জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—উত্তর সুমাত্রা (এশিয়া)থাকো মাছে ভাতে /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প—উত্তর সুমাত্রা (এশিয়া)
থাকো মাছে ভাতে
চিন্ময় দাশ 
 
হাজার হাজার বছর আগের কথা। 
উত্তর সুমাত্রার মাঝামাঝি এলাকায় তোবাকারো লেক। সেখানে ছোট একটা রাজ্য। সে রাজ্যের রাজা বেশ জ্ঞানী। রাজা সুশাসকও। মানুষজন যেমন স্বচ্ছল, তেমনি সুখী। সেসময় খাদ্য বলতে বনের ফল। তখন ধান বা ভাতের নামও জানত না মানুষ। 
একবার ভারি সঙ্কটে পড়ে গেল প্রজারা। ভয়াণক খরা দেখা দিল সে বছর। প্রথমে ঘাস-পাতা জ্বলে গেল। খরা যত বাড়তে লাগল, বড় বড় গাছও শুকিয়ে যেতে লাগল। ফুল-ফল ঝরল বোঁটা থেকে। ডালপালা থেকে পাতা খসে গেল। মাটি শুকিয়ে ফুটিফাটা। 
তানাহকারো নামের একটা গ্রামে সমস্যা হোল বেশি। অভাবী এলাকা। হাহাকার করতে লাগল গরীব মানুষজন। 
বেরু ডায়াঙ নামের একটা বাচ্চা চেঁচাতে থাকে মায়ের কোলে বসে। খিদের জ্বালায় পেটে মোচড় দিচ্ছে তার। পেট যত মোচড় দেয়, বাচ্চাটা তত চেঁচায়। 
অভাবী মায়ের করবার কিছু নাই। ছেলেকে বুকে চেপে পিঠ চাপড়ায় আর সান্তনা দেয়—আর কটা দিন, বাছা। এ খরা কেটে যাবে। তখন আবার ফল ধরবে গাছে গাছে। আবার পেট ভরে খেতে পাব আমরা।
বাচ্চাটার কান্না তাতে থামে না। আছাড়ি পিছাড়ি খেতে থাকে মায়ের বুকে-কোলে। এক হাতে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলোয় মা। অন্য হাতে নিজের চোখের জল মোছে। আর কী-ই বা করবার আছে অভাবী মায়ের!  
দিন যায়। বাচ্চাটা কাঁদতেই থাকে। কাঁদতে থাকে আর রোগা হয়। রোগা হয় আর স্যাঁতা পড়ে যেতে থাকে। 
কত দিন আর এভাবে চলে? কত দিনই বা আর কেঁদেই যেতে পারে একটা শিশু? একদিন কাঁদবার জোরটুকুও আর রইল না তার বুকে। চোখে ঘুম নেমে এল। 
চোখের পাতা খুলবার ক্ষমতাও রইল না একদিন। মায়ের বুকে মাথা রেখেই চিরঘুমের দেশে চলে গেল বাচ্চাটা।
তখন সে কী বুকফাটা কান্না তার মায়ের! ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে ছেড়ে চলে যাস না, বাছা। এখন কী নিয়ে থাকব আমি? কী করে বেঁচে থাকব তোকে ছেড়ে?
পাড়াপড়শি সবাই মিলে কবরখানায় গেল। মাটি চাপা দেওয়া হোল অনাথ বাচ্চাটাকে। 
কাজ সেরে, পড়শিরা সবাই ফিরে গেলে, কবর ছেড়ে উঠে পড়ল মা। পায়ে পায়ে নদীর মুখ করে চলতে লাগল। 
চলাও এখন আর সোজা কাজ নয় তার পক্ষে। পেটে দানাটিও পড়ছে না কতো দিন। জোর কোথায় পা ফেলবার!
জোর নাই মায়ের মনেও। ছেলেকে ছেড়ে একা বেঁচে থাকবে, সেই জোর আর নাই তার। কতক্ষণ পরে, নদীর পাড়ে এসে পৌঁছলো মা। চোখে মুখে হাত ছোঁয়াল ভক্তিভরে। বিড়বিড় করে প্রণাম করল খোদাতালাকে—আমার ছেলেকে কোলে ঠাঁই দিয়েছ। আমাকেও নাও তুমি, ঈশ্বর!
বলেই ঝাঁপ। নদীর উঁচু পাড় থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মেয়েটি। ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে জীবন দিয়েছিল। নদীর গভীর তলায় এসে পড়ল যখন শরীরটা, ঈশ্বর তাকে একটা মাছ করে দিয়েছেন।
পাড়াপড়শি, গাঁয়ের লোকজন সবাই তখন লড়াই করে যাচ্ছে খরার সাথে, খিদের সাথে। তারা কেউ জানতেই পারল না, বাচ্চাটার মাও আর নাই। সে মাছ হয়ে গিয়েছে নদীর জলে। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


গভীর দুর্দশায় দিন কাটছে তানাহকারো গ্রামের লোকজনের। কারোর ঘরে খাবার নাই। প্রতিদিন কোনও না কোন ঘরে, কেউ না কেউ মারা পড়ছে। 
ছোট আর মাঝারি গাছপালা সব আগেই শুকিয়ে গিয়েছিল। এবার বড় বড় গাছও সব জ্বলে যেতে লেগেছে। তাকালেই দেখা যায়, পোড়া আঙরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।
গ্রাম জুড়ে ঘরে ঘরে কান্নার রোল। কিন্তু খরা কাটবার কোন লক্ষণই নাই।
একদিন দুটো ছেলে ঘুরতে ঘুরতে গ্রামের কবরখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই তারা অদ্ভুত একটা জিনিষ দেখতে পেল। দেখা গেল সেই বেরু ডায়াঙ-এর কবরের পাশটিতে। 
গ্রামের লোকেরা কেউ কখনও দেখেনি এমন জিনিষ। কী হতে পারে এটা, মাথায় ঢুকছে না কারও।
তখন খবর গেল রাজার ঘরে। রাজা এল পারিষদরা এল। কিন্তু চিনতে পারল না কেউই। কী করা যায়? রাজা মসজিদের মৌল্ভী সাহেবকে ডেকে আনল লোক পাঠিয়ে।
রাজার সামনে এসে, দাড়ি মোচড়াতে মোচড়াতে সব কথা শুনলেন মৌল্ভী সাহেব। সব সময় মিষ্টি একটা হাসি লেগেই থাকে মৌল্ভী সাহেবের মুখে। লোকেরা হাসির কারণ জানতে চাইলে, বলেন—এটুকুই আমাকে দিয়েছেন আল্লাতালাহ। এ তাঁরই দান। 
সব শুনে, তাঁর মুখের হাসি আজ বড় উজ্বল হোল। বললেন—না খেতে পেয়ে মরেছিল শিশুটি। গ্রামের জন্য এই জিনিষটি আজকে তারই দান। 
কথা শুনে, সবাই হাঁ করে রইল। বুঝতে পারল না কিছুই। মৌল্ভী সাহেব বললেন-- এটাকে কেটে ফেলো তোমরা। প্রচুর দানা পাবে এটার ভিতরে। জমি চষে, তাতে বীজ হিসাবে ছড়িয়ে দাও দানাগুলো।
তানাহকারো গ্রামের মানুষজন চিরকাল বনের ফলমূলই খেয়ে এসেছে এতদিন। জমি চষা, বা তাতে বীজ ছড়ানোর কলাকৌশল রীতিনীতি কিছুই জানা নাই তাদের। 
গ্রামের মানুষজনেরই বা দোষ কী? দেশের রাজাও কিছুই জানে না এ সম্পর্কে। ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে আছে রাজামশাইও। 
মৌল্ভী সাহেব বললেন—মাটি কুপিয়ে ঝুরোঝুরো করো। তাতে  দানাগুলোকে বুনে, জলের সেচ দাও যত্ন করে। তারপর দ্যাখো, ভোজবাজীর মত কাণ্ড ঘটবে। একশ’ দিন কাটবে না। তার মধ্যেই ঈশ্বরের খেলা দেখতে পেয়ে যাবে তোমরা। 
রাজা অবাক হয়ে বলল—কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
মৌল্ভী সাহেবের মুখে উজ্বল হাসি-- না খেয়ে আর মরতে হবে না আমাদের। বনের গাছে আমাদের খাবার নাই। লতায় নাই, পাতায় নাই। ফলে নাই, ফুলে নাই। আমাদের যা আসল খাদ্য, সব আছে মাটিতেই। একটু মেহনত করো। একটু যত্ন করো এবার থেকে। ঈশ্বরই আমাদের সবাইকে দেখবেন। 
মৌল্ভী সাহেব চলে গেলেন। রাজার হুকুমে কেটে ফেলা হোল কুড়িয়ে আনা জিনিষটাকে। সত্যিই ভেতরে অনেক দানা। 
লোকেরা হইহই করে মাঠে নেমে পড়ল। চাষ দেওয়া হোল জমিতে। সেই জমিতে বুনে দেওয়া হোল দানাগুলোকে। নদী থেকে তুলে এনে, জল ছড়িয়ে দেওয়া হোল দানাগুলোয়।
ক’দিন না যেতে, সবুজের আভা দেখা গেল পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ধূসর জমিতে। একটা-দুটো করে ফিনফিনে পাতা বেরিয়ে এসেছে মাটি ফুঁড়ে। 
দেখতে দেখতে গাছ বড় হোল। মাটি শুকোতে দিচ্ছে না লোকেরা। নদী থেকে জল তুলে আনার বিরাম নাই তাদের। কাদা কাদা করে দিচ্ছে মাঠের মাটি। একদিন বালির দানার মত ফুল এলো গাছে গাছে। ছোট্ট ছোট্ট ফুল। 
তার পর, একশ’ দিনও গেল না। হলুদ রঙ ধরল সবুজ গাছের মাঠ। দানার ভারে ভারি হয়ে উঠেছে ফসলের শিষগুলি। কাঁচা সোনার রঙ ধরেছে তাতে। 
মাঠের ফসল ঘরে তুল আনা হোল যখন, রাজা এলেন। এবার আর মৌল্ভী সাহেবকে ডেকে পাঠাল না রাজা। গাঁয়ের লোকজন, আর এক আঁজলা ফসল নিয়ে, নিজে হাজির হোল মসজিদে।
আজ মানুষটির হাসি আরও উজ্বল। রাজাকে বুঝিয়ে দিলেন, কী করে খোসা ছাড়িয়ে, দানা বের করে নিতে হবে ভেতর থেকে। মুখে তুলবার আগে, কী করে ফুটিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। 
গোটা তানাহকারো গ্রাম এখন হাজির আছে মৌলভী সাহেবের মসজিদে। তারা দেখছে, ফসলের এক একটা ছড়া পাওয়া গেছে, ছড়িয়ে দেওয়া এক একটা দানা থেকে। এখন দেখা যাচ্ছে, প্রতিটা ছড়ায় অনেকগুলো করে দানা। আনন্দের সীমা রইল না মানুষগুলোর। হই হই করে উঠল সকলে।
মৌল্ভী সাহেব বললেন— বেরু দায়াঙ নামের একটা শিশু এই ফসল দিয়েছে আমাদের জন্য। তার নামেই এই ফসলের নাম হবে-- বেরু দায়াঙ। (বাংলায় এই ফসলেরই নাম – ধান।) 
মৌল্ভী সাহেব রাজাকে বললেন-- আরও একটা কথা বলি, শোন। কথাটা জানো না তোমরা। ছেলে হারাবার শোকে, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে, জীবন দিয়েছিল বেরু দায়াঙ-এর মা। ঈশ্বর তাকে মাছ বানিয়ে দিয়েছিলেন। নদীতে গিয়ে দ্যাখো, নদী ভর্তি মাছ এখন। 
অভাবী পরিবারটি চিরদিনের জন্য অভাব মিটিয়ে দিয়ে গিয়েছে আমাদের। মাছ আর ভাতের জোগাড় করে দিয়েছে। আজ থেকে আর কোন দুঃখ রইল না আমাদের।
তখন থেকে ধানের চাষ শুরু হয়ে গেল মানুষের হাতে। কোন অভার রইল না কারও। মাটি আমাদের মা। সেই মাটিই মুখের খাবার জোগাতে থাকল মানুষের।



Post a Comment

0 Comments