দূরদেশের লোকগল্প—কাজাকস্তান (এশিয়া)
রাক্ষসের জিভ রাজপুত্রের জোব্বায়
চিন্ময় দাশ
এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজামশাইর দুই ছেলে। বড় ছেলে, আর ছোট ছেলে।
একদিন শিকার করতে বেরোল দুই ভাই। বনের ভিতর ঢুকেই, পথ হারিয়ে ফেলল দুজনে।
তার পর? পথ হারালে যা হয়। ঘুরে বেড়াতে লাগল বনের মধ্যেই। ঘুরতে ঘুরতে বেশ কিছু দিন কেটে গেল দুজনের।
তারপর একদিন একটা তিন মাথার মোড়ে হাজির দুজনে। বড় ছেলে বলল—ভাই, এখান থেকে আমাদের রাস্তা ভাগ হয়ে গেল। দুজনে দুটো রাস্তা ধরে এগোব।
সেখানে পথের ধারে একটা ম্যাপল গাছ। বড় ভাই তার ছুরি বের করে, গাছে গেঁথে দিল। ভাইকে বলল-- ঠিক বারো মাস পরে দুজনে ফিরে আসব এই গাছের নীচে। যদি ছুরির ফলায় রক্তের ফোঁটা দেখা যায়, বুঝবে আমার জীবন সংশয়। আর, যদি বাঁটে রক্ত দেখা যায়, আমি বুঝব তোমার জীবন সংশয়।
বড় ছেলে চলেছে ডানদিকের পথ ধরে। হাতে একটা লাঠি। আর সঙ্গে নিজের কুকুরটি। চলতে চলতে বিশাল এক পাহাড়ের তলায় হাজির। ধারে কাছে এত বড় পাহাড় আর নাই। পাহাড় বেয়ে অনেকখানা উঠেছে। সামনে একটা আপেল গাছ। গাছটার তলায় একটা আগুনের কুণ্ডলী।
ভালই হয়েছে। আগুনের তাতে একটু গা-হাত-পা সেঁকে নেওয়া যাক। এই ভেবে, আগুনটার কাছে এসেছে, অমনি কোত্থেকে এক বুড়ির উদয়।
বুড়ি বলল—শোনগো, ভালোমানুষের পো। তোমার কুকুরটাকে আগে বাঁধো তুমি। আমার আবার কুকুরের কামড়কে ভারি ভয়।
তখন কী বিপদ, কী বিপদ! যেই না বড় ছেলে তার কুকুরটাকে বেঁধেছে, হা-হা করে হেসে উঠল বুড়ি। অমনি ছেলেটা নিজে, আর তার কুকুর, দুজনেই পাথর হয়ে গেল। হবে না কেন? বুড়িটা তো আসলে এক ডাইনি।
দিন যায়। দিন যেতে যেতে মাস যায়। মাস যেতে যেতে বারো মাসও গেল। ছোট ছেলে গিয়েছিল বামদিকের পথ ধরে। সে ফিরে এসে হাজির হোল তিন মাথার মোড়ে। দাদার দেখা নাই। ম্যাপল গাছের নীচে গিয়ে দেখল, ছুরিটার ফলা থেকে রক্তের ফোঁটা গড়াচ্ছে।
ফলা থেকে রক্তের ফোঁটা, মানে দাদার বিপদ! ছোট ছেলে বেরল দাদাকে খুঁজতে। দাদার যাওয়া ডানদিকের রাস্তা ধরে চলেছে। চলতে চলতে সেই বড় পাহাড়ের তলায় এসে হাজির। দমে গেল না ছেলেটা। পাহাড়ের মাথায় এসে হাজির হোল এক সময়।
সেখানে উঠোনের মত একটা খোলা জায়গা, এক বুড়ি বসে আছে সেখানে। বুড়ি বলল—কীগো, ছেলে। এত দূরে এসেছ কেন? কিছুর খোঁজে না কি?
ছোট ছেলে বলল—হ্যাঁ। আমি আমার দাদাকে খুঁজছি। বারো মাস আগে শেষ দেখা হয়েছে দাদার সাথে। কে জানে, কিছু বিপদ হয়েছে নাকি দাদার?
--আমি জানি তোমার দাদার খবর। বুড়ি বলল—তোমার দাদা আর বেঁচে নাই। এক ডাইনির খপ্পরে পড়েছিল সে। সারা দুনিয়া চষে বেড়ালেও, কিছু লাভ হবে না।
দাদা বেঁচে নাই শুনে, ছেলেটার তো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সে বলল—দাদাকে ফিরে পাওয়ার কোন উপায় কি নাই?
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
বুড়ি বলল—আছে একটা উপায়। এই পাহাড়ের উলটো দিকের ঢাল বেয়ে নেমে যাও। সেখানে মুখোমুখি দুটো পাহাড় দেখতে পাবে। এক বুড়ো থাকে পাহাড় দুটোর মাঝখানে। সে তোমাকে উপায় বাতলে দিতে পারবে।
ছেলেটা নেমে এল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সত্যিই সেখানে বড় বড় দুটো পাহাড়। একেবারে মুখোমুখি। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে একজন নয়, দুজন বুড়োকে দেখতে পেল সে।
বুড়োরা তাকে জিজ্ঞেস করল—কীগো, ছোটকত্তা। কোথায় চলেছ? কাউকে খুঁজছো নাকি?
ছেলেটা বলল—আমি আমার বড় ভাইকে খুঁজতে বেরিয়েছি। তার নাকি ভারি বিপদ।
একজন বুড়ো বলল—আমি তোমার বড়ভাইয়ের হদিশ দিতে পারি। তার আগে তোমাকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে।
--বলো,কী পরীক্ষা। আমার দাদার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি।
--এই পাহাড় দুটোর যেকোন একটার মাথায় চড়ে দেখাও, তুমি কেমন রাজপুত্তুর। তাহলেই ভাইয়ের হদিশ বলে দেব। উদ্ধারের উপায়ও বলে দেব তোমাকে।
বুড়োর কথা শেষ না হতেই, পাহাড় চড়তে শুরু করে দিল ছেলেটা। পাহাড়ী ছাগলও হার মেনে যাবে তার কাছে। তর তর করে উঠে যেতে লাগল। তা দেখে খুশির হাসি ফুটে উঠল দুই বুড়োর মুখে।
ছেলেটা নেমে এলে, বুড়োরা তাকে লম্বা একটা শনের দড়ি, লিকলিকে একটা বেতের ছড়ি ধরিয়ে দিল। ডাইনিটা পাহাড়ের যেখানে আগুন জ্বেলে বসে আছে বুড়ি সেজে, তার হদিস বলে দিল। বলল—বুড়ি তোমাকে আগুন পোয়াতে বলবে। কোনও কথায় কান দিও না তার। ওটা একটা ডাইনি। তোমার দাদা আর তার কুকুরকে পাথর করে রেখে দিয়েছে।
ছেলেটা বলল—পাথর করে রেখেছে আমার দাদাকে?
বুড়োরা বলল—তবে আর বলছিটা কী? শুধু তোমার দাদা নয়গো, ছোটকত্তা। পাথর করে রেখেছে এ দেশের রাজা, রানি আর রাজকন্যাকেও। তুমি গিয়েই, এই দড়িটা দিয়ে বুড়িটাকে বেঁধে ফেলবে আষ্টেপৃষ্ঠে। তারপর সপাং সপাং চাবুক চলাতে থাকবে। যতক্ষণ না তোমার কথা শোনে।
দড়ি আর ছড়ি বাগিয়ে, ছোট ছেলে তো হাজির হোল সেই পাহাড়ে। আগুন জ্বলছে আপেল গাছের তলায়। সেখানে পৌঁছতেই বুড়ি এগিয়ে এলো—এসো গো, ভালো মানুষের পো। আগুন পোয়াবে এসো।
ছেলেটা বলল—একা নয় গো। এসো, দুজনে আগুন পোয়াই। বসে বসে গল্পও করা যাবে।
--সে তো বেশ ভালো কথা। সে তো ভারি ভালো কথা। হাসিমুখ করে বলতে বলতে, বুড়ি এগিয়ে এল।
যেই না বুড়ি কাছাকাছি হয়েছে, ঝট করে দড়িতে পেঁচিয়ে, ভালো করে বেঁধে ফেলল ছেলেটা। বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল—আরে, করছোটা কী? বাঁধছো কেন আমাকে? ছেড়ে দাও।
--দেবো ছেড়ে। আগে বল, ডাইনি। আমার দাদা কোথায়? তার কুকুর কোথায়? ভালোয় ভালোয় বল। নইলে, আজ তোর একদিন, কি আমার একদিন।
--ওহ, এই কথা। তা বুড়োমানুষটাকে বেঁধে ফেলবার দরকারটা কী? বাঁধন খুলে দাও। চলো, আমার সাথে দেখিয়ে দিচ্ছি।
ছেলেটা সপাং সপাং করে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল বুড়িকে। ওই চালাকি আমার সাথে চলবে না। আগে তোর পিঠের চামড়া তুলি। তারপর…
বুড়ি ককিয়ে উঠল—একটু দয়া করো বাছা। আমাকে ছেড়ে না দিলে, দেখাবো কী করে?
ছেলেটা বুড়ির পা দুটো টেনে এনে আগুনে চেপে ধরল। পরিত্রাহি ডাক ছাড়তে লাগল বুড়ি। চেঁচাতে লাগল—বলছি, বলছি।
ছেলেটা তখন তাকে দাঁড় করিয়ে, ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল। বুড়িটা একটা গুহার মত জায়গায় গিয়ে হাজির হোল। সেখানে এক কোণে একটা কলসী রাখা ছিল। তা থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে ছিটিয়ে দিল দুটো পাথরের উপর। সাথে সাথেই বড় রাজকুমার আর তার কুকুর জেগে উঠল।
ছোট ভাইকে সামনে পেয়ে বড়ভাই বুকে জড়িয়ে ধরল তাকে। ছোট বলল—দাঁড়াও, দাদা। আরও তিনজন বন্দী হয়ে আছে এখানে। তাদের মুক্ত করি।
বুড়ীর পিঠে আবার কয়েক ঘা পড়তে, আবার জল ছেটাল বুড়ি। দেশের রাজা, রানি আর, রাজকন্যা জেগে উঠল জলের ছিটে লেগে।
সকলের ভারি আনন্দ। রাজা বলল—তোমরা দু’ভাই চলো আমার সাথে। রাজবাড়িতে নিয়ে যাবো তোমাদের।
ছোট বলল—যাবো। তবে, একটা কাজ সেরে দিয়ে যাই। একটা হিল্লে করে দিয়ে যাই ডাইনিটার। নইলে, আবার কাউকে বিপদে ফেলবে ও। বুড়িকে ঠেলতে ঠেলতে এনে আগুনে ফেলে দিল ছেলেটা। আপদ বিদেয় করে, পাহাড় থেকে নামতে লাগল পাঁচজনে।
নীচে নেমে, বড় ছেলে আলাদা হয়ে গেল। ভাইকে বলল—আমার তো ঘোরাই হয়নি ভালো করে। আমি যাই এখন।
বড়ছেলেটা একা চলেছে আবার। কতদূর গিয়ে একটা শহরে পৌঁছল সে। অবাক হয়ে দেখল, শহরের সব লোক কাঁদছে। তাদের বাড়িঘর সব কালো কাপড়ে ঢাকা।
ছেলেটি অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইল। লোকেরা বলল—ভারি বিপদ আমাদের। এই শহরের বাইরে, পাহাড়ের গুহায় এক রাক্ষস থাকে। ছ’-ছ’টা মাথা তার। প্রতিদিন অন্তত একজন করে মানুষ পাঠাতে হয় তার পেট ভরাবার জন্য্য। আগামীকাল পালা পড়েছে আমাদের রাজকুমারীর। গোটা শহর দুঃখে পাথর হয়ে গিয়েছে। কালো কাপড় দিয়ে ঘরবাড়ি ঢাকা হয়েছে সেজন্য।
ছেলেটা বলল—কেউ ভয় পেয়ো না। আমি যাচ্ছি রাক্ষসের মোকাবিলা করতে।
বিশাল একখানা তলোয়ার ছিল ছেলেটার। সরু লিকলিকে। কিন্তু প্রচণ্ড ধার তাতে। স্প্রিংয়ের মতো গুটিয়ে, জোব্বার পকেটে থাকত তার তরোয়ালটা। চাবুকের মত ঘোরালে, বড়সড় গাছও কাটা পড়ে যায় তাতে। বড় ছেলে শহরের বাইরে পাহাড়ের তলায় এসে হাজির হোল।
গুহার মুখে এসে, ভালো করে দেখে নিল এদিক ওদিক। একটা পাথরের আড়ালে বসে রইল চুপটি করে। সেখানেই রাত কেটে গেল ছেলেটার।
সকাল হয়েছে। দেখতে দেখতে প্রায় দূপুর হয়ে এলো। এমন সময় একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে হাজির হোল সেখানে। রাজার মেয়ে এসে নামল গাড়ি থেকে। সারা মুখ ভয়ে সাদা। আজ তার জীবনের শেষ দিন। গাড়ি চেপে মরতে এসেছে মেয়েটি।
মেয়েটি নামতেই, তাকে পাথরের আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল ছেলেটি। বলল—ভয় বা চিন্তার কিছু নাই। তোমাকে রাক্ষসের পেটে যেতে দেব না আমি। এইখানে বোস। আর ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করো কেবল।
মেয়েটি হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করতে লাগল। খানিক বাদে, রাক্ষসের একটা মাথা বেরিয়ে এল। গরগরে গলায় বলল—এতো বেলা হোল, জলখাবারের কিছু পাইনি আমি। এখন দূপুর হয়ে গেল। আমার খাবার কোথায়?
ছেলেটা ঝট করে হাঁটু মুড়ে বসে, বিড়বিড় করে কিছু বলে গেল ঈশ্বরকে। তারপর চেঁচিয়ে উঠল—বাইরে বেরিয়ে এসো। একসাথে দুটো খাবারই পেয়ে যাবে তুমি।
কোন দিন খাবারের জন্য বাইরে বেরোতে হয়নি রাক্ষসকে। নিত্যদিন খাবার নিজের পায়ে হেঁটে, গুহার মধ্যে ঢুকে আসে। এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। আজও রাক্ষস বাইরে এলো না। ছেলেটার কথা গ্রাহ্য না করে, ভেতরে ঢুকে গেল।
বেস কিছুক্ষণ কেটে গেল। তাতেও কেউ এলো না দেখে, এবার দুটো মুখ বের করল রাক্ষস। চেঁচিয়ে বলল—আমাকে উপবাস করে থাকতে হবে নাকি? হচ্ছেটা কী?
ছেলেটি চেঁচালো আরও জোর গলায়—বলেছি তো, দুই খাবারই পেয়ে যাবে। তবে, বাইরে না এলে, কিছুই জুটবে না আজ।
সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি। রাক্ষসের পেট চুঁইচুঁই করছে। কোন কিছুর তোয়াক্কা করল না সে। --কেরে তুই? এতো সাহস তোর? হুঙ্কার ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এলো দানবটা।
লোকগুলো ঠিকই বলেছে। ছ’খানা মাথা রাক্ষসটার। রাক্ষসটা কাছাকাছি হতেই ছিটকে উঠে পড়ল ছেলেটি। জোব্বা থেকে বেরিয়ে এলো তার গোটানো তলোয়ার। মূহুর্তের ব্যাপার। বিদ্যুৎ ঝলকের মত ঝলসে উঠল তলোয়ারখানা। রাক্ষসের ছ’টা মাথাই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। গাছের গুঁড়ির মত ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল বেচারা। ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে তার।
ছেলেটা করল কী, ছটা মাথা থেকে ছ’টা জিভ কেটে নিল। রুমালে মুড়ে জোব্বার পকেটে রেখে দিল জিভগুলো।
রাজার মেয়ের তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সত্যি সত্যি জীবন ফিরে পেয়েছে সে। ছেলেটিকে বলল—ওঠ আমার রথে। তোমার সাথেই বিয়ে হবে আমার। রাক্ষসটাকে মেরে, এই রাজ্যের অনেক উপকার করেছ তুমি। দেখো, বাবা তোমাকে রাজ্যটাই দিয়ে দেবে।
ছেলেটি বলল—বারো মাসের জন্য সফরে বেরিয়েছি আমি। এক্ষুণি তোমার সাথে যেতে পারব না। তবে, কথা দিলাম, সফর শেষে ফিরব এই রাজ্যে। আর যদি না ফিরে আসি, তখন অন্য কাউকে বিয়ে করে নিও। এই বলে, বড় ছেলেটি চলে গেল সেখান থেকে।
আড়াল থেকে সবই দেখছিল ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান। ছেলেটা চলে গেল দেখেই, বেরিয়ে এলো সে। রাক্ষসের মাথাগুলো মাটিতে গড়াচ্ছিল। তুলে নিয়ে গাড়িতে রাখল যত্ন করে। রাজার মেয়েকে বলল—এখন এক কোপে তোমার মাথাটা কেটে নিতে পারি আমি। তবে বাঁচবার একটাই রাস্তা আছে। বারো বার শপথ করে বলতে হবে—আমিই রাক্ষসকে মেরেছি। আর আমাকেই বিয়ে করবে তুমি।
রাজার মেয়ে আর কী করে। বারো বার শপথ করল কথা গুলো। নইলে যে মারা পড়তে হবে!
রাজার মেয়েকে জীবন্ত নিয়ে, গাড়ী ফিরে চলেছে পাহাড় থেকে। রাস্তার দু’পাশে কাতারে কাতারে লোক ভেঙ্গে পড়েছে। বীরের মত সামনে দাঁড়িয়ে আছে কোচোয়ান। রাক্ষসের ছ’খানা মুণ্ডু তার দু’হাতে।
লোকেরা চেঁচিয়ে জয়ধ্বনি দিতে লাগল লোকটার নামে। কেউ কেউ আবার চেঁচিয়ে বলছে কোচোয়ানের সাথে বিয়ে দেওয়া হোক এর। রাজার মেয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে গাড়ির ভিতর।
এদিকে বড়ছেলেটি ঘুরে বেড়াচ্ছে এ দেশে ঐ দেশে। বারো মাস শেষ হয়ে আসছে যখন, সেই দেশে এসে হাজির হোল, যেখানে ছোট ভাইয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল তার। সেখানে দেখল রাজার মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে ভাইয়ের। বুড়ো রাজা আর রানিমা জামাইকেই সিংহাসনে বসিয়েছে রাজা করে।
রাজবাড়ির কথা শুনেই, রাজকুমারির কথা মনে পড়ে গেল ছেলের। কথা দিয়ে এসেছে ফিরে যাবে সেখানে।
আর দেরি নয়। সেই রাজকুমারির দেশে এসে হাজির।
এবার সেখানে একেবারে অন্য এক ছবি। শহর জুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে। শহরের বাড়িঘর সব সুন্দর করে সাজানো। সবার মুখে হাসি। অবাক হয়ে ছেলেটি জানতে চাইল-- ব্যাপার কী গো? শহরের এতো সাজগোজ কিসের?
--কোত্থেকে এলে গো তুমি? রাজার কোচোয়ান কচুকাটা করেছিল ছ’মাথাওয়ালা একটা ভয়ঙ্কর রাখসকে। দু’দিন বাদেই রাজকন্যার সাথে কোচোয়ানের বিয়ে হবে যে!
ছেলেটি তো আকাশ থেকে পড়লো—হায় ঈশ্বর! ছ’-ছ’টা মাথা একটা রাক্ষসের। জীবনে কখনও তো দেখিনি এমন জীব।
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল— তাহলে চলো, চলো। নিজের চোখে দেখবে মাথাগুলো।
রাজার বাড়ির বড় ফটক। তার সামনে কাঠের খুঁটি পুঁতে, রাক্ষসের ছ’টা মাথা ঝোলানো। ছেলেটার মুখে হাসি। এগিয়ে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল মাথাগুলো। হেসে বলল—আজব ব্যাপার দেখছি যে হে! দুনিয়ার সব জীবের জিভ আছে একটা করে। আর বিধাতার এমন ভুল, যে রাক্ষসটার ছ’টা মাথায় একটাও জিভ দিতে ভুলে গেলেন!
সবাই শুনল কথাটা। ভাসতে ভাসতে কথাটা পৌঁছে গেল দরবারেও। সেখানে এখন রাজার সিংহাসনের পাশেই আর একটা আসন। সেই কোচোয়ান বসে সেটাতে। সে এখন একজন রাজপুত্তুর।
সে চেঁচিয়ে উঠল—কোন বেকুব বলেছে এ কথা। তার দু’পায়ে দড়ি বেঁধে, চারটে বুনো ঘোড়ার সাথে জুতে দাও। পাহাড়ি পথে নিয়ে গিয়ে চাবুক কষাও ঘোড়াগুলোকে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাক হতভাগা।
প্রহরীরা বেরুতে যাবে, রাজা বলল—থামো তোমরা। দরবারে ধরে আনো লকটাকে। আগে শোনা যাক, কী বলছে সে।
চারজন প্রহরী ধরে আনল ছেলেটিকে। তাকে দেখেই চিনে ফেলেছে রাজার মেয়ে। তার মুখে মুক্তির হাসি। কিন্তু সে চুপটি করে রইলো। দেখা যাক না, কী হয়।
রাজা বলল—কীসব যেন বলেছ তুমি?
ছেলেটি মাথা নুইয়ে রাজাকে বলল—পেন্নাম আপনাকে। যে লোক রাজার মেয়েকে বিয়ে করবার লোভে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, একমাত্র সে জানে না। কিন্তু দুনিয়ার বাকি সবাই জানে, সব জীবের মুখেই একটা করে জিভও দিয়েছে বিধাতা পুরুষ। এটুকুই বলেছি আমি।
রাজা একটু থমকে গেল একথা শুনে। তার পরে বলল—তাহলে সে জিভ গেলো কোথায়? জিভ তো আর হাওয়ায় উড়ে যাবার জিনিশ নয় হে।
ছেলেটি হাসি মুখ করে বলল—যে লোক সত্যিই মেরেছে রাক্ষসটাকে। জিভ আছে তারই জোব্বার পকেটে।
পকেট থেকে রুমালে জড়ানো ছ’-ছ’খানা জিভ বের করে রাজার পায়ের কাছে নামিয়ে দিল ছেলেটা। দেখে সারা দরবার ধন্যধন্য করে উঠল। সাধু সাধু বলে, চেঁচাতে লাগল সকলে।
সবাই এবার রাজকুমারিকে চেপে ধরল, সত্যি ঘটনা বলবার জন্য। এক এক করে সমস্ত ঘটনা বলে গেল রাজার মেয়ে। কীভাবে দিব্বির ফাঁদে তাকে আটকে রেখেছিল বদমায়েস কোচোয়ানটা।
তার পর? তারপর আর কী। রাজার হুকুমে পিছমোড়া করে বাঁধা হোল কোচোয়ানকে। চারটে বুনো ঘোড়ার সাথে জুতে, পাহাড়ি রাস্তায় নিয়ে গিয়ে চাবুক কষানো হয়েছিল ঘোড়াগুলোকে। কোচোয়ান লোকটার মাংস যে দাঁড়কাকের দল কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেয়েছিল, সে কথা বলবার কোন দরকার নাই নিশ্চয়।
যেটা বলবার কথা, সেটা হোল-- ধুমধাম করে রাজার মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল বড় ছেলেটির। শহর শুদ্ধ লোক সাতদিন ধরে ভোজ খেয়েছিল রাজবাড়িতে।
0 Comments