জ্বলদর্চি

হরির চরণ /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫৯

হরির চরণ

ভাস্করব্রত পতি 

হরির চরণ লৌকিক উৎসবে (ব্রত) প্রয়োজন একটি তামার টাট, সাদা চন্দন, ধান, দুর্ব্বা এবং ফুল। বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে এই উৎসব পালিত হয়। কুমারী এবং সধবা নারী উভয়েই তা পালন করে। টানা চার বছর ধরে করলে ফললাভ হয়। 

প্রথমে তামার টাটে বেশ ভাল করে চন্দন মাখাতে হবে। এরপর আঙ্গুল দিয়ে ঐ টাটে বেশ ছোট ছোট দুখানা চরণ বা পা আঁকতে হয়। তারপর ফুল, দুৰ্ব্বা, ধান তার উপর নিবেদন করে মাঝের আঙ্গুল ও বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ধরে পূজার মন্ত্র বলতে হয়। কেউ কেউ অবশ্য মল্লিকা ফুল কিংবা তুলসীপাতা, তর্জনী, মধ্যমা আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ধরে যে মন্ত্রোচ্চারণ করে।

আসলে হরির চরণে নিজেকে নিবেদনের মাধ্যমে কুমারী নারীরা চায় তাঁদের জীবন হয়ে উঠুক মধুময়। আগামী ভবিষ্যতে তাঁদের গার্হস্থ্য জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কামনা করে লৌকিক ছড়ার মাধ্যমে ---
"হরির চরণ হরির পা
হরি বলেন – ওগো মা,
আজ কেন গো শীতল পা?
কোন্ যুবতী পূজে গা ?
সে যুবতী কি চায়?"
উত্তরে বলা হয়  ---
"রাজ্যেশ্বর স্বামী চায়, 
সভা উজ্জ্বল জামাই চায়। 
প্রেমানন্দ ভাই চায়, 
ঘরগৃহিণী বউ চায়। 
রূপবতী কন্যা চায়, 
দরবার জোড়া ব্যাটা চায়।"

এই ছড়াটির ভাষান্তর মেলে অন্যত্র। তা হল --
"হরির চরণ, হরির পা,
হরি বলেন ওগো মা, 
আজ কেন গো শীতল পা, 
কোন্ যুবতী পূজে পা 
সে যুবতী কি চায়? 
রাজ্যেশ্বর স্বামী চায়, 
দরবার জোড়া ব্যাটা চায়, 
সভা উজ্জ্বল জামাই চায়, 
প্রেমানন্দ ভাই চায়,
ঘরণী গৃহিণী বউ চায়
রূপবতী কন্যা চায়। 
আল্‌নায় কাপড় দল্‌মল্ করে।
ঘরের বাসন ঝকমক করে।।
গোয়ালে গরু, মরায়ে ধান,
বছর বছর পুত্র পান৷
না দেখেন স্বামী পুত্রের মরণ।
না দেখেন, বন্ধু বান্ধবের মরণ।
এক হাঁটু গঙ্গার জলে ম’রে,
পান যেন হরির চরণ।
হবে পুত্র, ম’রবে না।
চক্ষের জল প’ড়বে না৷
দিয়ে ছেলে স্বামীর কোলে
মরণ যেন হয়,
এক গলা গঙ্গাজলে।"

এই ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের আরেকটি যে মন্ত্র উচ্চারিত হয় তা হল --
"চন্দনে ডুবু ডুবু হরির পা। 
হরি বলেন — মা গো মা।
আজ কেন আমার শীতল পা।।
মা বলেন —
কোন্ সতী ভাগ্যবতী
সেই পূজেছেন তোমার পা৷৷
সে কি বর চায় —
আপনাকে সুন্দর চায়, রাজরাজেশ্বর স্বামী চায়। 
গুণবতী ঝি চায়, সভা উজ্জ্বল জামাই চায়৷
অমর বরপুত্র চায়, গিরিরাজ বাপ চায়।
মেনকার মতো মা চায়, দুর্গার মতো আদর চায়।
রামের মতো পতি,
সীতার মতো সতী,
আলনা ভরা কাপড়, মরাই ভরা ধান,
গোয়াল ভরা গোরু, পাল ভরা মোষ,
পায়ে আলতা মুখে পান,
পট্টবস্ত্র পরিধান।
সূক্ষ্ম মল্লিকার ফুলে পূজব হরি গঙ্গাজলে,
থাকব হরির চরণতলে।
উযোতে পারি তো ইন্দ্রের শচী,
না পারি তো শ্রীকৃষ্ণের দাসী।
স্বামীর কোলে পুত্র দোলে,
মরণ হয় যেন একগলা গঙ্গাজলে৷"

এইভাবে তিনবার মন্ত্রোচ্চারণ করে পূজা করতে হয়। তারপর পূজার ফুল, দূর্ব্বা জলে অর্পণ করার রেওয়াজ রয়েছে। হরির চরণ উদ্‌যাপনের সময় সোনার, রূপা ও তামার তিন জোড়া চরণ গড়ে পূজা করার বিধান। তিনজন ব্রাম্ভণকে যথাসাধ্য খাইয়ে সবশেষে তাঁদের এই ধাতুর 'চরণ'গুলি দান করতে হয়। তবে যদি ব্রতীনীর পক্ষে সোনা রূপা বা তামার চরণ জোড়া দেওয়া সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে ব্রাম্ভণকে অর্থ দিয়ে পুষিয়ে দিতে হয়। সেইসাথে তাঁদের কাপড় এবং গামছা দক্ষিণা স্বরূপ দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

সাংসারিক সুখ সমৃদ্ধি শান্তি ও শৃঙ্খলার কামনায় এই হরির চরণ ব্রত পালিত হয়। লৌকিক ছড়া তথা লৌকিক মন্ত্রতেও তার প্রকাশ দেখা যায়। ছড়াতেই পাই --
"হরি হরি বৈশাখ মাস
কোন শাস্ত্রে পড়লো মাস?
চন্দনে ডুবু ডুবু হরির পা,
হরি বলেন মা গো মা।
আজ কেন আমার শীতল পা?
কোন ভক্ত পূজে পা?
সে ভক্ত কি বর মাগে ?
আপনাকে সুন্দর চায়,
রাজরাজেশ্বর স্বামী চায়,
গিরিরাজ বাপ চায়
মেনকার মতো মা চায়,
দুর্গার মতো আদর চায়,
অমর বরপুত্র চায়,
সভা উজ্জ্বল জামাই চায়,
নিত্যানন্দ ভাই চায়,
রূপবতী বৌ চায়,
গুণবতী ঝি চায়,
লক্ষ্মণের মতো দেবর চায়,
সুশীলা ননদ চায়,
রামের মতো পতি,
সীতার মতো সতী,
দাস চায়, দাসী চায়,
রূপার খাটে পা মেলাতে চায়,
আলনাভরা কাপড়,
মরাইভরা ধান,
গোয়ালভরা গরু,
পালভরা মেষ,
পায়ে আলতা মুখে পান,
পট্টবস্ত্র পরিধান,
সূক্ষ্ম মল্লিকার ফুলে পূজব হরি গঙ্গাজলে থাকব হরির চরণতলে।
উযোতে পারি ত ইন্দ্রের শচী না পারি ত কৃষ্ণের দাসী।
সিঁথেয় সিন্দুর কপালে টিপ, বছর বছর পুত্র বাড়ুক।
হবে পুত্র মরবে না, চক্ষের জল পড়বে না,
স্বামীর কোলে পুত্র দোলে, মরণ যেন হয় একগলা গঙ্গাজলে।"

তবে এই ব্রতে পতিব্রতা স্ত্রী ও বাৎসল্যময়ী তথা মমতাময়ী মায়ের প্রাণের পরম লালিত্যের বাতাবরণে এক ঐকান্তিক চাওয়া ও কামনার খোঁজও মেলে --
"না দেখেন স্বামী-পুত্রের মরণ।
না দেখেন বন্ধু-বান্ধবের মরণ।
দিয়ে পুত্র স্বামীর কোলে।
মরণ হয় যেন গঙ্গাজলে।"

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments