আমি আমার মতো
পর্ব -১২
সুকন্যা সাহা
লাইব্রেরি
আমার মতো গ্রন্থকীটকে বই সাপ্লাই দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল না ... ছোটোবেলা থেকেই গোগ্রাসে বই গিলতাম । মনে আছে একবার বন্যা হয়েছে , রাস্তা ঘাট ,বাড়ির তলা সব জায়গায় জল থই থই করছে । তার মধ্যেই খাটের এক কোণায় ঠিক জায়গা করে নিয়ে গোগ্রাসে গিলছিলাম পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা, তাও আবার টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোয়। এত গপ্পের বই পড়ার নেশা থাকার জন্যই ছোটোবেলাতেই সাত তাড়াতাড়ি মা পাড়ার মুকুলমেলা লাইব্রেরির মেম্বার করে দিয়েছিলেন ।সেখানে ছোটোদের জন্য বাংলা ইংরেজী বই মিলিয়ে হরেক কিসিমের বই সাজানো থাকত থরে থরে ।পড়ার সময়ে লুকিয়ে গপ্পের বই পড়ার নেশা এমন পেয়ে বসেছিল যে ক্লাস এইটেই পড়ে ফেলেছিলাম রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি। পরে আরও বহুবার পড়েছি। বিভিন্ন বয়েসে চোখের বালির মানে বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয়েছে ।কিশোর উপন্যাস , ছোটোদের বই পড়া তো চলতই সেই সঙ্গে বড়দের বই পড়াও বাদ যেত না ।আসলে সেই বয়েসে ছোটোদের বই , বড়দের বই এই বাছবিচারটাই ছিল না । যা হাতের কাছে পেতাম গোগ্রাসে পড়ে ফেলতাম সেটাই। ছোটোবেলা থেকেই বিভিন্ন লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ার একটা অভ্যেস ছিল আমার । আর সেই অভ্যেস কখন যে নেশায় পরিণত হয়েছিল নিজেরই অজান্তে ।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত হওয়া তো শুধু বই নয়... বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক ক্রিয়া কান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াও বটে । রবীন্দ্র জয়ন্তী , রবীন্দ্র প্রয়ান বার্ষিকী, নজরুল জন্মজয়ন্তী সবই পালন করতাম সাড়ম্বরে ।আরেকটু বড় হওয়ার পর মেম্বার হয়ে গিয়েছিলাম উল্টোডাঙ্গার স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরির । প্রায় প্রতিদিনই যেতাম ওই বিশাল লাইব্রেরিতে। নিঃস্তব্ধ রিডিং রুমে বসে সারাদিন পড়তাম। তখন চাকরির কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশান নিচ্ছি; আগ্রহ ছিল সাহিত্য থেকে ইতিহাস , জেনারেল নলেজ থেকে সায়েন্স সব বিষয়ে ।পড়ার নেশা আমায় এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে মাধ্যমিকের পর যখন পা ভেঙে যায় তিনমাস বিছানায় শুয়ে শেষ করেছিলাম বিমল করের "কড়ি দিয়ে কিনলাম" বিভূতিভূষণের উপন্যাস সমগ্র , শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলিও । মা অফিসের লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে হিমসিম খেতেন । ছোটোবেলা থেকেই বাতিক ছিল বই কেনার; আর পয়সার অভাবে বই কিনতে না পারলে শরণাপন্ন হতাম লাইব্রেরির । পরিণত বয়েসেও সংযুক্ত হয়েছি অফিস লাইব্রেরির সঙ্গে, বা পাড়ারই গান্ধী সেবা সংঘ লাইব্রেরির সঙ্গে । তবে লাইব্রেরি সম্বন্ধে আমার আজন্মলালিত কূপমণ্ডূক ধারণাটা সম্পূর্ণ বদলে যায় ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকেই । দেশ বিদেশের নানা বইয়ের বিশাল সংগ্রহই শুধু নয় , একটা লাইব্রেরি যে দু দেশের সাংস্কৃতিক জগতের সেতুবন্ধনের কাজ করতে পারে , পথ দেখাতে পারে অসংখ্য মেধাবী ছাত্রের বিদেশে পড়াশুনা করার ব্রিটিশ কাউন্সিলে না গেলে এসব আমার অজানাই থেকে যেত । আর একটা লাইব্রেরির কথা ভুলব না সারা জীবনেও ... সেটি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অসাধারণ লাইব্রেরিটির কথা ... ক্লাস শেষের অনেকগুলো দুপুর যেখানেই অধ্যয়ন করে কেটে গেছে আমার ।বইয়ের সংগ্রহের ব্যাপারে আমি চিরদিনই খুব পজেসিভ। কস্মিনকালেও কাউকে বই ধার দিতে চাইতাম না ... ধার দিলেও ধার যাতে পরিশোধ করে কড়া দৃষ্টি ছিল সে ব্যাপারে...এখন ইনফরমেশান টেকনোলজির ক্ষেত্রে বিপ্লব আসার পর বই পড়া এবং লাইব্রেরির ধারনাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন । এখঙ্কার ছেলে মেয়েরা অনলাইন লাইব্রেরি , জেড লাইব্রেরি বা কিন্ডলে বই পড়ার ব্যাপারে অনেক ওয়াকিবহাল।তবে বই পড়া মানে আজও আমার কাছে হার্ড কপি। প্রিন্টেড ভার্সনে বই পড়ার যে আনন্দ ও আমেজ তা যতই অনলাইন ভার্সনে পড়ি না কেন খুঁজেই পাই না ।
(ক্রমশঃ)
0 Comments