জ্বলদর্চি

দেশান্তরী গল্প-৭/হিল্লোল রায়


দেশান্তরী গল্প-৭

হিল্লোল রায়

লালফিতার ফাঁসেদরখাস্ত মোর হাসে

সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে খুশী মনে দারোয়ানকে চারআনা বকশিশ দিলাম চা খাওয়ার নাম করেবেচারা ও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল পয়সাটা হাতে নিয়ে। অধ্যক্ষের সই হবার পর এলাম বি.কলেজ এগজামিনেশান অফিসে। অফিস কর্মীদের “গুরুত্বপূর্ণ” আলোচনায় ক্ষণিক বিরতি ঘটিয়ে ফর্মটার অফিস কপি রাখতে বল্লাম। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নিত্যানন্দবাবু (এগজামিনেশান অফিস স্ট্যাম্প বি.কলেজ) memo number দিলেন 267/exam, 24.6.74 চিরাচরিত “থ্যাঙ্ক ইউ” বলে বেরিয়ে ওখান থেকে এবার যেতে হবে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি অফিসে।

বেলা তখন একটা। দুটোর মধ্যে আবার ক্যাশ সেকশন বন্ধ হয়ে যায়। বি..কলেজ থেকে একটা নাগাদ বেরিয়ে ৫৫নং বাসে হাওড়া স্টেশন ও সেখান থেকে ৪৪নং বাস ধরে এসে কলেজ স্ট্রীট নামলাম ১-৪৫ নাগাদ। ছুটতে ছুটতে গিয়ে ফর্ম ও টাকা(১০টাকাজমা দিলাম। আমার ক্যাশমেমো নম্বর হল ১৩৬২৪..৭৪। আর্জেন্ট ফি দশটাকাঅর্ডিনারী ৫ টাকাপ্রয়োজনের তাগিদে দশটাকা দিয়েই কাজ গোছাবার চেষ্টায় রইলাম। সময়ের মূল্যর চেয়ে তখন টাকার মূল্য অনেক কম।

সহজে কোন কাজ সুষ্ঠূভাবে সাধন করা যাবে ভারতবর্ষে থেকে এ ধারণা করা নিতান্তই পাপ। সরকারী অফিস থেকে লালফিতার ফাঁস সহজে আলগা করবে কার সাধ্য আছে। টাকা-ফর্ম-২৪ জুন১৯৭৪ জমা দিলাম ঠিকই। Urgent fee 10/- টাকা দিলাম এক সপ্তাহের মধ্যে পাব বলে। এক সপ্তাহ এমন কি দু সপ্তাহ কেটে গেল তবু সার্টিফিকেট পেলাম না।

বি..কলেজেও খোঁজখবর নিচ্ছি। আমার আর্গোসির ঠিকানায় ও কোন চিঠিপত্র পেলাম না। বুঝলাম আমার ফর্ম লালফিতার খপ্পরে পড়েছে। দৌড়ঝাঁপ না করলে চলবে না। আমি আদাজল খেয়ে লেগে গেলাম পরিণতি দেখতে।

হাবড়া -শিয়ালদা আসতে রোজ টিকিট করতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ১৫ টাকা ৫৫ পয়সা দিয়ে হাবড়া -শিয়ালদা মান্থলি টিকিট করে নিলাম জুন ২৪১৯৭৪ তারিখে। পুরানো নথিপত্র ঘেঁটে মার্কসীট দেখে আমায় একটা বি.প্রভিশনাল সার্টিফিকেট দেবে-এটা হল ঢিমে তালের কাজ।

আমিও চেনাশোনা লোকের সন্ধানে রইলাম যাকে তেল দিয়ে সার্টিফিকেটটা বার করা যাবে। যেমন আইডিয়াতে্মনি কাজ। খোঁজ নিয়ে জানলামযে ভদ্রলোক এই সার্টিফিকেট সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে কাজ করেন তিনি দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছাকাছি থাকেনআর আমি হাবড়ায় অর্থাৎ আমরা দুজনে শিয়ালদা-বনগাঁ রেলওয়ে সেকশনে। সেই ভদ্রলোককে 'গ্যাস খাইয়েলাইনে আনতে আমাকে বেশ মেহনত করতে হয়েছিল। রোজই একবার করে তাঁর দর্শন নেওয়া আমার অত্যাবশ্যকীয় কাজ হয়ে উঠল।


শুধুমাত্র দর্শন নিলেই ত হয় নাসেই সংগে দর্শন-দক্ষিণাও দেওয়া প্রয়োজন। সে প্রস্তাবে আমি রাজী। কিন্তু আামার এ পর্য্যন্ত জীবনে টাকা-পয়সা দিয়ে কোন কাজ হাতড়াতে হয় নি। নিজের প্রত্যেকটা 'পয়েন্টসযখন 'ফার্ম এ্যন্ড জেন্যুইনতখন দক্ষিনা দিয়ে কোন কাজ আদায় করবার কোন মনোবৃত্তি ছিল না। কিংবা অভিজ্ঞতা ও নেই। তাই কোন মুহূর্তে কিভাবে দক্ষিণা দান করব তার ফাঁ খুঁজছিলাম। অবশেযে এই ফাঁক খুঁজতে আমাকে বেশী বেগ পেতে হয় নি। দৈবিক যোগাযোগ বলা যেতে পারে। ঘটনাটা সংক্ষেপে বলি।

আমার বড়মামার মেয়ে পিংকুর (ভাল নাম শ্রীপর্ণাবছর পাঁচেক বয়সজন্মদিন হল জুন ২৬১৯৬৯ জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভুরিভোজের আয়োজন করা হয় কলকাতার বাড়ীতে ২৬ জুন ১৯৭৪। হাবড়া থেকে সেদিন দুপুর ২-৪৫ নাগাদ রওনা হয়ে প্রেজেণ্টেশ্যান কিনে বড়মামার কলকাতা-৩৭(বেলগাছিয়াএ বাড়ীতে উঠলাম সন্ধ্যা ৬ টায়। খাওয়া-দাওয়াগল্পগুজব ইত্যাদির মধ্যে সময় কাটছিল।

বড়মামিমা (শ্রীলেখা নিয়োগীআমার ইমিগ্রেশ্যানের ব্যাপারে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে খোঁজখবর নিচ্ছেন। কথায় কথায় আমি বলে ফেললাম, “ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে আপনার চেনাশোনা কেউ আছেন?”

-হ্যাঁ আছেতবে আমি যখন পড়তাম তখন রাখালদা নামে এক ভদ্রলোক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের ঘরে বসতেন। সার্টিফিকেট স্ংক্রান্ত ব্যাপারে উনি কতটা হেল্প করতে পারবেন জানি নাতবে ওঁর ইনফ্লুয়েন্স আছে। ওকে গিয়ে একবার খোঁজ কর আমার নাম বলে। বড়মামিমার আলোচনায় একটা ক্লু পেলাম বলে মনে হল। বেশ ভালই হল।

দেখতে গিয়ে রাখাল-দাকেপড়নু শত প্রশ্ন ফাঁকে

ক্লু মাফিক কাজ করবার প্রচেষ্টায় আমি তখন ব্যস্ত। জন্মদিনের খানাপিনার পরদিন অর্থাৎ ২১ জুন১৯৭৪ বৃহস্পতিবার (বাংলা ১৩ই আষাঢ়১৩৮১ সালখুব সকালে ৫-৫৫ মিনিটে বেলগাছিয়ায় বড়মামার বাড়ীতে গাত্রোত্থান করলাম। স্নানাহার সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গেলাম চার নম্বর ব্র্যাবোর্ণ রোডকলকাতা-এক এ অবস্থিত রিজিয়ন্যাল পাশপোর্ট অফিস ব্ল্যাংক পাশপোর্ট এ্যাপ্লিকেশান ফর্ম আনতে বেলা দশটায় ফর্ম নিয়ে এবার আমার লক্ষ্য 'রাখালদা'র সন্ধানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভাইস চ্যান্সেলর ডঃ পূর্ণেন্দু বসুর ঘর। 'রাখাল'দার সন্ধান সূত্র বার করতে ভীষণ লজ্জায় পড়েছিলাম। সেই ঘটনাটার কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়া প্রয়োজন মনে করি।


চ্যান্সেলরপ্রো-ভাইস চ্যান্সেলররেজিস্ট্রার-এদের সাক্ষাৎ পাওয়া যে কত পূণ্যের ফল তা ভগবানই জানেন। বি.., বি.কম পার্ট 'টু', পরীক্ষায় প্রচুর ছাত্রছাত্রী ফেল করায় উপরোক্ত ভদ্রলোকত্রয়ের চেম্বারে ঢুকবার প্রচেষ্টায় মারমুখী উত্তেজিত ছাত্রছাত্রীরা জটলা করছিল। ঘেরাও করে রেখেছিল। বুঝলাম আমার 'ক্লুমাফিক কাজ আজ আর হল না। 'রাখাল'দার সন্ধান ও সাক্ষাৎ আজকের মতই স্থগিত রাখি। কিন্তু 'লাক ফেভারকরায় রাখালদার সাক্ষাতের পথ পরিস্কা্র হয়ে গেল। জনৈক ছাত্রদরদী নেতার (মন্ত্রীও বটেনপশ্চিমবঙ্গেরআহবানে ঘেরাও প্রত্যাহৃত হল। মুহূর্তের মধ্যেই সমস্ত জটলা পরিস্কার। সেই সঙ্গে পরিষ্কার আমার রাস্তাও।


উত্তেজনার থমথমে ভাবটা তখনও কাটে নি। দ্বারভাংগা বিল্ডিংয়ের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের হোতা ইট-কাঠ-পাথরগুলোতে ও তখন যেন উত্তেজনার গুঞ্জন মাথা কুটে মরছে। ভি.সি(ভাইস চ্যান্সেলরের সংক্ষিপ্ত রূপ), প্রো-ভি.সি., রেজিস্ট্রার ও তাদের চেম্বারে উপস্থিত অন্যান্যরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। কলকাতা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের দ্বারভাংগা বিল্ডিংয়ের দোতলায় ওঁদের চেম্বার। দুটো-তিনটে কোলাপ্সবিল গেট টপকে যাওয়ার পর ভদ্রলোকদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। দারোয়ানের সম্মতি নিয়ে আমাকে ঢুকতে হবে প্রো ভি.সির ঘরে। কিন্তু দারোয়ান নারাজ। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে ঢুকতে দেবে না। আমিও দমবার পাত্র নই। সহজ কথায় কাজ হল না দেখে আমি বল্লামঃ 'রাখালদার সংগে দেখা করতে চাই”।

-রাখালদা?

-হ্যাঁউনি আমার আত্মীয় হন। একটা সার্টিফিকেট নেওয়ার ব্যাপারে ওঁর সংগে কথা বলতে এসেছি।

-ঠিক আছেআপনার কাগজপত্রব্যাগ এখানে জমা দিন।

দারোয়ানের কাছে ওগুলো জমা দিয়ে দুটো কোলাপ্সিবল গেট টপকে ঢুকলাম প্রো-ভি.সির চেম্বারে রাখালদার সন্ধানে। ঐ ঘরে বয়স্ক কয়েকজন অধ্যাপক আলোচনা করছিলেন। আমিও রাখালদাকে সঠিক না চেনা থাকায় টোপ ফেললাম। বাঙালী কায়দায় নমস্কার জানিয়ে ভদ্রতার 'অবতারহলাম। 'রাখালদাউচ্চারণ করতেই অধ্যাপকেরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। আমিও পড়লাম ভীষণ লজ্জায়। যদি এই নামে কেউ না থাকেন। জিনিষটা পরিস্কার হল আমার উদ্দেশ্য-বিধেয় বিশ্লেষনের পর। সেটাই মজার। ধূমকেতুর মতো দর্শন দিয়েনাম ঠিকানা ভূমিকাহীনভাবে উপ্সথিত হয়ে সামান্য ক্লু সম্বল করে সার্টিফিকেট টা জোগাড় করতে পারব ঘূণাক্ষরেও ভাবি নি। ঐ ঘরে ঢুকে আমার সংগে অন্যান্য ব্যক্তিদের আলোচনার সারাংশ তুলে ধরি-

-আমি রাখালদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

-এখানে রাখালদা নামে তো কেউ নেই।

-(খুব নম্রভাবেআমার মামিমা শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায় (নিয়োগীরাখালদার সংগে পরিচিত। ওঁর কাছেই জেনেছি 'রাখালদাএখানেই বসেন।

-আচ্ছা উনি কি পদে চাকরি করেন?

-সঠিক বলতে পারব নাপ্রো-ভি.সি চেম্বারে উনি বসেন। ছাত্র ছাত্রীমহলে খুবই পরিচিত। ভদ্রলোক একটু বয়স্ক

-ও আচ্ছাতাহলে আপনিই। (অধ্যাপকেরদের পারস্পরিক আলোচনায় ক্ষণিক বিরতি দিয়ে একজন পক্ককেশ ভদ্রলোক বললেনআমার নাম হরিপদ ভট্টাচার্য্য । ছাত্রছাত্রীরা আদর করে আমাকে 'রাখালদাবলে ডাকে।)

যাকবাঁচা গেল। রাখলদার সন্ধান পেয়েছি তাহলে। হয়তো আলোচনার সময় অধ্যাপকেরা আমার 'কনফার্মেটরী টেস্টকরছিলেন। সবাই চেম্বার ত্যাগ করায় হরিপদ ভট্টাচার্য্য ওরফে রাখালদার সংগে আলোচনায় ব্যস্ত আমি।

-হ্যাঁহ্যাঁমনে পড়েছে। শ্রীলেখা ত আমাদেরই ছাত্রী। খুব গান-বাজনায় উৎসাহী ইত্যাদি ইত্যাদি। তা বলুনআপনার কি উপকার আমি করতে পারি?

-বি.প্রভিশনাল সার্টিফিকেট এর ব্যাপারে আপনার সাহায্য প্রার্থী।

আমার নাড়ী-নক্ষত্রের পরিচয়প্রভিশন্যাল সার্টিফিকেটের উদ্দেশ্য পরিস্কার ভাবে বল্লাম রাখালদাকে।

রাখালদাও এ ব্যাপারে শতকরা ১০০ পারসেন্ট সাহায্য করবেন বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। তার সংগে আমার পরিচয় ধূমকেতুর মতোই কিন্তু উপকার পাব তার কাছে এটা আশা করতেই পারি নি। জানি না “লাক ফেভারকরেছিল কি না।

-ঠিক আছেআমি দেখছিবলে আমার সমস্ত দায়িত্ব রাখালদা স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিলেন। আমিও আনন্দাশ্রু মোচন করলাম লাক ফেভার করেছে বলে।


প্রভিশন্যাল সার্টিফিকেটটা এ্যাপ্লিক্যান্ট এর হাতে ডেলিভারী দেয় না। এ ব্যাপারে বি.কলেজে অধ্যক্ষের কাছে সার্টিফিকেট পাঠাবে আর আমার আর্গোসীর ঠিকানায় চিঠি দেবে টু কালেক্ট দ্যাট সার্টিফিকেট ফ্রম দি প্রিন্সিপ্যাল অব বি..কলেজ অর্থাৎ ডাক-তার বিভাগের দাক্ষিণ্যে আরও দিন পনেরোর ধাক্কা।

আমিও সময় নষ্ট করতে রাজী নই। রাখালদাকে গিয়ে সব ঘটনা বল্লাম। এত দেরী করে পেলে আমার 'চাকরীর সুযোগটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। চাকরীর বাজার বুঝতেই পারছেন...ইত্যাদি ইত্যাদি বলে, 'গ্যাসখাওয়াবার পর রাখালদাও “লাইনেচলে এসেছেন।

-সত্যিই তো আমিও বুঝি চাকরি পাবার ঝামেলা।

একটা বাঙালি ছেলে চাকরি পাক-এটাই তো চাই।”

ইমিগ্রেশ্যানের ব্যাপারটা পুরো চেপে গিয়ে আমার চাকরীর উদ্দেশ্যে সার্টিফিকেট টা লাগবে-এমন একখানা ভান রাখালদার সামনে তুলে ধরলাম। সহজ সরল মানুষ রাখালদা আমার কথায় বিশ্বাস করে গেলেন।

-ঠিক আছে। আগামী কাল ২৯শে জুন পাবার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি । শুনে আমি বিদায় নিলাম।

তোমায় আমি হারাবো না বুঝেছি আজ প্রাতে

কিছুটা আশ্বস্ত হলাম রাখালদার কথায়। সমস্ত দিনের কাজকর্ম সেরে হাবড়ায় ফিরে এলাম। রাত্রে চিন্তা করছি আগামীকাল রাখালদাকে গিয়ে আর ও এক গ্যালন গ্যাস খাওয়াতে হবে কি না। যাই হোকচিন্তাতেই মগ্ন রইলামঘুম বিশেষ একটা হল না। ২৯ জুন১৯৭৪ শনিবার খুব সকালে আর্গোসি ত্যাগ করে ভোর ৫-৫৮ মিনিটের ট্রেনে সঞ্চয়ের সংগে কলকাতা এলাম। নীলরতন সরকার(N.R.S)হাসপাতালে অর্থোপিডিক বিভাগে সঞ্চয়ের একটু কাজ ছিল এক্স-রে সংক্রান্ত ব্যাপারে। সেটা সারতেই বেলা ৯টা বেজে গেল। কিছুটা সময় কাটাবার জন্য এন.আর.এস হাসপাতালের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে (সত্য নারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডারগিয়ে চা-এর সংগে 'টানিয়ে সঞ্চয় ও আমি মিনিট ৪৫ সময় কাটিয়ে দিলাম।

এই ফাঁকে রাখালদাকে আর কিভাবে লাইনে আনা যায়যাতে করে আজকেই সার্টিফিকেটটা ম্যানেজ করা যায়তার ফন্দীও আঁটছিলাম দুজনে। অফিস টাইমের ভীড় ঠেলাঠেলি করে সঞ্চয় ও আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা ভবনে দশটার মধ্যেই উপস্থিত হলাম রাখালদার সাক্ষাৎ উদ্দেশ্যে। সরকারী অফিসে যা হয়। কর্ত্তাব্যক্তি তখনও কেউ হাজির হন নি। সাড়ে দশটা নাগাদ দর্শন মিলল। রাখালদাকে মনে করিয়ে দিতেই উনি সার্টিফিকেট ইস্যুইং সেকশনের শ্রীশ্যামাদাস ভট্টাচার্য্যকে টেলিফোন করলেন আমার ব্যাপারে কাজ কতটা এগিয়েছে জানবার জন্য। আমিও ছুটলাম শ্যামাদাস বাবুর কাছে। ডান হাতে ঘড়িমুখের কোণের দিকে 'প্লেন উইলসরেখে কথা বলছিলেন শ্যামাদাস বাবু।

-'হ্যাঁঠিক আছেএখানে রাখালদার কাছ থেকে সই করে নিয়ে আসুন। সই করার ব্যাপারে রাখালদা রাজী হবেন কি না। আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমি তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিততার উপর আমার কোন কাগজপত্র কিংবা মার্কশীট দেখে আমিই যে হিল্লোল রায় সেটা ভেরিফাই রাখালদা করেন নি। রাখালদাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল্লাম,

-এখানে আপনি বি ই কলেজের প্রিন্সিপ্যালের 'ফরদিয়ে সই করলে সার্টিফিকেটটা আমি এক্ষুণি পেতে পারি। তা না হলে বি ই কলেজ থেকে আমাকে জোগাড় করতে আরও দিন সাতেক মিছিমিছি নষ্ট হবে। আই ওয়ান্ট ইওর হেল্প ইন দিজ রিগার্ডরাখালদা।

-কি আশ্চর্য এতে আর কি আছেদিন আমিই সই দিয়ে নিচ্ছি... বলেই রাখালদা শ্যামাদাস বাবুর কাছ থেকে আমার সার্টিফিকেটটা জোগাড় করে দিলেন। আমিও মহানন্দে দুজনকেই ধন্যবাদ জানালাম। সঞ্চয় ঘোষ ও আমি দুজনেই আনন্দে চোখের জল মুছলাম সার্টিফিকেট জোগাড়ের ব্যাপারে দিন সাতেকের হাঁটাহাঁটির পরিসমাপ্তিতে। ওটা পেলাম ২৯জুন১৯৭৪ নিবার ১১টা নাগাদ। রাখালদা ওরফে হরিপদ ভট্টাচার্য্য হলেন পি এ টু প্রো-ভিসি এবং শ্যামাদাস ভট্টাচার্য্য ছিলেন সার্টিফিকেট ইস্যুয়িং সেকশনের হেডক্লার্ক। সত্যিইএই দুই ভদ্রলোকের সহায়তা আমার অনেক কাজে লেগেছে। এদের দুজনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। ইমিগ্রেশ্যানের ব্যাপারে 7-50A ফর্মের প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেটও কাগজপত্র সমস্তই রেডি করে রেখে দিলাম ২৯ জুন ১৯৭৪ এর মধ্যেই।

বেশ মনে পড়ে৩০ জুন ১৯৭৪ আর্গোসিতে বসে পাশপোর্ট-এর এ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ফিল আপ করলাম খুব উৎসাহ নিয়ে। বাকী রইল ফর্মের শেষ দিকে ডেপুটি সেক্রেটারীর সিগনেচার। আমার কর্মব্যস্ততা শুরু হল ৩০শে জুনের পর থেকেই। কারণ ১লা জুলাই ১৯৭৪ সোমবার “প্ল্যাকন” কোম্পানীতে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ইনজিনিয়ার হিসাবে আমার যোগদান। জীবনের প্রথম চাকুরী ক্ষেত্রে এই “প্লাকন” কোম্পানী। হাবড়া থেকে ডেলী প্যাসেঞ্জারী করে অফিস আসতাম। আমার এই অফিসটা হল ১৩৮ ক্যানিং স্ট্রীট (বর্ত্তমান নাম বিপ্লবী রাসবিহারী বসু রোডকলকাতা -)। অফিস আওয়ার্স বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা। কাজেই আমার অন্যান্য কাজকর্ম বারোটার আগেই সেরে নিয়ে অফিসে আসতাম।

আর বিভিন্ন অফিস বিশেষ করে আমেরিকান কনস্যুলেট এর সংগে যোগসূত্র হল আমার টেবিলের টেলিফোনটা। বন্ধুবর সঞ্চয় ঘোষও যোগাযোগের ব্যাপারে আমায় যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। আগেই বলেছিমনের খুঁতখুঁতুনি থাকায় আমি ফর্ম FS 497 দুটো জমা দিয়েছিলামহাবড়ার ঠিকানায় ১৮ই জুন ১৯৭৪ এবং কলকাতা ৩৭ এর ঠিকানায় জুন ২৫১৯৭৪। এ ব্যাপারে মানসিক কতকগুলো সন্দেহ থাকায় পরামর্শ নেওয়ার জন্য আমার ট্র্যাভেল এজেন্ট মিঃ এস.পি.সিনহা ৪৫ বিপিন বিহারী গাংগুলী স্ট্রীটকলকাতা-১২ স্থ “আয়োনা ট্র্যাভেলস” এ যোগাযোগ করি। মিঃ সিনহা আগে চৌ্রঙ্গী রোডকলকাতা-১৩ তে “ট্রেড উইংস” এ কাজ করতেন। উক্ত কোম্পানীর সংগে মনোমালিন্য ও টাকা পয়সার ব্যাপারে বচসা হওয়ায় নিজেই নতুন অফিস খুলে বসেছেন “আয়োনা ট্র্যাভেলস” নাম দিয়ে। সুঠাম দেহীদীর্ঘকায় ভদ্রলোক মিঃ সিনহা। ১৯৭৪ এর ২রা জুলাই বেলা ১১-১৫ নাগাদ কাগজপত্র নিয়ে ওঁর সংগে দেখা করি।

একটু ভূমিকা লিপি দিই মিঃ সিনহার প্রসংগে। আমার তিন মামা আমেরিকা আসার সূত্রে আমাদের পরিবারের সঙ্গে মিঃ সিনহা খুবই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। তাই আমাদের ফ্যামিলী ট্র্যাভেল এজেন্ট মিঃ সিনহা আমাকে 'তুমিবলেই সম্বোধন করতেন।

সাক্ষাৎকার ২রা জুন ১৯৭৪।

-বলো হিল্লোলকতদূর কাজ এগুলো।

-আমার FS 497 ডুপ্লিকেট সাবমিশান হয়েছে। একটা হাবড়া ও অপরটা কলকাতার ঠিকানায়। এতে কোনো ক্ষতি হবে কি?

-ডেফিনিটলী। ইমিডিয়েটলী ইউ স্যুড ইন্টিমেট কনস্যুলেট অফিস রিগার্ডিং ডুপ্লিকেট সাবমিশান আদার ওয়াইজ দে উইল থিংক দ্যাট ইউ আর ট্রাইং টু চীট দেম এ্যান্ড ফোরফিট ইওর ক্লেম ফর ভিসা আন্টিল ইউ হ্যাভ এ্যাটেন্ড ফর্টি ইয়ার্স।

-তা হলে এখন কি করা যায় বলুন।

আমি অবশ্য আর্গোসিতে বসে একটা চিঠির ড্র্যাফট তৈ্রী করে নিয়ে গিয়ে মিঃ সিনহার সংগে দেখা করেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিল হাবড়ার ঠিকানায় ট্রেন সার্ভিস ডিস্টার্বড থাকে বলে যাতায়াতের সুবিধার্থে কলকাতা-৩৭ এর ঠিকানায় আছি।

কিন্তু মিঃ সিনহা বল্লেনঃ

-এভাবে লিখলে হবে না হিল্লোল । ডোন্ট বি সো পোলাইট। আমেরিকান ডু নট প্রেফার পোলাইটনেস। অলোয়েজ টক অন দি সেম প্ল্যাটফর্ম। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি হল আমেরিকান নীতি।

মিঃ সিনহা নতুন করে চিঠি তৈ্রী করে দিলেন এ ব্যাপারে। ওঁনার বক্তব্য,

-প্রথম FS 497 রিসেপ্সানিষ্ট-এর হাতে জমা দেবার পর বলা হয়েছে রিটার্ণ বাই মেল। কলকাতার ঠিকানায় চিঠি পেতে সুবিধা বলে ঐ ঠিকানা দিয়েছি এবং ডু নট টেক টু এ্যাপ্লিকেশন্স এ্যাজ সেপারেটলী। পার্সোনালি চিঠিটা দিয়ে এলাম কনস্যুলেট অফিসে।

ক্রমশ

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments