শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ত্রিগুণাতীত স্বামী উদ্বোধন পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনার কাজ করেন চার বছর। পরে স্বামী শুদ্ধানন্দ তাঁকে সহায়তা করতে থাকেন। নিয়মনিষ্ঠ, মিতব্যয়ী এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন ত্রিগুণাতীতানন্দজী। ভাবাদর্শের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে কখনওই নিরুৎসাহী বা হতাশাগ্রস্ত করে তুলতে পারত না। অসম্ভব কাজের চাপ সামলে সবসময়ই আনন্দিত থাকতেন। তাঁর ডেস্কে সবসময়ই মা দুর্গার একটি ছবি রাখা থাকত। জগজ্জননী তাঁকে মানসিক ও শারীরিক উভয়দিক দিয়েই সমৃদ্ধ করেছিলেন। একবার ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর বাড়িতে, যেখানে তিনি রাত্রে প্রায়ই থাকতেন, প্রায় ২২-২৩ কিলো ওজনের কেরোসিন তেলের টিন একতলা থেকে দোতলায় বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এক আঙুলে। খর্বাকার ও বলশালী মানুষ ছিলেন। কখনও কখনও একটি উঁচু টুলের উপর বই রেখে সারা রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। 
 ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত শ্রীশ্রীমা নীলাম্বর বাবুর বাগানবাড়িতে যখন অবস্থানরতা, সেইসময় তাঁর সেবক ছিলেন ত্রিগুণাতীত স্বামী। শরৎকালে একটি শিউলি গাছের তলায় সাদা চাদর পেতে রাখতেন, যাতে ফুলগুলি সরাসরি মাটিতে না পড়ে। শ্রীশ্রীমার সকালের পূজার জন্য প্রয়োজনীয় ফুলের আয়োজন এইভাবে করতেন তিনি। ১৮৯৯ সালে যোগানন্দ স্বামীর দেহত্যাগের পর শ্রীশ্রীমার সেবার দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন ত্রিগুণাতীত স্বামী, পাশাপাশি চলতে থাকে উদ্বোধন সম্পাদনার কাজ। মায়ের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে সর্বদা পছন্দ করতেন এবং এই কাজটিকে সততই অগ্রাধিকার দিতেন। ১৮৯৯ সালে শ্রীশ্রীমা গরুর গাড়ি সহযোগে বর্ধমান হয়ে জয়রামবাটীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ত্রিগুণাতীত স্বামী গরুর গাড়ির সামনে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকেন, হাতে একটি মোটা লাঠি। শ্রীশ্রীমায়ের দেহরক্ষী তিনি। মধ্যরাত অতিক্রম হয়েছে। হঠাৎই লক্ষ্য করলেন রাস্তার একস্থানে বিরাট ফাটল, বন্যার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গরুর গাড়ি ওই ফাটলের নিকটবর্তী হলে উপলব্ধি করলেন হয় গাড়ি উল্টে যাবে অথবা প্রচণ্ড ধাক্কা খাবে -- যার ফলে নিদ্রারতা মায়ের আঘাত লাগবার সমূহ সম্ভাবনা। এমতাবস্থায় তিনি তাঁর বলশালী দেহ ওই ফাটলের মধ্যে স্থাপন করে গাড়ির চালককে তার উপর দিয়ে গাড়িটি নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই ঘটনাটি ঘটার পূর্বে শ্রীশ্রীমার ঘুম ভেঙে যায় এবং সবকিছু দেখেশুনে শিষ্যকে হঠকারিতার জন্য তিরস্কার করেন।
 জয়রামবাটী থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় ত্রিগুণাতীতানন্দজী বৈদ্যবাটীতে কিছুক্ষণের জন্য থামেন। সেখানে একটি হোটেলে যান খেতে। হোটেল মালিক জানায় একবারের জন্য ভোজনে খাবারের দাম ছ'পয়সা। ত্রিগুণাতীতানন্দজী বলেন তিনি খুব ভালো খেতে পারেন, সুতরাং তাঁর ভোজনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দিতে পারলে খুশি হবেন। হোটেল মালিক অবশ্য জানায় সন্ন্যাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ তার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হোক সন্ন্যাসীপ্রবর ক্ষুধার্ত ছিলেন। তিনি খেতে শুরু করলেন। খাবার বলতে ডাল ও ভাত। হোটেলের খাবার পরিবেশনকারী তাঁকে খাবার দিয়ে চললেন হোটেলের সমস্ত খাবার শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত! দরিদ্র হোটেল মালিক এমতাবস্থায় তাঁর কাছে এসে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বললেন, “মহারাজ অনুগ্রহ করে এবার আসুন। আমার পক্ষে আর খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। আপনাকে কোনও টাকা পয়সা দিতে হবে না।” ত্রিগুণাতীত স্বামী হোটেল মালিককে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনার কথা বলতেন খুব আনন্দের সঙ্গে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


 শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একবার শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্যা যোগীন মা তাঁকে বলেছিলেন শ্রীশ্রীমায়ের জন্য কিছু ঝাল লঙ্কা বাজার থেকে কিনে আনতে। সবচেয়ে ঝাল লঙ্কার খোঁজে তিনি বাগবাজার থেকে বড়বাজার প্রায় ৪ মাইল রাস্তা হেঁটে ফেলেন। সব জায়গায় ঝাল লঙ্কা খেয়ে কতটা ঝাল তা নির্ধারণ করতে থাকেন। ফলে জিহ্বা ফুলে লাল হয়ে যায়। অবশেষে সবচেয়ে ঝাল লঙ্কার খোঁজ পান বড়বাজারে। কিনে আনেন মায়ের জন্য। শ্রীশ্রীমা এই ঘটনা শুনে বলেছিলেন --“কী গুরুভক্তি!” পরবর্তী সময়ে আমেরিকা থাকাকালীন শ্রীশ্রীমায়ের জন্য নিয়মিত অর্থ প্রেরণ করতেন।
আমেরিকায় ত্রিগুণাতীত স্বামীর কর্মকাণ্ড বিষয়ে গম্ভীরানন্দজী আলোকপাত করেছেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন --“১৯০৭ অব্দের মধ্যেই তিনি সানফ্রানসিসকোর বিদ্বৎসমাজে কিরূপ সম্মানের স্থান অধিকার করিয়াছিলেন, তাহা এক বিশিষ্ট ঘটনায় প্রমাণিত হয়। ঐ বৎসর ১১ ই এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীক্ থিয়েটারে সংস্কৃত সাহিত্যে সুপরিচিত শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ অভিনীত হয়, থিয়েটারে দশ সহস্র শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। গ্রীসীয় প্রথানুসারে পাহাড়ের সানুদেশে মুক্ত আকাশতলে মঞ্চের সম্মুখে অর্ধবৃত্তাকারে প্রস্তরনির্মিত আসনগুলি স্তরে স্তরে বিন্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট শ্রীযুক্ত বেঞ্জামিন আই ডি হুইলার দক্ষিণ দিক দিয়া ষ্টেজে প্রবেশ করিলেন। সে রাত্রির প্রধান অতিথি ছিলেন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ। এই থিয়েটারে প্রথমবারের অতিথি ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্ট। প্রধান অতিথি প্রবেশ করিলে সমবেত দর্শকমণ্ডলী দণ্ডায়মান হইয়া সম্মান জ্ঞাপন করিলেন।
 এইরূপে পাশ্চাত্ত্যের আদরে এবং স্বামী ত্রিগুণাতীতের প্রাণপন উদ্যমে কার্যের সর্বাঙ্গীন উন্নতি হইতে থাকিলেও কঠিন পরিশ্রমের ফলে তাঁহার শরীর ক্রমেই ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল এবং উহা নানা ব্যাধির আকর হইয়াছিল। শেষ পাঁচ বৎসর বাত প্রভৃতি কোন না কোন অসুখ লাগিয়াই ছিল। কিন্তু অসুখ হইলেও কর্মের বিরাম ছিল না। অত্যন্ত পীড়িতাবস্থায়ও তিনি ছাত্রদের সংবাদ লইতে ভুলিতেন না। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হইয়া পড়ে। তাঁহাকে রুগ্নদেহেও কার্য করিতে দেখিয়া জনৈক ঐ বিষয়ে প্রশ্ন করিলে তিনি বলিলেন, ‘অত্যধিক দৈহিক যন্ত্রণার সময় ভাবি, এই শরীর যাক, সব শেষ হয়ে যাক! কিন্তু শেষ তো হল না! যখনি মনে পড়ে যে মায়ের কাজ করতে হবে, তখনি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে শরীরটাকে ধরে রাখি। এ শরীরটা যেন একটা খোলসের মতো হয়ে গেছে -- যে-কোন সময়ে এটা খসে পড়তে পারে। গত তিন বৎসর শুধু ইচ্ছাশক্তি দিয়ে একে ধরে রেখেছি। যেই ছেড়ে দেব, অমনি এটা আপনা-আপনি পড়ে যাব’।”
 ১৯১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। বড়দিনের পরবর্তী রবিবার। ক্লাস ও বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়েছিল। ত্রিগুণাতীত স্বামী প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন। অকস্মাৎ লুই ভাবরা নামক এক ব্যক্তি তাঁর পাশে সাঙ্ঘাতিক একটি বোমা ফেলে দিল। সেই বোমার আঘাতে আততায়ী ভাবরাই প্রথমে নিহত হয়। মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে যান ত্রিগুণাতীত স্বামী। ভাবরা অপরিচিত ছিল না। সে হিন্দু মন্দিরে যাতায়াত করত, কিন্তু পরে উন্মাদরোগগ্রস্ত হয়। ত্রিগুণাতীত স্বামীর সান্নিধ্যে এসে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এর মধ্যে পুনরায় উন্মাদরোগে আক্রান্ত হয়ে হিন্দু মন্দিরে ফিরে এসে এই কাণ্ড ঘটায়। হাসপাতালে যাওয়ার সময় ত্রিগুণাতীত স্বামী তার খোঁজ করে বলেন, ‘কোথায় সে? আহা, নির্বোধ বেচারা!’ দিন পনেরো অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। অবশেষে ১০ জানুয়ারি, ১৯১৫ সালে সন্ধে সাড়ে সাতটায় মহাসমাধিতে লীন হন। সেই দিনটি ছিল স্বামী বিবেকানন্দের জন্মোৎসব।

Post a Comment

0 Comments