জ্বলদর্চি

দাবাড়ু দিব্যেন্দু বড়ুয়ার সাক্ষাৎকার নিলেন অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

দাবাড়ু দিব্যেন্দু বড়ুয়ার সাক্ষাৎকার নিলেন অভিনন্দন মুখোপাধ্যায় 


অভিনন্দন: আপনার ছোটবেলা নিয়ে কিছু বলুন। মানে কোন বয়স থেকে আপনার দাবার প্রতি আগ্রহ জন্মালো। 

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : আগ্রহ কোন বয়স থেকে জন্মেছে সেটা বলাটা এই মুহূর্তে সোজা। আমার যখন পাঁচ -সাড়ে পাঁচ বছর বয়স তখন বাবা বন্ধুর সঙ্গে খেলতেন। আমি পাশে বসে দেখতাম। সেটা দেখতে দেখতেই আমি শিখে গেছি। একদিন এইরকম খেলা চলার সময় আমি একটা চাল সাজেস্ট করি। তখনই বাবা বুঝতে পারেন আমি খেলাটা শিখে ফেলেছি। সেটা ১৯৭১-৭২ সাল নাগাদ হবে। যদিও প্রথমে বাবা আমার সাজেস্ট করা চালটাকে গুরুত্ব দেয়নি। ভেবেছে হাবিজাবি কিছু বলছি। কিন্তু পরে যখন দেখলেন যে চালটা ঠিকই বলেছি তখন তিনি বিষয়টা নিয়ে উৎসাহিত হলেন। বিভিন্ন লোকজনের কাছে খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন আদৌ এই খেলাটা নিয়ে চর্চা করা যায় কিনা, কোনো ফিউচার আছে কিনা। কারণ সেইসময় দাবা নিয়ে মানুষের মনে অন্য ধারণা ছিল। মনে করা হতো এটি বয়স্কদের খেলা কিংবা সময় কাটানোর খেলা। তখন বাচ্চারা দাবা খেলতোই না এবং বাচ্চারা দাবা খেলবে এই ধারণাই ছিল না। ১৯৭২ সালে আমি যখন প্রথম টুর্নামেন্ট খেলি, সেইসময় ববি ফিশার এবং বরিস স্প্যাস্কি, একজন আমেরিকান এবং একজন রাশিয়ান, এই দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ এর ম্যাচটার ফলে গোটা বিশ্বে দাবাটা ছড়িয়ে পড়লো। এই খেলাটার বিরাট অবদান  আছে আমার দাবা জীবনে। এই ম্যাচটার ফলেই বাবা বুঝতে পারলো, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ হয়, একটা অরগানাইজেশান আছে, খেলাটার গুরুত্ব আছে। তারপর থেকেই বাবা আমাকে খেলাতে শুরু করলো। তবে দাবা আমার কেন ছোটবেলা থেকে ভাল লাগে সেটা বলাটা বেশ কঠিন। তবে বাবা নিয়মিত নিয়ে গেছে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট। তখন ছোটরা কেউ দাবা খেলতো না। এভাবেই ১৯৭৮ সালে গিয়ে প্রথম সাকসেস পাই। এভাবেই দাবাতে চলে আসা।

অভি : দাবায় যে আগ্রহ তৈরী হলো তার জন্য কার ভূমিকা সর্বাধিক?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : নিঃসন্দেহে বাবা। বাবার জন্য আজ আমি এই জায়গায়। ওই সময় দাঁড়িয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল বাবাকে।শুনতে হয়েছিল, কেন খেলাচ্ছে আমায়, অর্থব্যয়, সময় নষ্ট, সময় কাটানোর খেলা, বয়স্কদের খেলা, ফিউচার নেই, বাচ্চা বখাটে হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই সময় কোনো পারফরম্যান্স না পাওয়া সত্ত্বেও বাবা আমাকে প্রথম ৬ বছর জেদ ধরে খেলিয়ে গেছে। সেটা না হলে আমি এই জায়গায় পৌঁছাতাম না। তবে বাবা ছাড়াও আমার ফ্যামিলি, কিছু কাছের মানুষজন যাঁরা আমার বিদেশ যাওয়ার সময় টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে তাঁদের সবার জন্যই আজ আমি এই স্থানে পৌঁছাতে পেরেছি। 

অভি : আপনার জীবনের প্রথম পুরস্কার কোনটি?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : আমার জীবনের প্রথম পুরস্কার ১৯৭৮ সালে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ। সিনিয়ার, জুনিয়ার এবং সাবজুনিয়ার, তিনটি বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হই। 

অভি: বিশ্বনাথন আনন্দের পরে আপনি দ্বিতীয় ভারতীয় গ্র‍্যান্ডমাস্টার। আমরা সবাই খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : (একটু হেসে) সেটি ভাষায় বোঝানো মুশকিল। তবে চাপমুক্ত হয়েছিলাম। 'কখন আমি গ্র‍্যান্ড মাস্টার হবো' এই ভেবে  বিগত কয়েক বছর বেশ চাপের মধ্যে ছিলাম। সেটা পেরোতে পেরেছিলাম। এতদিনের কষ্ট, শৃঙখলা সব কিছুর পর ১৯৯১ সালে এই অ্যাচিভমেন্টের অনুভূতি বোঝানো বেশ কঠিন। 

অভি : আপনার জীবনের সব থেকে কঠিনতম প্রতিপক্ষ কে এবং কেন?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : এটা বলা খুব টাফ। তবে আনন্দ ( বিশ্বনাথন) সব সময়েই টাফ। ও আমার থেকে তিন বছরের ছোট। পেছন থেকে উঠে এসে গ্র‍্যান্ডমাস্টার হয়েছে। ১৯৮৬-৮৮ অবধি আমরা ইন্ডিয়ান সার্কিটে খেলে বেড়াতাম। আমরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও বন্ধুও। ডেফিনেটলি আনন্দ সবসময় কঠিন প্রতিপক্ষ। ও প্রচন্ড ফাস্ট চাল দেয়। তখন আরো ফাস্ট চাল দিতো। ওকে সেইকারণে 'লাইটনিং কিড' বলা হয়। ওর আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভীষণ ভাল। তাই আমার বলার অপেক্ষা রাখে না যে ও কঠিন প্রতিপক্ষ, তবে সেটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ প্লেয়ারের ক্ষেত্রেই ও কঠিন প্রতিপক্ষ। 

অভি : এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থান কাকে দেবেন? 

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : সেটা বলা মুশকিল। আমার সময় যারা খেলেছে তাঁরা অনেকেই রিটায়ার্ড। কেউ কেউ খেলে বেড়াচ্ছে। তাই কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে দ্বিতীয় স্থান কাকে দেবো সেটা বলা টাফ।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

অভি : দাবার সার্কিটে সব থেকে প্রিয় বন্ধু কে? 

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : নীরজ আছে। নীরজ মিশ্র। ওর বাড়ি ভেলোরে হলেও রিষড়াতেই ওর সব কিছু৷ ছোটবেলায় আমরা একসঙ্গে অনেক টুর্নামেন্ট খেলেছি। বিদেশে গেছি। এছাড়া বাংলাদেশের নিয়াজ মুরশেদ আছে। আমার সমসাময়িক বয়েস। নিয়াজ চট্টগ্রামের ছেলে। আমিও চট্টগ্রামের সেইকারণে বন্ধুত্বটা আরো ভাল জমে। এই দুজন আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। 

অভি : বন্ধুত্বের কথা জানলাম। এরপরে যে প্রশ্নটা করবো, আমি জানিনা আপনি তার উত্তর দেবেন কিনা। দাবা সার্কিটে শত্রু কে?  

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : না না, সেরকম কিছু নেই। বোর্ডে যখন খেলছি তখন সবাই সবার শত্রু। (একটু হেসে) কিন্তু এমনি ব্যক্তিগত স্তরে কারুর সাথে শত্রুতা নেই। 

অভি : খেলা চলাকালীন এমন কোনো ঘটনার কথা আপনার মনে আছে যেটা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : ১৯৮২ সালে আমি লন্ডনে সেই মুহূর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় প্লেয়ার ভিক্টর করশেনাই-কে হারিয়ে ছিলাম। বিদেশে সাধারণত খেলা চলাকালীন হলের মধ্যে কেউ কথা বলে না। একদম পিনড্রপ সাইলেন্স। কিন্তু যখন আমি জিতলাম, মানে ভিক্টর করশেনাই যখন রিজাইন করলো এবং হাতটা বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করার জন্য, গোটা হল উঠে দাঁড়িয়ে হাততালিতে ফেটে পড়লো। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ হাততালি কেন? পরে বুঝলাম আমার জেতার জন্য। ওখানে যত মানুষ ছিলেন, লোকাল লোক কিংবা অন্যদেশের প্লেয়াররা, সবাই খুব এনজয় করছিল খেলাটা। একটা ষোলো বছরের বাচ্চা হারাচ্ছে ভিক্টর করশেনাইয়ের মতো প্লেয়ারকে, সে কারণে আমার প্রচুর সাপোর্টার হয়ে গিয়েছিল। জেতার পর তাই প্রচুর হাততালি পেয়েছিলাম। সেটা একটা অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। 

অভি : কোনো বিরক্তিকর মুহূর্ত?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : সেটা তো প্রায়ই হয়। বিশেষত হারি যখন তখন ভেতর থেকে একটা বিরক্তি উঠে আসে। যদিও এটা খেলারই অংশ। জীবনেরও অংশ। তবু হারলে এই বিরক্তিটা হয়। সবারই হয়। 

অভি : আপনি তো একটা দাবার একাডেমি চালান। সেটি চালাতে গিয়ে আপনি নতুনদের মধ্যে দাবা নিয়ে কতখানি উৎসাহ দেখতে পান?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : প্রচুর দেখতে পাই। আমি শুরু করেছিলাম ২০০৫ সালে। এখন ২০২২। এই ১৭ বছরে প্রচুর চেঞ্জ এসেছে। বাচ্চাদের এখন দাবাতে প্রচুর আগ্রহ। বাবা-মায়েদেরও প্রচুর আগ্রহ। দাবা এখন একটা পপুলার গেম। সবথেকে বড় কথা দাবা খেললে যে বাচ্চাদের ব্রেন শার্প হবে, যেটা তাদের একাডেমিক কেরিয়ারে সুবিধা দেবে, সেটা বাবা-মা'রা বুঝে গেছে। তাই তারা এখন বাচ্চাদের দাবা খেলতে উৎসাহ দিচ্ছে।

অভি : এই প্রজন্মের দাবাড়ুদের মধ্যে কাদের আপনার উজ্জ্বল নক্ষত্র বলে মনে হচ্ছে যারা ইন্ডিয়াকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? 

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : অনেকেই আছে। প্রজ্ঞানন্দের নাম তো এখন আমরা সবাই জানি। অসম্ভব ভাল খেলছে। সাউথের ডি.গুকেশ খুব ভাল খেলছে। নীহাল সারিন বলে একজন আছে। কুড়ি বছরের নিচে এদের বয়স। খুব প্রতিভাবান। বাংলাতেও অনেকে খুব ভাল খেলছে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে খুব ভাল জায়গায় আছি আমরা। ভবিষ্যতের জন্য ভীষণ আশাবাদী হওয়া যায়। 

অভি : প্রাপ্ত পুরস্কারগুলির মধ্যে কোনটিকে আপনার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : অবশ্যই 'অর্জুন পুরস্কার'। এই পুরস্কার পাওয়া জীবনের একটা বিশাল ব্যাপার। এটাই আমার সব থেকে বড় পাওনা। 

অভি : এই প্রজন্মের দাবাড়ুদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে?

দিব্যেন্দু বড়ুয়া : ভাল খেলে যেতে হবে। রেজাল্টের দিকে না তাকিয়ে থেকে খাটতে হবে। রেজাল্ট এমনিই আসবে। কিন্তু খেলে যেতে হবে নিয়মিত।

জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇

Post a Comment

0 Comments