জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র /অষ্টম পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                          অষ্টম পর্ব                  
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                            
                
এই পর্যন্ত বলে কর্ণ কিছুক্ষণ নীরব থেকে পুনরায় বললেন "বাসুদেব, আজ তোমার কাছে পান্ডবদের প্রতি আমার অন্তরের বেদনা প্রকাশ করে ভারমুক্ত হতে চাই। এযাবৎকাল সকলে দেখেছেন পান্ডবদের প্রতি আমি অনেক কটূবাক্য প্রয়োগ করেছি যা শালীনতার সীমা অতিক্রম করেছে, কিন্তু সেগুলি কেন প্রয়োগ করেছিলাম তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কেউ বোঝার চেষ্টা করেননি। সকলের ধারণা দুর্যোধনের মিত্রতা স্বরূপ তার প্রীতিবর্ধনের জন্য আমি সেই সকল বাক্য উচ্চারণ করেছি। দ্যূতক্রীড়ায় সভাস্থলে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাকালে পান্ডবদের নির্লজ্জ ঔদাসীন্যে আমার অন্তরে অপরিমেয় ক্রোধ উৎপন্ন হয়েছিল। আমার বাক্যতে যদি তাদের পৌরুষত্বের কিছুমাত্র জাগ্রত করতে পারি আমার সেই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সভাস্থলে দেখেছিলাম তাঁরা মস্তক অবনত করে বসে আছেন। আমার সেদিনের সেই নিন্দিত কর্মের জন্য আমি আজ অনুতপ্ত, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। বিরাট রাজ্যকে আক্রমণ করার সময় আমার কোনো সায় ছিল না, যার জন্য অনিচ্ছা সহকারে যুদ্ধে যোগদান করে অর্জুনের কাছে পরাজয় স্বীকার করেছিলাম। আজ তোমার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ আমার এই জন্মপরিচয় আগামী মহাযুদ্ধে আমার পতনের বা যুদ্ধ অবসানের পূর্বে কদাচ মহাত্মা যুধিষ্ঠির বা পান্ডবদের নিকট প্রকাশ করো না। তাঁদের কাছে আমার পরিচয় জ্ঞাত হলে তাঁরা আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না, উপরন্তু তাঁরা আমাকে জ্যেষ্ঠভ্রাতা হিসেবে গণ্য করে এই বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর করবেন। সে ক্ষেত্রে তার প্রতিদান হিসেবে আমি দুর্যোধনকে তা প্রদান করবো। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে সেই ইচ্ছা পোষণ করি না। পান্ডবদের প্রতি আমার আর কোনো ঈর্ষা বা বিদ্বেষ থাকল না। আর আগামী সংগ্রামে আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যে পক্ষে স্বয়ং বাসুদেব আছেন সেই পান্ডবদের জয় অবধারিত। যথা ধর্ম তথা জয়। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


রাজনীতিতে বা রণনীতিতে তোমার অপেক্ষা ধুরন্ধর পারদর্শী আর কেউ নেই। তুমি দ্রুত যুদ্ধের আয়োজন কর। শ্রেষ্ঠ ক্ষত্রিয় কুলে জন্ম গ্রহণ করেও যে সারা জীবন সেই পরিচয় গোপন থাকলো, সুতপুত্র বলে পরিচিত হলাম, সেই হতভাগ্য জীবনের দ্রুত অবসান হোক। জন্মের মুহূর্ত থেকে যে মাতৃস্নেহ ও মাতৃস্তনে বঞ্চিত হল, নিজের সহোদরদের প্রতি যে স্নেহ ও ভালবাসার অধিকার ছিল তাকে বিকৃত রসে জারিত করে বিদ্বেষ ও অসূয়াতে পরিণত করা হয়েছে। অন্ধ বিদ্বেষে যে পান্ডবদের চিরকাল অমঙ্গল কামনা করেছি সেই জীবনের আর জীবিত থাকার কোন অধিকার নেই। পূর্বেই তোমাকে বললাম মানসচক্ষে আমি দেখতে পাচ্ছি এই মহাসমরে পাণ্ডবেরা জয়লাভ করবেন। আমি নিশ্চিত সবান্ধবে দুর্যোধনের পরাজয় ঘটবে, গুরু দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নর হাতে নিহত হবেন, ধনঞ্জয়ের হাতে আমার মৃত্যু হবে"।  অগণিত ক্ষত্রিয় শোনিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ভূমিতে রক্তের নদী প্রবাহিত হবে। যুদ্ধশেষে মহাত্মা যুধিষ্ঠির রাজা হবেন, তাঁর পাশে বসবেন পাঞ্চালী, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের দুই পার্শ্বে মহাবীর বৃকোদর ও ধনঞ্জয়, চামর দোলাবেন নকুল ও সহদেব।              
কর্ণের সমস্ত কথা শোনার পরে বাসুদেব বললেন "কিন্তু তুমি যত সহজে এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ণয় করছ আমি কিন্তু তোমার মতের সাথে একমত হতে পারছি না। দেখ, যে পক্ষে পরশুরামের দুই শিষ্য - গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ও দেবত্রাস কর্ণ যুদ্ধ করবেন, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, শল্য প্রভৃতি মহারথীরা যে পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করবেন সে পক্ষের সহজে পরাজিত হবার বা ধ্বংস হবার কোন সম্ভাবনা আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। আর নিতান্তই যদি তুমি কৌরব পক্ষে যোগদান কর সত্য রক্ষার জন্য, ক্ষাত্রধর্ম রক্ষার্থে তুমি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে পরাজিত করা স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রেরও অসাধ্য যেহেতু ভগবান সূর্যদেবের আশীর্বাদী অভেদ বর্ম ও কবচকুণ্ডল তোমার অধিগত"।          
বাসুদেবের শেষের কথাগুলো শুনে কর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন সেই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ। তার অধরোষ্ঠে সঞ্চারিত হল এক রহস্যময় হাস্যরেখা। তিনি দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করলেন "বাসুদেব তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো পিতামহ ভীষ্ম যতক্ষণ যুদ্ধে সৈনাপত্য করবেন ততক্ষণ আমি অস্ত্র ধারণ করব না। হ্যাঁ, আজ মহাবীর ভীষ্মকে পিতামহ বলতে আমার কোনো ক্ষেদ নেই কারণ তিনি যেমন কৌরব ও পাণ্ডবদের পিতামহ তদনুরূপ আমারও পিতামহ বিশেষত আজ যখন আমার জন্ম রহস্য তুমি উদঘাটিত করে দিয়েছো। কিন্তু চিরকাল তিনি এই সত্য জেনেও আমার প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও কটু মন্তব্য করেছেন"। 
পুনরায় শ্রীকৃষ্ণ কর্নের দুহাত ধরে বললেন "ভাই, তোমাকে আমি সমগ্র ভারত ভূমির সাম্রাজ্য দেওয়ার অঙ্গীকার করলাম কিন্তু তুমি আমার সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে"। 
কর্ণ বিরক্ত বদনে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন "তুমি আমাকে যে রাজ্য, পঞ্চভ্রাতার সাহচর্য, দ্রৌপদীকে পাবার লোভ দেখাচ্ছ সেতো পূর্বেই আমার অধিগত যদি না আমার গর্ভধারিনী জন্মের পরেই আমাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নদীস্রোতে ভাসিয়ে দিতেন। যিনি আমার সর্বাপেক্ষা আপনজন হতেন তিনি আমাকে চিরদিনের জন্য সর্ব সুখ থেকে বঞ্চিত করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেও সারা জীবন সুতপুত্র বলে পরিচিত হলাম। একখণ্ড রাজ্য দিয়ে দূর্যোধন আমাকে চিরকালের জন্য তার রক্ষকরূপে চিরঅধীনতা পাশে আবদ্ধ করলেন। স্বয়ম্বর সভায় যদি হোমাগ্নিসম্ভূতা কন্যা আমাকে বিদ্রূপ বানে জর্জরিত করে প্রত্যাখ্যান না করতেন তাহলে তো সেই রমণী রত্ন আমারই হতেন। কষ্ট করে গুরু পরশুরামের কাছে যে শস্ত্রশিক্ষা লাভ করলাম তিনি এক লহমায় আমাকে ভুল বুঝে অভিসম্পাত করলেন। আমার মত ভাগ্যাহত, চির বঞ্চিত কাউকে তুমি এই রাজ্যের ভার নিতে বলো না।                       
যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ সব শোনার পরে অন্য কিছু আর মন্তব্য না করে শুধুমাত্র বললেন "বসুষেণ, ভার্গবের সেই অভিশাপ তো অন্তিম কালের জন্য। কিন্তু সহজাত বর্ম ও কবচকুণ্ডলধারী কর্নের তো সেই অন্তিম কাল আসার কোনো প্রশ্নই নেই যে পর্যন্ত এই দুটি বস্তু তাঁর অঙ্গে থাকবে"।       
                          
শঠচূড়ামণি শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের কাছে প্রকারান্তরে সেই দুটি বস্তুর হস্তগত করার অভিপ্রায় জানালেন। তাঁর কথা শুনে কর্ণ বললেন "বাসুদেব, তুমি ভালো করেই জানো প্রত্যহ গঙ্গা নদীতে বা অন্য কোন তীর্থে স্নান করে আমার আরাধ্য দেবতা সূর্যদেবের উপাসনা করার পরে আমার সম্মুখে যে কেহ উপস্থিত হয়ে কোন দ্রব্য প্রার্থনা করলে আমি সেই ব্যক্তিকে দানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং সে ক্ষেত্রে আমি নিজের বা পরিবারের পক্ষে সেই প্রার্থিত বস্তু শুভপ্রদ না হলেও আমি তা দান করি। সুতরাং আমাকে সহজাত কবচকুণ্ডলহীন করা আদৌ কোন দুরূহ কর্ম নয়। আর অস্ত্র নিক্ষেপকালে মন্ত্রের সাধনা যদি স্মরণে আসে তাহলে অর্জুনের নিকট এক নিমেষেই আমার মৃত্যু অবধারিত"। এইভাবে কর্ণ তাঁর মৃত্যুর রাস্তা বাসুদেবের কাছে অবারিত করে দিলেন।      
সব শোনার পরে বাসুদেব ঈষৎ অপ্রতিভ হয়ে কর্ণের দুটি হাত নিজের হাতে বদ্ধ করে বললেন "কর্ণ তুমি ধন্য, দানবীর বলে তুমি লোকসমাজে পরিচিত, কিন্তু আজ তার সত্যতা প্রত্যক্ষ ও পরীক্ষা করে নিজেকে ধন্য মনে করছি। বিধাতা তোমাকে রাজচক্রবর্তী হওয়ার সমস্ত গুণ ও মানসিক গঠন দিয়েছিলেন কিন্তু তুমি ভাগ্যাহত। অর্জুনের দুর্ভাগ্য নিজের জ্যেষ্ঠ অগ্রজের বিরুদ্ধে তাঁকে যুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে"।    
       
……….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

0 Comments