জ্বলদর্চি

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি (জাতীয় শিক্ষক, শিক্ষারত্ন, কবি ও গল্পকার)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন পর্ব -- ৪২

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি (জাতীয় শিক্ষক, শিক্ষারত্ন, কবি ও গল্পকার)

ভাস্করব্রত পতি 

"তুমি নদী হতে চাইলে
আমার বুকের সবটুকু জমি 
তোমাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি
যাতে তুমি স্বচ্ছন্দে বয়ে যেতে পার। 
তোমার সুগভীর সোনালি স্রোতে যাতে 
ছায়া খেলা করতে পারে – পরম মমতায়
তোমার দু’পাড়ে রোপণ করতে পারি 
আমার ভালোবাসার বট অশ্বত্থ তমালের 
সারি, কলমির বন, কাশের গুচ্ছ। 
তুমি যাতে শুকিয়ে না যাও – এক আকাশ 
বৃষ্টি হয়ে আমি ঝরতে পারি
অনায়াসে ভরে দিতে পারি তোমার শুখা চর,
প্লাবন চাইলে এনে দিতে পারি তাও। 
তুমি চাইলে তোমার জলে ছড়িয়ে দিতে পারি 
চাঁদ চিকচিক রূপোলি আলোর ঝিলিক,
তুমি চাইলে একা সওয়ারি হয়ে 
ভাসাতে পারি আমার ছোট্ট ডিঙিখনি। 
হে সুন্দরী, তুমি কী নদী হবে?"

নদী হতে ইচ্ছে করে সকলের। নদীর জলে চাঁদ চিকচিকে রূপোলি আলোয় সওয়ারি হতে ইচ্ছে করে অনেকের।  'একটি নদীর জন্য' কবিতায় কবি মঙ্গলপ্রসাদ মাইতিও চেয়েছেন নদী হয়ে কুলকুল করে বইতে। নদীর শীতল ধারায় সিনান করতে। নদীর জলে তৃষ্ণা মেটাতে। ছোট্ট ডিঙিখানি বাইতে বাইতে যে ক্লান্ত শরীরটাকে নদীর বহমান স্রোতে অবগাহনের ভাবনায় জারিত, সেই নদীর নাম শীলাবতী। আদরের শিলাই।

শিক্ষকতা তাঁর পেশা। কিন্তু কলম চর্চা তাঁর নেশা। সেই শীলাবতী নদীর পাড়ের হিমশীতল ছায়া তাঁর সাহিত্য চর্চার লীলাভূমি। যা সমৃদ্ধ করেছে শীলাবতীর উর্বরভূমিকে। উজ্জীবিত করেছে মেদিনীপুরকে। কথা সাহিত্যকে পাথেয় করে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক লেখাতেও সাবলীল হস্তের পরিচয় দিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বৃষ্টি বাদলের সাথে সখ্যতা ভালোবাসেন। শীতল জলসিঞ্চনের মায়াবী রসাস্বাদন তাঁর রচনার মূল সুর। বৃষ্টির প্রতি কবির টান চিরকাল। তাই তিনি লিখতে পেরেছেন --
 “তোমার অন্তর যেমন পুড়াতে পারি, 
তেমনি সেই অন্তরে বইয়ে দিতে পারি
শ্রাবণের রিমঝিম বারিধারা।” 
(রোদ বৃষ্টি : হাজার প্রেমের কবিতা)

এই মঙ্গলপ্রসাদের 'মঙ্গলীয়া চালি'তে (মঙ্গলহাঁড়ীর হলুদ মেশানো চাল) রয়েছে অনেক মনিমুক্তো। যা আমাদের চলার পথের 'মঙ্গলাষ্টক', ঠিক যেমন বিবাহকার্যে বরবধূর সৌভাগ্য প্রদানের জন্য ব্রাম্ভণ ঠাকুর আশীর্বাদ শ্লোকাষ্টক পাঠ করেন। এক কথায় অষ্ট মঙ্গলদ্রব্যামাত্র -- দধিদূর্ব্বাগবাদি প্রদান করেন। পরিচিত অপরিচিত অর্বাচীনদের সাথেও ভালোবাসার 'মঙ্গলসূত্র' গেঁথে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং বন্ধুত্বের 'মঙ্গলবাদ্য' আজ বাজাতে পেরেছেন এই 'মঙ্গলপ্রসাদ'। 
১৯৬৪ সালের ২ আগস্ট পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার রাজবল্লভপুরে জন্মগ্রহন করেন। বাবা সুধাংশু শেখর মাইতি এবং মা মেনকা দেবী। পুরো পরিবার শিক্ষাঙ্গনের আওতায়। তাই রক্তের ধারাতেও কলমের গন্ধ মেলে। কালীর সুবাস মেলে। আর কাগজের সংস্পর্শ মেলে। ভালোবাসার সুঘ্রাণ তিনি বইয়ে দেন দোয়াত ভরে। তিনি জাগতিক ভালোবাসা আর দৈহিক ভালোবাসার মিলন ঘটাতে পেরেছেন সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার সাথে। ভালোবাসার Definition তাই তিনি দিয়েছেন নিজস্ব ঢঙে, নিজস্ব ভঙ্গীমায় -- 
“ভালোবাসা অনেকটা নদীর মতো
কাউকে সে বলে না সে কোন পথ দিয়ে যাবে, 
অথচ সে ঠিক তার পথ খুঁজে নেয়। সোজাসুজি
কিংবা এঁকে বেঁকে সে খুঁজে নেয় সাগরের মোহনা
(ভালোবাসা আসে : হাজার প্রেমের কবিতা)
তেমনি তিনি লিখেছেন --
“গাছপালা বৃক্ষলতা যেভাবে ভালোবেসে মাটির বুকে শিকড় 
বিস্তার করে, সাগর যেভাবে ভালোবেসে নদীরে কাছে টানে 
সেই একই ভালোবাসায় তুমি আমাকে ভরে দিয়েছ।”
(সেরা জিনিস : হাজার প্রেমের কবিতা)
শিক্ষকতা করেন। এই পেশাতেও কখনো খামতি রাখেন না। কিন্তু অবসর সময় কাটে সরস্বতীর আরাধনা করেই। প্রাক কৈশোরকাল থেকেই তাঁর সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি। বঙ্গ সংস্কৃতির নিবিড় সাধনাকারী এই মানুষটি যেন সব্যসাচী। একাধারে শিক্ষক, -- কচিকাঁচার জীবনের প্রাথমিক পাঠ তাঁর হাত ধরেই। এঁদের বড় হওয়ার সোপান তাঁরই স্নেহাশ্রয়। সেইসাথে তিনি একজন প্রোথিতযশা কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার এবং সাংবাদিক। তাঁর কলমের ডোগায় উদ্ভাসিত হয় মানুষের কথা, ইতিহাসের কথা, প্রেমের কথা, জীবনের কথা, যৌবনের কথা আর মেদিনীপুরের রূপ রস বৈচিত্রের কথা। মেদিনীপুরের সরস মাটির পরশ লাগা এই সন্তানটি আজ সত্যিই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। আলোর পথযাত্রী তিনি। আলোকময় করে তুলেছেন এলাকাকে। নিজেকে। পরিবারকে। আসলে 'আলো' তাঁর কাছে বেঁচে থাকার দিশা। সেই আলো তিনি খুঁজে পান কবিতার মায়াজাল বুনে প্রেমিকার ভালোবাসায় --
“তোমাকে ভালোবাসা মানে আলোর কাছে থাকা,
আলোর সান্নিধ্যে থাকা।” 
(যুগ যুগ ধরে : হাজার প্রেমের কবিতা)

ভারত ও বাংলাদেশের বহু পত্র পত্রিকায় সীমাহীন ভাবে লিখেছেন বিভিন্ন ধরনের গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, প্রবন্ধ। এর বাইরে আকাশবাণী কলকাতায় প্রচারিত প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠান ‘প্রাত্যহিকী’র নিয়মিত পত্রলেখক। আকাশবাণীর মৈত্রীতে বহুবার পাঠ করেছেন স্বরচিত কবিতা। এই আকাশবাণী কলকাতাতে সেরা পত্রকারের সম্মানেও সম্মানিত হয়েছেন তিনি। আসলে সাহিত্যের নির্যাসটুকু তিনি উপভোগ করতে চান সর্বতোভাবে। 'নির্যাস' কবিতায় কবি লিখেছেন সেই সফলতা ও ব্যার্থতার চাপান উতোরের কথা --
"হাঁড়িতে চাল যখন ফুটতে থাকে 
উপরের চাল নিচে নামে, নিচের চাল 
উপরে উঠে। এই ওঠা নামার ক্রিয়াতেই 
একসময় শক্ত চাল নরম ভাতে
পর্যবসিত হয়। 
প্রত্যেকের জীবনেও আছে এই একই 
টানাপোড়েন। সফলতা ব্যর্থতার নির্যাসই
একসময় তাকে খাঁটি করে।"
   
তিনি একজন কথাশিল্পী। তাঁর রুচিশীল সাহিত্যকর্মের ঠাস বুনোটে বাংলা সাহিত্য প্রাণিত হচ্ছে। মঙ্গলপ্রসাদ মাইতির প্রতিটি কবিতা ও গল্পই হৃদয়গ্রাহী। তাঁর শব্দচয়ন এবং ভাষাপ্রয়োগ প্রতিটি রচনায় বিধৃত। সত্যিকারের একজন ভাষাসৈনিক পেয়েছে মেদিনীপুরের মাটি। যেকোনও রুচিশীল গল্পপ্রেমিক এবং কাব্যপ্রেমিকদের কাছে তিনি একজন সমাদৃত এবং পরিপুষ্ট কবি ও গল্পকার। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, প্রসাদ, দেশ, শুকতারা, নবকল্লোল, খাদি গ্রামীণ শিল্প বার্তা, আবার যুগান্তর, আরাত্রিক, সাথী হাতিয়ার, তবু একলব্য, ভাণ্ডার, নতুন পথ, এই সময়, আমার রুপসী বাংলা'র মতো সুনাম যুক্ত পত্রিকায়। এছাড়াও রাজ্যের অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখছেন নানা বিষয়ে। 

মঙ্গলপ্রসাদ মাইতির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল -- বাধা টপকানোর গান, হাজার প্রেমের কবিতা, তোমার কথা ফুরোয় না, তুই এলি বৃষ্টি এলো, ছন্দ বাঁধনে তুমি, দুস্টু শিশু মিষ্টি যিশু ইত্যাদি। তাঁর লিখিত গল্পগ্রন্থের তালিকাও বিশাল -- দেওয়ালের বাইরে, চমকাইতলা পেরিয়ে, পাথরের মানুষ, নির্বাচিত গল্প, উপত্যকার ঢাল, মরা নদীর কান্না, কন্যারত্ন, পলাশের রঙে এবং সোনার গ্রাম। এছাড়া লিখেছেন দুটি উপন্যাস -- কাজলা দিঘির নীলপরি এবং ভালোবাসার সেতু। লিখেছেন দুটি নাটক - বিদ্রোহী বীর অচল সিং ও অগ্নিশিশু ক্ষুদিরাম। প্রবন্ধের বই হিসেবে রূপে অরূপে বাংলা এবং কথা কই আকাশে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও আরো অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের সংখ্যা মিলিয়ে আরো পঁচিশ খানি বইয়ের লেখকের তকমা তাঁর ভাণ্ডারে। তেমনি প্রেমের কবিতা রচনাতেও সুললিত ভাবের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন অনেক লেখায়। 
 “কচি ধানের শিসে অপরূপ সৌন্দর্য আছে, 
হিন্দোল আছে, রূপ-লালিমা আছে 
তোমার সৌন্দর্য লালিত্য তারও চেয়ে বেশি।”
(তুমি আরও বেশি : হাজার প্রেমের কবিতা)
অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন নানা প্রান্ত থেকে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ২০১৭ তে পাওয়া জাতীয় শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন শিক্ষারত্ন সম্মাননা - ২০১৫, আপনজন স্মারক সম্মাননা - ২০১৮, পল্লীকবি জসীম উদ্দিন সাহিত্য পদক - ২০১৫, (বাংলাদেশ), কবি নিত্যানন্দ পুরস্কার - ২০১২, সাহিত্যাঙ্গন সুবর্ণ পুরস্কার, বাংলা সাহিত্য পদক - ১৪১৯, (বাংলাদেশ), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার, টেকচাঁদ ঠাকুর স্মৃতি পুরস্কার, মেদিনীপুর সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, (চন্দ্রকোণা), সারা ভারত কবি সম্মেলন পুরস্কার, (সমুদ্রগড়), রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, মহাবঙ্গ সাহিত্য পরিষদ, (কলকাতা) ইত্যাদি। এছাড়াও আরও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মান তিনি পেয়েছেন তাঁর নিরলস সাহিত্য কর্মের জন্য। এই পুরস্কার, সম্মান বদলে দিতে পারেনি তাঁর জীবনের চলমান ছন্দকে।  আসলে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন --
"আলোকিত সময়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে 
সময় যদি কাটে – কেটে যাক না,
কাউকে ভালোবাসতে বাসতে হৃদয় যদি 
নি:শেষ হয়, হোক না, জানবো – 
আমার চলার পথে ভুল ছিল না
আমি হেঁটে গেছি জীবনের দিকে।"

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

2 Comments