জ্বলদর্চি

ছো নাচ তর্কে বিতর্কে /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৫৯

ছো নাচ তর্কে বিতর্কে

সূর্যকান্ত মাহাতো


আমরা সাধারণত আমাদের মুখমন্ডল দিয়েই আমাদের মনের ভাবকে প্রকাশ করে থাকি। আমাদের ভিতরে চলতে থাকা হাসি-খুশি, আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ-রাগ, সুখ-দুঃখকে অন্যের কাছে মুখমণ্ডলের নানান অভিব্যক্তি দিয়েই প্রকাশ করে থাকি। কিন্তু সেই মুখমন্ডলটিই যদি ঢেকে ফেলা হয়! তাহলে কীভাবে আমার মধ্যে চলতে থাকা আবেগকে অন্যের কাছে উপস্থাপিত করব? তারও উপায় আছে। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের মধ্য দিয়েই সেটা করা সম্ভব। অনুশীলনে অনুশীলনে সেটাকে আবার শিল্পের পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তখন শরীরই কথা বলবে ও ভাব প্রকাশ করবে। জঙ্গলমহলে বিশেষ করে পুরুলিয়া জেলার মানুষ এভাবেই মুখমণ্ডল ঢেকে রেখে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে একটি নৃত্যের মধ্য দিয়ে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, 'ছো-নাচ'-র কথাই এতক্ষণ বলছিলাম। মুখোশে ঢাকা মুখমণ্ডল। অথচ তারপরেও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা রকম মুদ্রায় ও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সঞ্চালনায় কীভাবে মনের ভাব ফুটিয়ে তোলা যায় তা 'ছো-নাচ' না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

পুরুলিয়ার এক শিক্ষক বন্ধু বললেন, "'ছো' নাচের শুরুর দিকে অর্থাৎ সূচনা পর্বে এই মুখোশের ব্যবহার নাকি ছিল না। তখন নানা রকমের কালি ঝুলি মুখে মেখে চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হত। পদ্মশ্রী প্রাপ্ত 'ছো' শিল্পী 'গম্ভীর সিং মুড়া' এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তার ঠাকুরদা ও পিতা বিনা মুখোশেই ছৌ নৃত্য পরিবেশন করেছেন" (আমাদের পুরুলিয়া /অমিয় কুমার সেনগুপ্ত)।

আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। ছৌ নাচের সূচনা পর্বে মুখোশ ব্যবহৃত হতো না! "তাহলে কীভাবে মুখোশের ব্যবহার শুরু হল?"

বন্ধু বললেন, " মুখোশের ব্যবহার পরবর্তী কালে শুরু হয়েছিল। চরিত্রগুলোকে আরো বেশি করে বাস্তবানুগ ও রূপসম্মত করে ফুটিয়ে তোলার জন্য। (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো, পৃষ্ঠা ১৮১) 'পদ্মশ্রী'(১৯৮১) প্রাপক গম্ভীর সিং মুড়াও বলেছেন, ছৌ নাচে যদি মুখোশ না থাকত তবে তা এমন বর্ণময় হয়ে উঠত না। মুখোশ ছাড়া অভিব্যক্তিও ফুটে উঠত না। (পৃষ্ঠা ২৬৯, অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া ১ম পর্ব) বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে রূপদানের জন্য মুখোশের বিকল্প কিছু ছিল না। যেমন গণেশের শুঁড় যুক্ত মুখ, কার্তিকের বাহন ময়ূর, এছাড়াও নারী চরিত্রের রূপ যেমন দুর্গার মুখ ও দশটি হাত এসব প্রকাশ করতে মুখোশের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তবে মুখোশ কেবল চরিত্রকে বাস্তবসম্মত রূপদান করতেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ভাবটি ফুটিয়ে তুলতে হত শরীরের বিভিন্ন দেহভঙ্গির সাহায্যেই।" (ঝাড়খন্ড: সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাত, পৃষ্ঠা ৩৭)

বললাম, "তবুও ঠিক কত বছর আগে থেকে মুখোশের ব্যবহার হত এরকম কোন তথ্য প্রমাণ কিছু পাওয়া গেছে কি?"

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



"সেরকম কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ১৩৬২ সালে "শারদীয়া দেশ"- এ সুধীর চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, "সরাইকেলার ছউ নৃত্য"। সেখানে মুখোশের ব্যবহার সম্পর্কে সরাইকেলার রাজা 'রাজা সাহেব' লেখককে জানিয়ে ছিলেন, সরাইকেলার রাজ পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। এবং তখন থেকেই নাকি মুখোশের ব্যবহারের সন্ধান পাওয়া গেছে। (শারদীয়া দেশ (১৩৬২), পৃষ্ঠা ১৬৭) আবার বাঘমুণ্ডীর অবিনাশ সূত্রধরকে মুখোশ তৈরির পথিকৃৎ বলা হয়। তার সময়কাল ছিল ১৩০৫-১৩৮২ বঙ্গাব্দ। তাই পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডীতে মুখোশ তৈরির ব্যাপক প্রচলন ওই সময়কেই ধরা হয়। তবে আমার মতে তারও অনেক আগে থেকেই মুখোশ তৈরি হত বলেই মনে করা হয়।" 

জিজ্ঞেস করলাম, "'ছো' না 'ছৌ'? নাচের প্রকৃত নাম কী?"

বন্ধু একটু হাসলেন। বললেন, "এই বিতর্ক দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি পুরানো। লোকসংস্কৃতির কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে তর্ক ও বিতর্কও কম কিছু হয়নি। আজ আর সে নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। 'ছো', 'ছৌ' সবই চলছে। এখনকার জেনারেশন ওসব নাম নিয়ে আর ভাবেও না। তাদের কাছে নাচটাই আসল। তবে আমি মনে করি 'ছৌ' নামটা আধুনিকীকরণ। ওটা ঠিক নয়।"

"কেন? এ নিয়ে বিতর্ক কেন তৈরি হল?"

"বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতর মতে ঝাড়খণ্ডী উপভাষায় এই নাচকে 'ছ নাচ' বলে। (বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তও তাই মনে করেন) বাংলা উচ্চারণে সেটা 'ছো' নাচ। তবে সেটা কোনভাবেই 'ছৌ' নয়। (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ পৃষ্ঠা ১৭৫) বিশিষ্ট ভাষ্যকার ও তত্ত্ববিদ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো একে 'ছো' নাচ বলেই মনে করেন, 'ছৌ' নয়। কারণ উনি ১৯৭২ সাল থেকে পুরুলিয়া সহ ঝাড়খণ্ডের বহু এলাকা সরেজমিনে তদন্ত করে ও নৃত্যশিল্পী, বাদক, দর্শক সহ বহু মানুষকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলেন এই নাচের নাম 'ছো' নাচ।" (ঝাড়খন্ড: সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন, পৃষ্ঠা- ২৯)তবে এই নাচের নামকরণের বিভিন্ন যুক্তিগুলোও বেশ উদ্ভট ।"

"কী রকম?"

"কারণ অনেকেই বলেন, 'ছায়া' থেকে 'ছো' শব্দটি এসেছে। কেউ বলেন 'ছদ্ম' থেকে এসেছে। অনেকে আবার বলেছেন, 'ছাউনি' থেকে 'ছো' নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে। কারণ অনেক আগে পাইক বা সৈন্যরা ছাউনির নিচে অবস্থান করত। এবং অবসর বিনোদন করতে নৃত্য করত। তাই সেখান থেকেই ছোউ নৃত্যের উদ্ভব। (প্রবাসী (১৩৬৩, বৈশাখ সংখ্যা, পৃষ্ঠা- ৭০, ছোউ নৃত্যের ঐতিহ্য/ শ্রীসুধীর বন্দোপাধ্যায়) ভাবা যায়! মণিবর্ধনের লেখাতেও সেই কথাই উঠে এসেছে। ছাউনিতে সৈনিকদের যুদ্ধের অভ্যাস থেকে যে ছৌ নৃত্যের উদ্ভব সে কথা নাকি ময়ূরভঞ্জের ধারায় দেখা যায়। তার মতে 'যুদ্ধনৃত্য' থেকেই ছৌ নাচের উদ্ভব (বাংলার লোকনৃত্য ও গীতি বৈচিত্র/মণি বর্ধন) অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া ১ম পর্ব/ দেবীপ্রসাদ জানা, পৃষ্ঠা- ২৬৭) ডক্টর সুধীর কুমার করন 'ছো' নাচকে বলেছেন 'সঙ'। আর বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতর মতে 'ছ' শব্দের অর্থ অঙ্গভঙ্গী সহকারে ঢং করা। গ্রামের দিকে অনেকেই একটি বাক্য বলে থাকে। সেটা হল, "কি যে ছো করছিস।" অর্থাৎ কোন অঙ্গভঙ্গী করাকেই এমনটা বলা হয়েছে। তবে আসল বিতর্কটা ঠিক অন্য জায়গায়।"

"কোথায়?"

"ভাষ্যকার পশুপতি প্রসাদ মাহাতো মনে করেন, চির প্রচলিত 'ছো' নাচকে 'ছৌ' বানানোর পিছনে আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয়ের বেশ ভূমিকা ছিল।" (জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডী লোকদর্শন/পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা- ১১৬)

বাধা দিয়ে বললাম, "কিন্তু উনার 'বাংলার লোকসাহিত্য' গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে কোথাও তো 'ছৌ' শব্দটি পেলাম না। বরং উনিতো 'ছো' শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। 'ছৌ' বলে এই নাচকে কোথাও তিনি উল্লেখও করেননি। তাহলে তিনি কীভাবে 'ছো'-কে 'ছৌ' বানালেন?"

"আসলে আশুতোষবাবু পুরুলিয়ার যে 'ছৌ' নাচকে আবিষ্কার করেছিলেন, সেখানে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক 'ছো' ছিল না। সেই ঐতিহ্যও ছিল না। কেবল বাজারের সামগ্রীটি তার ঐতিহ্য 'ছো'-কে হারিয়ে 'ছৌ'-এ পরিণত হয়ে উঠেছিল। তার হাত ধরেই ছো পাশ্চাত্যে পৌঁছে 'Chhau'-এ পরিণত হয়ে উঠেছিল। আর এর একটা কাহিনীও আছে।"

আমি সোৎসাহে বললাম, "কী সেই কাহিনী?"

"১৯৩০- ৩১ সালে সরাইকেলার 'দুবরাজ' 'ছো' নাচকে লন্ডন নিয়ে গিয়েছিল এ কথা সত্যি। তবে গোটা পৃথিবীতে 'ছো' নাচ কে যিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি হলেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লোকসংস্কৃতির একটি শাখা খোলার পর ১৯৬৭ সালে আশুতোষ ভট্টাচার্য কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পুরুলিয়া এসেছিলেন। ওই বছর 'চৈত্র সংক্রান্তি' ও 'পয়লা বৈশাখ' উপলক্ষ্যে তার উদ্যোগেই মাঠার বনবাংলোয় 'ছো' নাচের প্রায় সব দলগুলোই উপস্থিত হয়েছিল। তাদের থেকেই তিনি বাছাই করে একটি নতুন দল গড়েছিলেন বিদেশে পারফর্ম করানোর জন্য। শ্রীমতি 'স্যালভিনি' বিদেশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সেই দলকে তালিমও দিয়েছিলেন। (পাহাড় জঙ্গলের ছো নাচ এখন বিশ্বময়/ সুবোধ বসুরায়, অহল্যাভূমি পুরুলিয়া,১ম পর্ব/দেবীপ্রসাদ জানা, পৃষ্ঠা- ২৬০) তারপর লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, শিকাগো, লস এঞ্জেলস, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, চীন, জাপান, কোরিয়া সহ গোটা পৃথিবীজুড়ে কেবলই সাফল্য এসেছিল এই নাচের।"

"উনি তো দারুণ একটা কাজ করেছিলেন। পুরুলিয়ার 'ছো' নাচকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছিলেন। এটাতো গর্বের বিষয়। তাহলে তাকে সমালোচনা কেন?"

"তার দুটো কারণ আছে। তার আগে একটু বলি, 'ছো' নাচ অনুষ্ঠিত হয় মুক্তমঞ্চে। মাটিতে। কারণ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমাগমে শূন্যে ঝাঁপ দিতে দিতে পারফর্ম করা কোনো অস্থায়ী মঞ্চে সম্ভব নয়। কিন্তু বিদেশের অস্থায়ী মঞ্চের উপযোগী করে গড়ে তুলতে গিয়ে আশুবাবু 'ছো' নাচে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এতটাই কমিয়ে দিলেন যে হাতে গোনা দু একটা কেবল ঢাক কিংবা ঢোলের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। আর এতে করে হারিয়ে গেল 'ছো' নাচের আসল বাজনার গাম্ভীর্য। নিবিড় জীবনবোধ। বেঁচে রইল, না বলে বলি, কেবল চটকদার হল ঝলমলে পোশাক, মুখোশের বৈচিত্র্য, আর কেবল লম্ফঝম্প। আসল 'ছো' নাচ একটু একটু করে পাল্টে গেল তার হাত ধরেই। এটাকেই প্রকৃত শিল্পীরা মেনে নিতে পারল না।"

"আর অন্য কারণটি?"

"সেটা আরো ভয়ানক। 'ছো' নাচে মুখোশের ব্যবহার প্রসঙ্গে পুরুলিয়া জেলার "সেন্সাস হ্যান্ডবুক" (১৯৬১)-এ তিনি যা লিখেছেন, তা অত্যন্ত অপমানজনক। উনি লিখেছেন,"পুরুলিয়ার আদিবাসীরা দেখিতে অপেক্ষাকৃত কুৎসিত বলিয়া তাহারা ছো নাচের সময় মুখোশ ব্যবহার করেন।(To cover the ugly human feature they use mask)" (ঝাড়খন্ড: সমাজ ও বিদ্রোহ আন্দোলন, পৃষ্ঠা- ৩৬)

"আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতো মানুষ সত্যিই এ কথা লিখেছিলেন নাকি? বিশ্বাস হচ্ছে না!"

"হ্যাঁ। লিখেছেন। শুধু 'সেন্সাস হেন্ডবুকেই' নয় 'বাংলার লোকসাহিত্য' ১ম খণ্ডেও লিখেছেন,"কৃষ্ণকায় এবং অপেক্ষাকৃত কুৎসিত দেহাকৃতির জন্য পৌরাণিক অভিজাত চরিত্রের নৃত্যাভিনয়ে অংশগ্রহণ করিবার কালে পুরুলিয়ার সাধারণ জনসমাজে স্বভাবতই মুখোশের ব্যবহার প্রচলিত হইয়াছে। সেইজন্য ছো নাচের মধ্যেও যাহাতে অনভিজাত  কিংবা আঞ্চলিক কোন বিষয় প্রকাশ করা হইয়া থাকে, তাহাতে মুখোস ব্যবহৃত হয় না।"(বাংলার লোক সাহিত্য, ১ম খণ্ড/ ড: আশুতোষ ভট্টাচার্য)

"অনভিজাত কিংবা আঞ্চলিক চরিত্র প্রকাশে কি মুখোশ ব্যবহার করে থাকেন ছো শিল্পীরা? এর উত্তর খুঁজলেই তো আশুতোষবাবুর এই ভ্রান্ত উক্তির প্রমান পাওয়া যাবে?"

"অবশ্যই করেন। বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে তো মুখোশ আবশ্যিক ভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন বাঘ, সিংহ, হরিণ, ময়ূর প্রভৃতি। এই চরিত্রগুলো তো আর কোন অভিজাত চরিত্র নয়। কিন্তু এদের মুখোশ না পরলে চরিত্রগুলোকে কীভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব? তাছাড়া  রাম, রাবণ, সুগ্রীব, হনুমান, সীতা প্রভৃতি চরিত্রের বাস্তবানুগ রূপদান দিতেও মুখোশ ব্যবহার করা হয়। তারা তো আর কোন পৌরাণিক চরিত্র নয়। তাই তাদের ফর্সা রং তুলে ধরতে মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এটা তাঁর একটা অপব্যখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
 'ছো' নাচকে নিয়ে আরো বিতর্ক আছে। আসলে 'ছো' নাচ নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই।"

"আবার কী বিতর্ক রয়েছে?"

"এই নাচের উৎপত্তিস্থল নিয়ে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা সকলেই দাবী করেন এ নৃত্য তাদের। আসলে এ নৃত্য কারো নয়। এ নৃত্য সকলের। নাচের উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক করার মূল কারণ হল, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানা। সরাইকেলায় 'ছো' নাচের প্রবল প্রতিপত্তি। সেখানকার রাজ পরিবারও এই নাচকে খুবই সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। ময়ূরভঞ্জেও 'ছো' নাচের চল আছে। তাই উড়িষ্যাবাসীরা দাবি করেন ছো নাচ তাদের। যদিও এ যুক্তি ঠিক নয় কারণ তাই যদি হত তাহলে 'ছো নাচ' কেবল সরাইকেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকত না। গোটা উড়িষ্যায় ছড়িয়ে পড়ত। তা কিন্তু হয়নি। আবার সরাইকেলা ও  'পুরুলিয়া' একসময় বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই বিহারীরাও জোরদার দাবি করে এ নাচ তাদের। এদিকে বাঙালিরাও এই নাচের মূল দাবিদার। কারণ ছো নাচে যে ঝুমুর গান গাওয়া হয় সেটা কিন্তু হিন্দি বা উড়িয়া নয়। সেটা মূলত বাংলা ভাষারই গান। সুতরাং ছো- এর জন্ম যে বাংলাতেই এ কথা সীমান্ত বাংলার মানুষ সহ সকলেই মনে করেন। তাই আমার মতে 'ছো' নাচের অধিকার নিয়ে বিতর্ক তোলাটা অপ্রাসঙ্গিক। অঞ্চল অনুযায়ী প্রতিটি নাচই স্বতন্ত্র তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গুণে।"

"নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গুণ বলতে! প্রতিটি অঞ্চলের ছো নাচের ধারা কি পৃথক পৃথক? 'ছো' নাচ তো ছো নাচই! তার আবার পার্থক্য হয় নাকি!"

"হয়। সমগ্র 'ছো' নাচের চারটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। এক, উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের ছো নৃত্য। দুই, ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলার ছো নৃত্য। তিন, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ছো নৃত্য। চার, ঝাড়গ্রামের চিল্কিগড় সংলগ্ন ছো নৃত্য। ১৯৩৮ সালে ইউরোপে 'ছো' নাচের পরিচিতি ঘটান সারাইকেলার রাজ পরিবার। এই নাচে মুখোশের ব্যবহার খুব বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল তা কেবল বৈচিত্রহীন ও সংকেতধর্মী। ময়ূরভঞ্জের 'ছো' নৃত্য এই রাজ পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই তাদের নাচেও মুখোশের ব্যবহার তেমন একটা নেই। আঙ্গিকে সেগুলো পুরুলিয়ার 'ছো' নাচের সঙ্গে মিল থাকলেও মুখোশের ব্যবহারে পুরুলিয়ার 'ছো' নাচ সবাইকে ছাপিয়ে ওঠেছে। এখানেই পুরুলিয়ার 'ছো নাচ' উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রম।"

"সমস্ত পুরুলিয়া জেলা জুড়ে  ছো নাচের কি একই ধারা?"

"এখন অজস্র 'ছো' নাচের দল গড়ে উঠেছে জেলা জুড়ে। কিন্তু পুরুলিয়া জেলায় মূলত চারটি থানাতেই ছো নাচের প্রচলন বেশি। বাঘমুন্ডী, আড়সা, বান্দোয়ান এবং ঝালদা। এদের মধ্যে বান্দোয়ানের 'ছো নাচ' হল 'রক্ষণশীল'। অন্যদিকে ঝালদার 'ছো নাচ' হল 'প্রগতিশীল'। বাকি দুটো এদের মধ্যবর্তী পর্যায়ের।"

"একই জেলার ছো নাচ, তারপরে মূল তফাতটা কোথায়?"

"তফাৎ আছে। নন্দদুলাল ভট্টাচার্য "নৃত্যে মুখোশ ও ছৌ মুখোশের শিল্পকলা" শিরোনামে একটি লেখায় সে পার্থক্য সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। বাঘমুণ্ডী-র ছো নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হল, শারীরিক কসরতভিত্তিক বা পরিশ্রমসাধ্য। acrobatic। শূণ্যে লাফ দিয়ে দেহকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে পড়া। একই রকম ভাবে ফের শূণ্যে লাফ দেওয়া, ফের চক্রাকারে ঘুরে মাটিতে বসে পড়া। এটা বেশ কষ্টসাধ্য।
ঝালদার ছো নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হল 'মেল' বা গোষ্ঠী নৃত্য। এদের রূপসজ্জা বেশ আধুনিক এবং ব্যয়বহুল।
আড়সার ছো নাচের ধরণ হল, এই ছো নাচ ততটা আঙ্গিক নির্ভর নয়। সব চরিত্রের আবার মুখোশও থাকে না। বরং এদের ঢোলক ও বাদ্যকরদের বেশ প্রতিভা লক্ষ্য করা যায়।
বান্দোয়ানের ছো নাচে রামায়ণ কাহিনীই মূল। এই নৃত্যের মূল বৈশিষ্ট্য হল, এখানে 'শ্রমের' চেয়ে 'লাবণ্যের' রূপটিকে বরং বেশি করে প্রস্ফুটিত করে তোলা হয়।"

চলবে...

Post a Comment

0 Comments