জ্বলদর্চি

যেসব কথা লেখা হয় না /পর্ব- ৯/সুমনা সাহা


যেসব কথা লেখা হয় না 

পর্ব- ৯

সুমনা সাহা


শৈশবে দেখা প্রথম মৃত্যু ঠাকুরদার চলে যাওয়া। ঠাকুরদার আদর পাইনি, জন্মে ইস্তক দেখে এসেছি বিছানায় শোওয়া এক বুড়ো, কাশছে আর গোলমাল শুনলেই গালাগালি করছে। তাই টান কিছুই তৈরি হয়নি। কিন্তু যখন চলে গেল, একটা বিরাট শূন্যতা অনুভব করেছিলাম। ঐ খাটটা ফাঁকা, ওখানে আর কেউ শুয়ে থাকে না। জীবনে প্রথমবার বাবাকে হাউ হাউ করে কাঁদতে দেখলাম। বাবা মানে সর্বশক্তিমান এমন একটা ধারণা ছিল। সেই বাবা এমন করে ছোট বাচ্চার মত কাঁদছে! সে এক বিরাট বিস্ময়। বাবা ছাদে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বেলে মাটির মালসায় আতপ চালের ভাত ফুটিয়ে হবিষ্যি করত। দাদা বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। সেটা আমাদের কাছে বনভোজনের মত একটা থ্রিলিং ব্যাপার ছিল। খাওয়ার পরে খালি গায়ে ধুতি পরে দুজনে পুকুরে যেত মালসাগুলো ফেলে দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসত। প্রতিদিন নতুন মালসায় রান্না। আমরা মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ওরা কতদিন এরকম আলাদা রান্না করে খাবে? মা ‘বারো দিন’ বলায় আমরা চুপি চুপি ছাদে গিয়ে এক কোণে রাখা মালসা গুণে দেখে এসেছিলাম, বারোর বেশি আছে। তখনই বাকিগুলো রান্নাবাটি খেলায় নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলাম। মনে আছে বাবা প্রথম ভয়াল মূর্তি ধারণ করে ‘ফাজলামি হচ্ছে?’ বলে আমাদের দিকে তেড়ে এসেছিল। এমন আঘাত জীবনে খুব কমই পেয়েছি। মা বুঝিয়েছিল, “ওরে তোদের যেমন বাবু, ওরও তো বাবু। চলে গেল, আর ফিরে আসবে না, কষ্ট হয় না? কদিন যাক, দেখবি বাবু আবার আগের মত আদর করবে।” মা আরও বলেছিল, “তোরা তো এমন শুয়ে থাকা দেখেছিস মানুষটাকে, খুব ভালমানুষ ছিলেন। রংপুরের জমিদার বাড়িতে সেরেস্তায় হিসেবের খাতা দেখার কাজ করতেন। আর অবসরে পুজো করতেন। অনেক যজমান বাড়ি ধরা ছিল। তাঁরা দেবতার মত শ্রদ্ধা করত ওনাকে। খুব ভাল চণ্ডীপাঠ করতেন তো? তোর বাবু ছিল ওর নয়নের মণি।” 


🍂
ad

আমরা জানতাম বাবারা দুই ভাই। জেঠুকে দেখিনি। দিল্লিতে থাকে জানতাম। তাই প্রশ্ন করলাম, “আর জেঠু?”

--জেঠুকে তো দিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুমার বোনকে।

--কেন মা?

--ঠাকুমার বোনের বাচ্চা কাচ্চা হয়নি যে। তার বর, মানে তোদের ঠাকুরদার ভায়রা ভাই হন যিনি, তিনি ছিলেন ঠাকুরদার প্রাণের বন্ধু। তোরা তাকে দেখিসনি। তোর জন্মের আগে সেই মেসোমশাই মারা গিয়েছিলেন। সেই বন্ধুকে কথা দিয়েছিল, প্রথম সন্তান হলে তাকে দেবেন। আগেকার দিনের লোকেদের কথার দাম ছিল খুব। তাই জেঠুকে দিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে ছোটছেলে, মানে তোর বাবুকে চোখে হারাত ওরা। পরে আরও চারটে মেয়ে হল। কিন্তু মনা অন্ত প্রাণ! ঠাকুমা সারাদিন ‘মনা, মনা কোথায় গেল?’ একটু দূরে কোথাও গেলে অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করত। আর তোর বাবু ছিল ভীষণ স্বাধীনচেতা। আর অ্যাডভেঞ্চারাস। কোথায় কোথায় চলে যেত, বাড়ি ফিরলে দাদু প্রচণ্ড মারত। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ার এক পরিবারের সঙ্গে ইন্ডিয়া চলে এল। তখন থেকেই তো তোদের ঠাকুমার মাথাটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। কারু সাথে কথা বলত না। আপন মনে কি বিড় বিড় করত। আসলে প্রথম সন্তানকে মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেওয়াটা মেসোমশাইয়ের উচিৎ হয়নি। লোকটাকে আমার একদম ভাল লাগত না। আমাকে কিন্তু উনি খুব পছন্দ করতেন। তন্ত্র মন্ত্র জানতেন। 

--তুমি ওই মেসোমশাইকে চিনলে কি করে?

--তোর দাদু যখন বাংলাদেশ থেকে চলে এলেন, উনিও চলে এসেছিলেন। তোর জেঠুকে না দেখে থাকতে পারতেন না। 

--জেঠুও কি চলে এসেছিল তাহেরপুরে? আর ঠাকুমার সেই বোন?

--শুনেছি অসুখে ভুগে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন ঠাকুমার বোন। উনি মারা যাওয়ার পর তোর জেঠু আবার নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল। তাই মেসোমশাই আমাদের সঙ্গে তাহেরপুরেই থাকতেন, বৌ মরে গেল, জেঠুকে তো নিজে হাতে মানুষ করেছেন। সেও চলে গেছে, উনি আর একা পড়ে থেকে কি করবেন? তাই জেঠুর টানে, আর বন্ধুর টানে আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। জেঠু ওনার ট্রেনিং-এ অনেক ম্যানারস শিখেছিল, দেখবি তোর বাবু আর পিসিদের থেকে জেঠুর কথাবার্তা ব্যবহার সব কিছু একদম আলাদা।” 


শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হয়েছিল প্যান্ডেল করে। অনেক লোক এসেছিল। সেসব কিচ্ছু মনে নেই। দাদুর অস্থি একটা সাদা পুঁটুলিতে ভরে রেখে দেওয়া হয়েছিল ডাইনিং কাম ড্রইং রুমের দেওয়ালের এক অংশে একটা টঙ ছিল, সেইখানে। জেঠু এলে বাবা আর জেঠু সেটা একসঙ্গে গঙ্গায় দেবে। একদিন রাত্রে বাথরুম যেতে গিয়ে ববি-পিসির বিকট চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বেলে সবাই উঠল কি হয়েছে দেখার জন্য। পিসিমণি তখন বুকে হাত দিয়ে বিস্ফারিত চোখে বিছানায় বসে আছে। মা জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে রে? অমন চেঁচালি কেন?”

পিসিমণি সেই টঙের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওইখানে দুটো চোখ জ্বলছে, আমি স্পষ্ট দেখলাম!” মা বলল, “ভুল দেখেছিস।”

“না ছোট বৌদি, আমি সত্যি দেখেছি!” 

মা আবার বলল, “বিড়ালের চোখ দেখেছিস নির্ঘাত।”

“মেনী? ও তো তোমার ঘরে খাটের নিচে শোয় ছানাপোনা নিয়ে। ও ওখানে উঠতে যাবে কেন?”

মা তবু বলল, “গ্যাছে, বাচ্চাগুলো সারারাত বিরক্ত করে, হয়তো ওখানে উঠে একটু শান্তিতে ঘুমাবে ভেবেছিল, তুই এমন চিল্লালি, বেচারা পালিয়ে বাঁচে না।”

“কোথায়? আমি তো মেনীকে যেতে দেখিনি।”

বাবা গম্ভীর হয়ে বলল, “এত রাত্রে তোমরা আর গোলমাল কোরো না। শুয়ে পড়ো।” 

পরে চুপি চুপি মাকে বলল, “ববি তো জানে না ওখানে বাবার অস্থি রাখা আছে। ওকে বলিনি, যা ভয়কাতুরে। মনে হয় বাবা নিজের অস্থি পাহাড়া দিচ্ছে।”

মা বলল, “তুমি জাইমুকে তাড়াতাড়ি আসতে লিখে দাও।” 

এরপরেই জেঠু এল। দাদুর মৃত্যুকে উপলক্ষ করে বাড়িতে অনেক লোক এসেছিল। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে একজনের উপস্থিতি আমাদের খুব ভাল লেগেছিল। তিনি আমাদের জেঠু। আমার দু’বছর বয়সের সময়ই তিনি তাহেরপুরের সংসার ছেড়ে জেঠিমা আর এক দিদি, আর বড়দা ছাড়া আরও তিন দাদাকে নিয়ে দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। ফলে জেঠুর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়নি। অতি মধুর তাঁর কথা বলার ভঙ্গি আর প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর আচরণ ভারি কোমল। দেহের গঠনে মিল থাকলেও জেঠু বাবার থেকে অনেকখানি আলাদা।


সবকিছু মিটে গেলে জেঠু ফিরে গেল দিল্লিতে। দাদাকে নিজের সঙ্গে করে কিছুদিনের জন্য নিয়ে গেল। বাড়িটা খুব ফাঁকা হয়ে গেল। একদিন লোক ডাকিয়ে দাদুর খাট খুলিয়ে বাবা সেই জায়গায় একটা নতুন খাট আনল। সেইখানে আমরা সন্ধ্যাবেলা কারেন্ট চলে গেলে হারিকেন জ্বেলে পড়তে বসতাম। সেই খাটে বসেই প্রাইভেট টিউটররাও পড়াতেন। যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া আরম্ভ হল, গানের মাস্টারমশাই, নিখিল কাকু, ওই খাটে বসেই আমাদের দুই বোনকে গান শেখাতেন। প্রথম হারমোনিয়াম বাজিয়ে শেখা গান—‘আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান!’ ওই খাটের উপর কত ছুটির দুপুর উপুড় হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়তাম! দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুমার ঝুলি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুড়ো আংলা, ক্ষীরের পুতুল, নালক, বাপ্পাদিত্য, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা, শরতচন্দ্রের বড়দিদি পড়তাম। শুকতারা, আনন্দমেলা, চাদমামাও থাকত। আরেকটু বড় হতে ‘দেশ’ পড়া ধরেছিলাম লুকিয়ে। আর পড়তাম রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। পড়তে পড়তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত, আমি উদাস ভাবে তাকিয়ে থাকতাম দূরের পুকুরটার দিকে, যার ওপাড়েই ছিল একটা রাজবাড়ি। পুরনো, ভাঙাচোরা হলেও সেটা রাজবাড়িই বটে। মোটা মোটা থামওয়ালা, ঝুল-বারান্দাওয়ালা একটা সত্যিকারের গম্ভীর রাজবাড়ি। যখন বৃষ্টি পড়ত জোরে, দূরের রাজবাড়ি ঝাপসা হয়ে যেত, আমরা আবৃত্তি করতাম, 

“চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই, 

তেপান্তরের পার বুঝি ঐ,

মনে ভাবি ঐখানেতেই

আছে রাজার বাড়ি।

থাকত যদি মেঘে-ওড়া

পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া

তক্‌খুনি যে যেতেম তারে

 লাগাম দিয়ে কষে।

যেতে যেতে নদীর তীরে

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে

পথ শুধিয়ে নিতেম আমি

 গাছের তলায় বসে।”

আমরা বিশ্বাস করতাম, ওই বাড়ির ভিতরে গুপ্ত কক্ষে এক রাজকন্যা আছে। নিচে দাঁড়িয়ে অনেকবার ছড়া বলেছি—“কেশবতী কন্যা এবার নামাও তোমার চুল/সেই চুল বেয়ে উঠব আমি হয় না যেন ভুল!” কিন্তু জানলা দিয়ে চুলের ঢল নামিয়ে দেওয়া দূরের কথা, কোনদিন কেউ উঁকিও দেয়নি। এখন জানি, ওটাই ছিল ঠাকুবাড়ির ‘গুপ্তনিবাস’। একটি ছেলে, সম্ভবত ওই পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, সে মাঝে মাঝে এসে থাকত ঐ বাড়িতে। গেটে দারোয়ান থাকত। ভিতরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। ছেলেটির গায়ের রঙ সাহেবের মত ধবধবে ফরসা, সুন্দর চেহারা। পরে দাদারা ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল। 

দাদুর একটা টিনের তোরঙ্গ ছিল, তালা দেওয়া, আগেই বলেছি যার কথা। ভাবতাম ওর মধ্যে গুপ্তধন আছে। দাদু চলে যাওয়ার পর একদিন সেটার তালা খোলা হল। ভিতরে অনেক কাঁসা পিতলের নাম লেখা বাসন ছিল। ভারি ভারি পিতলের গ্লাস, সোনার মত কাঁসার থালায় লেখা ‘শুভ অন্নপ্রাশন’, বড় বড় কাঁসার জামবাটিতে লেখা ‘শুভ জন্মদিন’ এমন সব। পাথরের থালা গ্লাসও ছিল। পরে লক্ষ্মীপুজোর সময় দেখতাম মা ওই পাথরের থালায় ভোগ নিবেদন করত। সাদা পাথরের থালায় নারায়ণের নিরামিশ ভোগ আর কালো পাথরের থালায় ইলিশ মাছ ভাজা সহ লক্ষ্মীর আমিশ ভোগ। আর বেরলো অনেক লাল কাপড়ে মুড়ে রাখা বই। শ্রীশ্রীচণ্ডী, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ভাগবত, চৈতন্য চরিতামৃত। একদিন দুপুরবেলা বাড়ি নিশুতি হলে আমি তালা খোলা ঠাকুরদার টিনের তোরঙ্গ থেকে বের করলাম হলদে হয়ে যাওয়া ঝুরঝুরে পৃষ্ঠার সেইসব বই। ‘ক্রাং ক্রিং ক্রুং’ কিছুই না বুঝে শুধু অক্ষর পড়ার তীব্র আনন্দে সব পড়েছি। বেহুলা লক্ষিন্দর আর চাঁদ স’দাগরের গল্প, ফুল্লরার বারোমাস্যা পড়ে একা একা কাঁদতাম। তারপর একদিন ঠাকুরদার তোরঙ্গের রহস্য ফুরিয়ে গেল। মা-র সিলেবাসের বইগুলো হল আমার অবসর পাঠ্য। সারাদিন মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াত ‘পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা, শেষে দিল রা, পাগল ছাড়ো পা।/তেঁতুল-বটের কোলে, দক্ষিণে যাও চলে/ঈশান কোণে ঈশানী, কয়ে দিলাম নিশানী।” সেই ধারাগোল গ্রামে পৌঁছে যেতাম কল্পনায়। মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে আমিও বন্দি হয়ে পড়ে থাকতাম সেই গোপন পাতালঘরে আর বিড়বিড় করতাম, ‘আমি আর কিছুই চাই না— আমি এই সুরঙ্গ হইতে, অন্ধকার হইতে, গোলকধাঁধা হইতে, এই সোনার গারদ হইতে, বাহির হইতে চাই। আমি আলোক চাই, আকাশ চাই, মুক্তি চাই।’ এই লাইনগুলো আবৃত্তি করতে এত ভাল লাগত, যেন সুস্বাদু কোন চকলেটের স্বাদ মুখের ভিতরে। আরও যেগুলো সেই বয়সে দাগ কেটে বসে গিয়েছিল মনের মধ্যে, তার মধ্যে বলাই, সুভা, অগ্রদানী, এদের কথা মনে পড়ে। 

এর মধ্যে আমাদের ছোটবেলা আলোড়িত করে তুলল একটি ঘটনা, রঞ্জু-মাসির ‘লভ-ম্যারেজ!’ সে এক ভয়ানক নিষিদ্ধ কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে রঞ্জু-মাসি। একটা নাকি ‘বেজাতের ছেলে’-র সঙ্গে পালিয়ে গেছে। সেজ-মামার বাড়িতে গেলে দাদুর গলা ফাটানো হুঙ্কার, ‘আসুক একবার। অই পোলারে আমি ফাইড়ে ফ্যালামু’ শুনে বুঝতে পারতাম একটা অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে। ততদিনে দাদু বাংলাদেশ থেকে দমদমের মামাবাড়িতে চলে এসেছে। একটা খাটের উপর গ্যাঁট হয়ে বসে থাকত, ধবধবে ফরসা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, মুখে সুগন্ধি জর্দা দেওয়া পান, আর মাঝে মাঝেই নানা রসিকতায় অট্টহাসি হেসে ওঠা। দাদা নাম দিয়েছিল ‘ভোটকা দাদু’। ঠাকুরদা ছিল রোগাপটকা। এই দাদু মোটাসোটা। কখনো কখনও সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পড়ে হাতে একটা ওয়াকিং স্টিক নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত। পাড়ার সবাই চেয়ে থাকত এত সুপুরুষ ছিল দাদু। কোনও এক জমিদারের দেওয়ান ছিল শুনেছি। রঞ্জু-মাসি কোথায় গেছে, সে নাকি কেউ জানে না। স্কুল থেকে ফেরার পথেই পালিয়েছে। রঞ্জু-মাসির বন্ধুরা বলল, ছেলেটা নাকি ‘নমো’, অনেকদিন ধরে রঞ্জু-মাসিকে দেখার জন্য স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত আর সাইকেলে চেপে পিছন পিছন আসত। গানের সুর শিস দিয়ে গাইত, ‘মেরি স্বপ্নো কি রানী কব আয়েগি তু!’ আর ছেলেটাকে নাকি দেখতে একদম ভাল নয়, সে রঞ্জুর চেয়ে বেঁটে! বড় হয়ে জানলাম, আসলে ‘নমো’রা নমস্কারের যোগ্য নয়, তারা বর্ণে শূদ্র, ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে সে ঘোরতর একটি অপরাধ করেছে। 

(ক্রমশ) 

Post a Comment

0 Comments