনেকগুলো ছোট সম্প্রদায়ের ভোটকে দখল করে নিয়ে ঐ বড় সম্প্রদায়ের ভোটের মধ্যে আবার ডিভিসান তৈরী করতে চায়। দুটো কৌশলই দেখা যাচ্ছে এখন। তার ফলে কৌশলী হয়ে কোনো ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না। সেজন্য একটা কঠোর আদর্শবাদ দরকার। যে আদর্শবাদ মানুষকে একে ভোট দিয়ো না, আমাকে ভোট দাও বলতে শেখাবে না। যে আদর্শবাদ সেই মানুষটাকে শিক্ষা দেবে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, তুমি তোমার বিচারটা করে নাও। আমাদের চৌত্রিশ বছরে অনেক প্লাস পয়েন্ট আছে- বামফ্রন্টের। বামশাসনের অনেক প্লাস পয়েন্ট। মাইনাস পয়েন্ট একটাই- মানুষের বৃহত্তর অংশকে আমরা শিক্ষা দিতে পারিনি যে তোমাদের শত্রুটা কারা এবং কীভাবে তোমরা সচেতন হতে পারবে ।

বিনোদ।। 
 আপনার শ্রুতিনাটক নিয়ে কিছু বলুন। অন্যান্য গ্রন্থ ...

চন্দন।।
আমার শ্রুতিনাটকের বইগুলো প্রচুর পপুলার। আমার মোট ৫৬ টি বই প্রকাশিত । আমার প্রথম নাটক বেরিয়েছিল দুই হুজুরের গপ্পো। এখনও জনপ্রিয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে দায়বদ্ধ নাটক। ষষ্ঠ এডিসান প্রকাশিত। সবই বড় বড় কোম্পানি। এম.সি. সরকার, মিত্র ও ঘোষ, দে'জ। তারপর নবগ্রন্থ কুটীর... বিদেশি নাটক তো আমার প্রচুর আছে, প্রচুর ... আমি এখনও পড়াশুনা করি। এখনও আমার মনে হয় যে, একটা জীবন যথেষ্ট নয় জ্ঞানের একবিন্দু আহরণের পক্ষে। 

বিনোদ।।
সাম্প্রতিক লেখালিখি নিয়ে কিছু বলুন।

চন্দন।।
এখন যে নাটকগুলোতে আমি হাত দিয়েছি, যেমন চারুলীলা, চারু মজুমদারের সঙ্গে লীলা সেনগুপ্তের প্রেম-প্রণয় পর্ব, তারপর চারু মজুমদারের বিপর্যয়, এটাকে নিয়ে নাটক, কিংবা ঈশ্বর গুপ্তের জীবন নিয়ে নাটক... কিংবা আমার একটা প্ল্যান হচ্ছে বাংলাদেশের- বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে আমার নাটক হয় না, আমি ফ্রান্সে গেছি, ইংল্যান্ডে গেছি, সেখানে বাঙালিরা আমার লেখা নাটক করে বলে গেছি... তার ফলে সেখানে গিয়েও দেখেছি, তারা দায়বদ্ধ নাটক, বা দুই হুজুরের গপ্পো নাটক বা আমেরিকা-কানাডায় আমার লেখা নাটক প্রায়ই অভিনয় হয়।  মেঘনাদ ভট্টাচার্য নিয়েও গেছেন...

বিনোদ।।
 আপনার রচিত নাটকের সংখ্যা কত ?

চন্দন।। 
কেউ বলেন দু’শো। কেউ বলেন একশো চুরানব্বই। আমাকে যদি কেউ বাছতে বলে, আমি হয়তো চার-পাঁচটা পড়ার মতো, এইটুকু বলতে পারব। ভালো বলতে পারব না। অনিকেত সন্ধ্যা প্রথম, আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে ওল্ড এজ হোমে যাওয়ার কনসেপ্টটাকে তুলে ধরেছিল। চার শ' রজনী অভিনয় হয়েছে। এখনো ভালো নাটক লেখার চেষ্টা করছি। ইলা মিত্রের উপর একটা নাটক লেখার পরিকল্পনা মাথার মধ্যে আছে।

বিনোদ।। 
ইলাদির সঙ্গে তো দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন।

চন্দন ।।
কাটিয়েছি শুধু নয়, তাঁর জন্মস্থানেও গেছি। সেখানে এখনো তার জন্মদিনে ছুটি দেওয়া হয়। এবং সেখানকার কৃষকরা বেরিয়ে এসে মিছিল করে, ছাত্ররা বেরিয়ে এসে মিছিল করে, তার ফলে সেটা একটা বড় ব্যাপার। ঠিক আছে এবার তাহলে আমি শেষ করি...

বিনোদ।।
ঠিক আছে।  আপনার শরীর ভালো আছে তো ?

চন্দন।। 
ঠিক আছে।

বিনোদ।। 
ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। আপনাকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের পক্ষ থেকে প্রণাম, শ্রদ্ধা জানাই ।

চন্দন।। 
একবার আপনাদের জঙ্গলমহলে যাবো, মৃত্যুর আগে..

বিনোদ।। 
আপনি আসতে চাইলে, স্বাগত। আপনি এলে আমরা আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করব। আমাদের বাচ্চাদের মধ্যে সপরিবারে এসে আনন্দে কাটিয়ে যেতে পারবেন। ভালো থাকবেন।


Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো শ্রদ্ধেয় নাট‍্যকার চন্দন সেনের সাক্ষাৎকার পরে। ভালো লাগলো কাউকে ছোট না করে রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ।

    ReplyDelete