সোনালী আপেলের দেশে
সজল কুমার মাইতি
পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা আমার বরাবরের। পাহাড়ে নদী আছে, বরফ আছে,স্নো ফল আছে, গাছ পালা লতা গুল্ম আছে, ফুল ফল আছে, আকাশ আছে, পাকদন্ডী আছে। প্রতি মুহূর্তে আশা আশঙ্কা আছে। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য আর কোথায় পাওয়া সম্ভব? সেজন্য পাহাড় আমার বেড়ানোর প্রিয় স্থান। এই স্বপ্ন সুন্দরীদের দেখার ইচ্ছে আরও প্রবল হল আমার এক সহকর্মীর সদ্য বেড়ানোর অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে।
যেই ভাবা অমনি যাওয়ার টিকিট কাটা, থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা সব কমপ্লিট। মহানবমীর দিন রাত সাড়ে নটায় হাওড়া স্টেশন থেকে নেতাজী এক্সপ্রেস চেপে বসা গেল। ঘড়ির কাঁটা মেনে ঠিক সাড়ে নটায় ট্রেন ছাড়লো। ট্রেনের টু এসি কোচে আমাদের যাত্রা শুরু হল। আমরা মানে আমার পরিবার ও আমার বন্ধুর (আমার চেয়ে এক বছরের ছোট) পরিবার। এবারের ট্যুর আমাদের দুই পরিবারের মোট আট জনের। এর মধ্যে আমার বন্ধু রামের সদ্য বিবাহিত মেয়ে জামাই আছে। ট্রেন ছাড়ার কিছু পরেই সবার মন ডিনারের জন্য উচাটন হয়ে উঠলো। অগত্যা, সঙ্গে আনা ফ্রায়েড রাইস ও চিলি চিকেন দিয়ে আমাদের ডিনার শুরু হল। শেষ পাতে নিমাইদার ( আমার সিনিয়র সিটিজেন মর্নিং ওয়াকার বন্ধু ) দেওয়া গরম রসগোল্লা ও বোঁদে। লকঠাউনের পরে প্রত্যেকের লেট নাইটে ঘুমোনোর অভ্যাস। বেশ কিছুক্ষণ গল্প আড্ডা চলার পর যে যার বার্থে শোয়ার আয়োজন হল।
আমাদের এবারের এই বেড়ানোর প্ল্যানটার মূল বৈশিষ্ট্য হল একটু অফবিট জায়গায় যাওয়া ও থাকা। বিশেষকরে হোমস্টে ও রেজর্ট টাইপের জায়গাগুলোতে আমরা থাকার ব্যবস্থা করেছি। এবারের এই পুরো প্ল্যানটার কৃতিত্ব রামের বড় মেয়ে রোমির। এতদিন আমিই এসব করতাম। এবারে রোমি করেছে, অবশ্যই আমার সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করে নিয়ে ফাইনাইজ করেছে। আমরা একটা ট্রাভেলার আগে থেকে বুক করেছিলাম আমাদের পুরো ট্যুরের জন্য। পরের দিন রাতে ট্রেন আম্বালা পৌঁছতে ট্রাভেলার এর ড্রাইভারকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হল। ট্রেন চন্ডীগড় পৌঁছনোর আগেই ড্রাইভার ট্রাভেলার নিয়ে হাজির। তখন রাত চারটে। লাগেজ নিয়ে সবাই উঠে পড়লাম ট্রাভেলারে।
গাড়ি ধীরে ধীরে গতিলাভ করতে লাগল। সবাই মর্নিং টির জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। এত সকালে কোনো দোকান রেস্টুরেন্ট খোলা পাওয়া গেল না যেখানে চা ও স্ন্যাক্স পাওয়া যায়। অগত্যা গাড়ি চলতে থাকল, পাহাড় তার সৌন্দর্য অকৃপণভাবে বিতরন করছে। দুই দিকে পাইনের সারি অতিথি আপ্যায়নের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ভোরের মিষ্টি রোদ্দুর পাহাড়ের ফাঁক গোলে আমাদের চোখ মুখে আদরের হালকা স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। আবার পাহাড়ের আঁকে বাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে শিমলার কাছাকাছি এক জায়গায় 'শের ই পাঞ্জাব' রেস্টুরেন্ট দেখে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। সকালের চা খাওয়া হয় নি। তার ওপর ব্রেকফাস্ট ও হয় নি। এমনিতে রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সকালের প্রথম কাস্টমার আমরাই। সবাই তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়া গেল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ও বাইরে চেয়ার টেবিল পাতা ছিল। বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর। সবাই বাইরেই বসলো। চানা বটোরা, চিকেন স্যান্ডউইচ ও ম্যাগি। এরপরে চা ও কফি। তা এই চা এর অর্ডার দেওয়ার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি পাঠক বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার না করে থাকতে পারছিনা। আমার বন্ধু চা এর অর্ডার দেওয়ার সময় ওয়েটার বলে " এক কাপ লিকার চায়"। তা শুনে ওয়েটার একটু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ব্যাপারটা বুঝে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠি " এক কাপ ব্ল্যাক টি"। ওয়েটার হাসি মুখে চলে যায়। আসলে আমাদের এখানে 'লিকার চা' যতটা পরিচিত এখানে তা নয়। এখানে লিকার বলতে এরা ঐ একটা জিনিস ই বোঝে। অর্ডার দেওয়ার পর খাওয়া আসার সময়টুকু ও তর সইছে না। গরম গরম খাবার পৌঁছতে সবাই নিজের নিজের প্লেটে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া, গল্প, রোদের তাপ উপভোগ করতে করতে প্রকৃতি দেখা সবই চলল। সঙ্গে সঙ্গে চা কফি চলে এল। এটার খুব দরকার ছিল। সবাই এই খাওয়া এনজয় করলো বোঝা গেল। মুখসুদ্ধি খেয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। রাস্তায় রিজর্ট ম্যানেজারকে ফোন করে ফোন ড্রাইভারকে ধরিয়ে দেওয়া হল। কিভাবে পৌঁছনো যাবে ড্রাইভার সরাসরি বুঝে নিল। যেহেতু আমাদের রেজর্ট পাহাড়ের গা বেয়ে অনেক নিচে। একদম প্রান্তিক গাঁয়ের মধ্যে। সেজন্য ম্যানেজারের পরামর্শ মতো কুফরির পথে হর্স রাইডিং, জিপ রাইডিং, জিপ ক্লাইম্বিং এ আমাদের বাচ্চারা মেতে উঠলো। আর আমরা বুড়োরা ন্যাচারাল জুতে হরিন, বিভিন্ন পাখি, বানর, লেপার্ড ও অন্য অনেক পশুপাখি দেখে বেড়ালাম। কিছু কিছু কেনাকাটা ও করলাম। অবশেষে সবাই ফিরতে গাড়িতে উঠলাম।
গাড়ি ক্রমে ক্রমে পাহাড়ি বাঁক বেয়ে নামতে থাকলো। আমাদের ড্রাইভার যথেষ্ট দক্ষ প্রতি পদে তার প্রমাণ পাচ্ছিলাম। দুর্গম থেকে দুর্গমতর রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। অবশেষে প্রায় নির্জন এক জায়গায় হাজির হল। গাড়ি পৌঁছতেই রেজর্টের ম্যানেজার, রিসেপসনিস্ট এসে হাজির। খাতিরদারি কোন কমতি ছিল না। আমাদের জন্য পাহাড়ের কোলে দুটো ডুপ্লেক্স কটেজ বরাদ্দ ছিল। প্রায় দুদিন স্নান না করা বাঙালি প্রথম সুযোগেই বাথরুমের সদ্ব্যবহার করে ফেলল। সবাই শরীর মন শান্ত করে শিগগিরই রেজর্টের রেস্টুরেন্টে এসে হাজির। ছোটরা মেনু দেখে অর্ডার করে দিয়েছে। মোটামুটি কব্জি ঢুবিয়ে খাওয়া হল। খাওয়ার পরে প্রত্যেকে বিশ্রামের জন্য চলে গেল। আমার চোখে ঘুম নেই। রেজর্টের এক জায়গায় পাহাড় কেটে গোলাকৃতি করা হয়েছে। সেখানে বসার জায়গা করা হয়েছে পাথর ও কাঠ দিয়ে। সেখানে বসে প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপ অবলোকন সম্ভব। প্রকৃতির অনাঘ্রাত স্বাদ উপভোগ করা যায়। আমি তাই করছিলাম। মাঝে মাঝে দমকা শীতল হাওয়া শরীরে কম্পন ধরিয়ে দিচ্ছিল। অগত্যা, রুমের মধ্যে আশ্রয় নিতে হল। কিছুক্ষনের জন্য বিছানার ওম নিয়ে শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি করলাম। ইন্টারকমের মাধ্যমে বিকেলের কফি ও স্ন্যাক্স আর্ডার করে আনা হল। সবাই মিলে এই ঠান্ডার পরিবেশে কফি স্ন্যাক্স খেয়ে উষ্ণতার স্বাদ ও আনন্দ পাওয়া গেল।
কুফরির নির্জন গাঁয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শিমলা
পরের দিনের সকাল আমাদের জন্য অনেক কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সকালে সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভেঙে গেছিল। জানালার বড় পর্দা সরিয়ে যা দেখা গেল তাতে মন ভরে গেল। কাছাকাছি ও দূরের সব পাহাড়ের মাথা ও গায়ে হালকা বরফ চাদরে মোড়া। পাইন গাছগুলি বৃদ্ধার শ্বেতশুভ্র কেশরাজির মতো শোভিত হচ্ছিল। এই নয়নাভিরাম দৃশ্য বেড়ানোর আনন্দে যারপরনাই হৃদয় উদ্বেলিত করে তুলল।
বপরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা। রেজর্ট ম্যানেজার এত খুশি যে আমাদের ফিডব্যাক রিভিউের ভিডিও বানিয়ে ফেললেন। আজ লম্বা জার্নি। প্রায় দুশো কিলোমিটার পাহাড়ি পথ বেয়ে আমরা যাব কিন্নর জেলার সাংলায়। মহাভারতে এই কিন্নর প্রদেশের উল্লেখ আছে। পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময় এই প্রদেশে লুকিয়ে ছিল। আর এখানকার একটি বৈশিষ্ট্য হল পলিএন্ড্রি বা এক মহিলার বহু বিবাহ বা বহুস্বামী প্রথা প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ দ্রৌপদী প্রথার প্রচলন এই অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই অঞ্চলের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এখনকার Royal Red Apple অর্থাৎ বড় আকারের লাল আপেল জগদ্বিখ্যাত। মিষ্টি ও ক্রাঞ্চি। আর আছে Golden Apple অর্থাৎ হলুদ রসালো আপেল। এগুলি ও বিখ্যাত। এগুলোর বৈশিষ্ট্য রসালো, ক্রাঞ্চি। এদের shelf life অনেক দিন। এই দু প্রকার আপেলই পুরোপুরি এক্সপোর্ট হয়ে যায়। এখানকার মূল অর্থনৈতিক ফসল এই আপেল। এছাড়াও কিন্নরী রাজমা ও বিখ্যাত।
বিখ্যাত কিন্নরী রয়্যালরেড ও গোল্ডেন আপেল
ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে ছিলাম। রাস্তায় ভাল রেস্টুরেন্ট দেখে লাঞ্চ করার সুযোগ ঠিক হল না। আমাদের সঙ্গী হিসেবে চলছিল Sutlej বা শতদ্রু নদী। এর জল কিছুটা ঘোলা। পথিমধ্যে হাইডেল প্রজেক্টের ও দেখা মিলল। বাধ্য হয়ে পেটের চুঁইচুঁই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে রাস্তার ধারে একটি পরিচ্ছন্ন হোটেলে সব্জি ভাত ও ওমলেট দিয়ে ডিনার সাঙ্গ হল। রাস্তা যত এগোতে লাগল দুদিকেই আপেল বাগানের সারি পাল্লা দিয়ে এগোতে থাকল। ছোট বড় প্রতিটি গাছে লাল হলুদ / সবুজ আপেলে ভর্তি। এই আবাদে পাহাড় ও রক্ষা পাচ্ছে, উৎকৃষ্ট ফলে অর্থনীতি উজ্জ্বীবিত হচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। এই জায়গা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। দুই সখীর মিলনস্থল। শতদ্রু ও বসপা। বসপা নদীর স্বচ্ছ জল ও শতদ্রুর ঘোলা জলের মিলন এক অপূর্ব দৃশ্যের সূচনা করেছে। চারদিকে পাহাড় ঘেরা। উঁচুতে নির্মল নীল আকাশ। তার মাঝে ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি। পয়সা উসুল প্রাকৃতিক দৃশ্য।
এবার আমাদের সঙ্গী বসপা নদী। এই রাস্তা খুবই সুন্দর। গাছপালা তুলনামূলকভাবে কম। এরপরে রাস্তা একটু খারাপ হওয়ায় গাড়ির গতি মন্থর হল। আমাদের থাকার
বসপা নদী, ছিটকূল, সাংলা, কিন্নর
ব্যবস্থা হয়েছিল একটি জস্টেলে। এটি অনেকটা ইয়ুথ হস্টেলের আধুনিক রূপ। মূলত বাইকার ও ট্রেকার ইয়ুথ এদের টার্গেট অডিয়েন্স। থাকা খাওয়া সবকিছুরই সুন্দর ব্যবস্থা। কিছু কিছু ব্যাপারে সেল্ফ সার্ভিস। নিজেদের লাগেজ নিজেদের বয়ে আনতে হল। ডিনারের অর্ডার দিয়ে নিজেদের রুমে গেলাম ফ্রেশ হতে।
পরের দিন সকালে লিপি ও সুজাতা ( আমার স্ত্রী ও আমার বন্ধুর স্ত্রী ) বাগানে বেড়াতে বেরিয়ে গেল। আসলে জস্টেলের মধ্যেই আপেল বাগান। গাছ ভর্তি আপেল, গাছের তলায় ও অনেক আপেল পড়ে আছে। কুড়োনোর কেউ নেই। এখানে গাছ থেকে আপেল পাড়ায় নিষেধ ও জরিমানা। আমাদের দুই মহিলা আর লোভ সামলাতে পারে নি। বাগানে বেড়ানোর ছলে গাছের তলায় পড়ে থাকা কিছু বড় বড় আপেল কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। লিপির শরীর খারাপ থাকায় যেতে পারল না। এবার লক্ষ্য ছিটকূল। ইন্দো তিব্বত বা ইন্দো চীন বর্ডার সংলগ্ন শেষ ভারতীয় গ্রাম। যাওয়ার পথে দুদিকে ভর্তি আপেল বাগান। রাস্তা স্বপ্ন সুন্দর। উপরি পাওয়া সাথী বসপা নদী। দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম। শেষ প্রান্তে আর্মি পোস্ট। বিস্তীর্ন অঞ্চল। কিছু হোটেল রেস্টুরেন্ট। সঙ্গে প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্য্যরাশি। আকাশ এখানে যেন পাহাড়কে চুম্বন করছে। পাহাড় এখানে কোল্ড ডেজার্ট, গাছপালা শূন্য। কিন্তু, বসপা নদী কুলুকুলু রবে নিরন্তর বয়ে চলেছে। বসপার স্বচ্ছ জলরাশি শুধু এখানকার সৌন্দর্যবৃদ্ধি করছে না। এখনকার পশুপাখির, চাষবাসের জীবন রেখা। যাহোক, থেকে থেকে ঠান্ডা দমকা হাওয়া দিচ্ছিল। একটা ছোট রেস্টুরেন্টেে আমাদের লাঞ্চ সাঙ্গ হল। বসপাকে পেছনে রেখে বহু ছবি তোলা হল। অবশেষে একই পথে জস্টেলে ঢোকার আগে বাজারে গিয়ে কিছু ওষুধ, ফল ও সামান্য কেনাকাটা করে ফিরলাম।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। এবার যাত্রা তের হাজার ফিটের ওপর প্রায় স্বল্প বসতিপূর্ন অঞ্চল। প্রায় একই রুটে ফিরে একটু উঁচুতে ওঠা শুরু হল। এই রুটে রাস্তা সত্যিই সুন্দর। পথিমধ্যে লাঞ্চ সেরে নিলাম। গাড়ি একটু কষ্ট করে উঠে এল। এটি হল নাকো। উচ্চতা তের হাজার ফিটের অধিক। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে একটি হোমস্টেতে। আমাদের গাড়ি পৌঁছতে মালিক নিজে বেরিয়ে এসে লাগেজ নিয়ে ওপরে উঠে গেলেন। আমাদের ড্রাইভার কিছুটা সাহায্য করলো। যে যার রুমে ঢুকে যাওয়ার পর আর বেরুতে কারুর ইচ্ছে করছিল না। কারন বাইরে তখন দমকা শীতল হাওয়া। যে যার রুমে চায়ের পেয়ালা নিয়ে মুড়ি চানাচুর দিয়ে বিকেলের টিফিন সম্পন্ন করা গেল। হোমস্টেতে কোন টিভির ব্যবস্থা না থাকায় নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়ে সময় কাটলো। রাত নটায় ডিনার রেডি। ভাত, রুটি, ডাল সব্জি, চিকেন। মালিক ও তার মেয়ে মিলে আমাদের ডিনার পরিবেশন করলেন। গরম তাওয়া থেকে গরমাগরম রুটি সরাসরি আমাদের পাতে চলে আসছিল। বাড়ির মতো যত্ন করে খাওয়ালেন। আমরা প্রত্যেকে পরম পরিতৃপ্তি করে খেলাম।
পরের দিন সকাল একদম ঝলমলে। কোন হাওয়া নেই। সূর্য দেবতা হাসিমাখা মুখ নিয়ে গোটা পাহাড় জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। উল্টোদিকের পাহাড়ে তখনও রোদ্দুরের দেখা নাই। পর্বতশিখরগুলি শ্বেতশুভ্রকেশধারী মুনি ঋষির মতো লাগছিল। এখানকার নাকো লেক সত্যিই দর্শনীয়। সবাই রেডি হয়ে সকালের ব্রেকফাস্ট রুটি সব্জি, ওমলেট আর সঙ্গে গরম গরম চা খেয়ে কাজার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া গেল।
নাকোর পার্বত্য সৌন্দর্য, হিমাচল
কাজা লাহুল স্পিতি ভ্যালির অন্তর্গত এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ এলাকার একটি। উচ্চতা চোদ্দ হাজার ফুটের বেশি। এখনকার পরিবেশ লাদাখ অঞ্চলের সঙ্গে তুলনীয়। অনেকটা কোল্ড ডেজার্ট। গাছপালা, বৃষ্টিপাত কম। বরফের ছড়াছড়ি। সেই কাজার এক অফবিট হোটেল বা ডেন এ আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। নাকো থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিলাম। আসলে দূরত্ব যথেষ্ট, তার ওপর রাস্তা কিছু কিছু জায়গায় দুর্গম। শুরুতে রাস্তা খুবই সুন্দর কিন্তু মাঝে মধ্যে দুর্গম। কোথাও কোথাও স্লাইডিং জোন, পাথর রাস্তার ওপর এসে পড়ছে। রাস্তা খারাপ হলে গাড়ির গতি কমে যায়। ফলে গন্তব্যস্থল পৌঁছতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পথিমধ্যে কোথায় লাঞ্চ করা যায় সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে একটু ভুল বোঝাবুঝির জন্য যখন ক্ষিদেতে পেটে ছুঁচো ডন মারা শুরু করেছে তখন মরিয়া হয়ে রোডসাইড এক সাধারণ হোটেলে ওঠা গেল। সব্জি ভাত ও ওমলেট দিয়ে নমো নমো করে লাঞ্চ সমাপন হল। কিন্তু লোকেশনটা সত্যিই স্বর্গীয়। ওপরে নির্মল নীল আকাশ। মাঝে মাঝে সাদা তূলোর মতো মেঘের আনাগোনা। চারদিকে পাহাড়ের প্রস্তর কঠিন বেষ্টনী। নীচে দুই সই এর মিলনক্ষেত্র। শতদ্রু ও স্পিতি। শতদ্রুর জল একটু ঘোলা আর স্পিতির জল স্বচ্ছ পরিষ্কার। ফটোপ্রেমীদের স্বর্গ ক্ষেত্র। নয়নাভিরাম শোভা।
শতদ্রু স্পিতি নদীর মিলনক্ষেত্র, কিন্নর
এরপর আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। সাথী স্পিতি নদী। স্পিতির স্বচ্ছ জলের বেগ পাহাড়ের হৃদয় বিদীর্ন করে আমাদের সঙ্গে দৌড়ে চলেছে। মধ্যে তাবো ও ধনকড় মনাস্ট্রি অন্যতম দ্রষ্টব্য। এবার রাস্তা অনেক ভাল। যত আমরা এগুচ্ছি গাছপালার স্বল্পতা লক্ষ্য করা গেল। রাস্তা ও আবার খারাপ ও দুর্গম হল। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হাজির। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। কাঁচা চড়াই রাস্তা ধরে খুব কষ্টে ড্রাইভার আমাদের তুলে আনল। এখানে চোদ্দ হাজার ফুটের বেশি উচ্চতা। ঠান্ডা ও যথেষ্ট।
যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা ডাইনিং হলে হাজির হলাম। ততক্ষণে গরম গরম ভেজ পকোড়া ও চিকেন পকোড়া হাজির। সঙ্গে বড় পেয়ালায় চা ও কফি। যার যেমন পছন্দ। এরপর ডিনারের মেনু ও টাইম জেনে নিয়ে আমরা সবাই রুমে চলে এলাম। রাতে ডিনারে ফিক্সড মেনু। আনলিমিটেড বুফে। আটটা থেকে সাড়ে নটা ডিনার টাইম। রাতে মেঘের ঘনঘটা দেখা গেল। ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। রাতের টেম্পারেচার মাইনাস নাইনে নেমে গেল। তুষারপাত শুরু হল। পরের সারাদিন তুষারপাত চালু রইল। আমাদের লোকাল ট্যুরের প্রোগ্রাম বাতিল হল। চন্দ্রতাল লেক দেখা হলনা। পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। এরমধ্যে হাই অল্টিচ্যুডের জন্য আমার মেয়ের ঘাড় ও মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল। সারা রাত মেয়ের ও আমাদের ঘুম আদৌ হলনা। পরের দিন পাইপের জল জমে বরফ হওয়ায় আমরা জলের সমস্যায় পড়লাম। সকালে চা কফি খেয়ে ব্রেকফাস্ট প্যাক করে নিয়ে আমরা কল্পার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ফেরার পথে ছিছাম ব্রীজ ও তার সংলগ্ন সকালের বরফস্নাত গিরিরাজ তার অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলো।
ছিছাম সেতু, কাজা, হিমাচল
প্রায় একই রাস্তা ধরে আমরা কল্পা পৌঁছলাম। রাস্তায় আমাদের আগেরবারের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম। আজকের রাস্তা অনেকটা বেটার। কল্পা বাসস্ট্যান্ড বেশ বড় এবং বাজার ও বেশ জাঁকজমক। কল্পায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এক হোমস্টেতে। মেন রাস্তার কাছেই, কিন্তু একটু নিচে নামতে হবে। গাছের ডাল থাকায় আমাদের গাড়ি নামতে সামান্য একটু অসুবিধে হল। আসলে নিচে হোমস্টের সামনেই গাড়ির গ্যারেজ। অগত্যা, না নেমে উপায় নেই। আমাদের দেখে হোমস্টের মালিক এক সুদর্শন চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবক এগিয়ে এসে আমাদের রিসিভ করলো। লাগেজ নামিয়ে যে যার রুমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন রুম। প্রত্যেকের পছন্দ হয়েছে। হোমস্টে মালিক সুধাংশু চাকরির পেছনে না দৌড়ে নিজেই উদ্যোগপতির ঝুঁকি নিয়ে নিয়েছে। বি টেক পাশ হওয়া সত্ত্বেও চাকরির পেছনে না দৌড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় আগ্রহী হওয়ায় সত্যিই খুশি লাগছিল আমার। এ তো " Job seeker to job giver" পলিশি।
সন্ধের টিফিন হল চায়ের সঙ্গে ভেজ পকোড়া। রুমগুলিতে আধুনিক সব ব্যবস্থা থাকলে ও টিভির ব্যবস্থা ছিল না। রিশেপসনে একটি আধুনিক টিভি ছিল। অনেকদিন খবর দেখা হয় নি। আমি প্রথম সুযোগে খবর দেখতে বসে গেলাম। বাকিরা আড্ডায় মেতে রইলো। সাড়ে নটায় ডিনারে গেলাম সবাই মিলে। ডিনারে ভাত, রুটি, ডাল, সব্জি, চিকেন, এগ ভুর্জ্জি, পাপড়। রাতের খাওয়া শেষ করে আমরা সবাই শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের পরিশ্রম সহজেই নিদ্রা দেবীর কাছে পৌঁছতে সাহায্য করলো।
পরদিন ব্রেকফাস্ট করে লোকাল সাইট দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের সর্বোচ্চ জায়গায় এক কালী মন্দির। এরমধ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মিলিত প্রভাব লক্ষ্য করা গেল। আর একটি মনাস্টেরি ও চিনি গ্রাম নামে একটি লোকাল গাঁ দেখা হল। এর পরে একই রাস্তা ঘুরে বহুচর্চিত সুইসাইড পয়েন্ট এ যাওয়া হল। আমাদের মতো আরও অনেক পর্যটক ও ওখানে হাজির। দুপুর হয়ে গেছে। লাঞ্চের জন্য বাজারের মধ্যে পছন্দের রেস্টুরেন্টের খোঁজে গেলাম। না পেয়ে অন্য এক জায়গায় খাওয়ার অর্ডার দেওয়া হল। লাঞ্চের পর নেই নেই করে প্রত্যেকের ভালই মার্কেটিং হল। হোমস্টেতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল।
সুইসাইড পয়েন্ট, কল্পা, কিন্নর, হিমাচল
পরের দিন বেরোনোর তাড়া ছিল না। রিলাক্সিং মুডে সবাই ধীরে সুস্থে ঘুম থেকে উঠেছে। ব্রেকফাস্ট ও হালকা মেজাজে হল সবার। এরপর স্নান সেরে সবাই গাড়িতে উঠলাম নারকান্দার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা আমাদের বাড়ি ফেরার পথে আর একটু এগিয়ে যাচ্ছি। নারকান্দার যে রেজর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেটা একটু অফবিট জায়গায়। রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে। প্রকৃতির কোলে। সুন্দর লোকেশন। কিন্তু মেনটিনেন্স ও হসপিটালিটিতে একটু খামতি আছে। যাহোক, ওখানে একরাত্রি কাটিয়ে সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই। এবার যাত্রা চন্ডীগড় এয়ারপোর্ট। শিমলা হয়ে আমাদের গাড়ি পাহাড় থেকে নিচে নামতে শুরু করলো। এখানে রাস্তা খুবই সুন্দর ও ওয়ান ওয়ে। পাহাড়ি রাস্তা ওয়ান ওয়ে আর এত সুন্দর সচরাচর দেখা যায় না। শিমলার রাস্তা এতই সুন্দর। মধ্যিখানে লাঞ্চের জন্য এক রেস্টুরেন্টে ওঠা গেল। মনের মতো খাওয়ার না মেলায় বাপ বেটিতে ( রাম ও রোমি) একটু মন কষাকষি হল। অবশেষে পেট ভরে খেয়ে ও অনেক খাবার ফেলে আসতে হল। সুন্দর রাস্তা ধরে গাড়ি দ্রুতগতিতে নেমে চলেছে। সুন্দর পাইন ও অন্যান্য গাছের সারি সবুজের গালিচা তৈরি করেছে। এই সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি জনবহুল সমতলে প্রবেশ করল। ছ আট লেনের রাস্তা ধরে আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। এয়ারপোর্টে লাগেজ নিয়ে একটু সমস্যা হল। কিন্তু আমরা অনেকে থাকায় তার ও সুরাহা হয়ে গেল। সঙ্গে আনা রয়্যাল রেড ও গোল্ডেন আপেলের একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। দুঘন্টার আকাশ পথ শেষ করে দমদমে পৌঁছে ট্যাক্সির সমস্যায় আমরা বহু সুখ স্মৃতি নিয়ে মাঝরাতে স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ করলাম।
0 Comments