জ্বলদর্চি

শমিত ভঞ্জ (অভিনেতা, তমলুক)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৬

শমিত ভঞ্জ (অভিনেতা, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি তমলুকের 'ছেনো'! ১৯৪৪ এর ২ রা জানুয়ারি জন্ম। তমলুকেই পৈতৃক ভিটে। প্রীতিময় ভঞ্জ এবং শীলা ভঞ্জের তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তিনি একজন। তিনি শমিত ভঞ্জ। বাকিরা হলেন অমিত, সবিত এবং কৃষ্ণা। বাবার কাজের সূত্রে ছোট থেকেই চলে যেতে হয়েছিল জামশেদপুরে। সেখানে ভর্তি হন লয়েলা স্কুলে। যদিও ফিরে এসে ভর্তি হন তমলুকের হ্যামিল্টন হাইস্কুলে। ২০০৩ এর ২৪ শে জুলাই মারা যান তিনি। সেই বসত বাড়িটি রয়ে গিয়েছে তমলুকের বুকে। বাকিরা কেউ নেই। শুধু রয়ে গিয়েছে একরাশ বিস্মৃতপ্রায় ঘটনা এবং এক জমাটি অভিনেতার অভিনয় দক্ষতার নিদর্শন। হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছে তাঁর কথা। বিশেষ করে এই প্রজন্মের কাছে শমিত ভঞ্জ একজন অপরিচিত ব্যক্তিত্ব। 
কিন্তু তিনি তমলুকের গর্ব। অভিনেতা শমিত ভঞ্জ বিপ্লবতীর্থ তমলুকের মানুষ। বাংলা সিনেমার এক অন্যতম বলীয়ান অভিনেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। তিনি তাঁর অভিনয় জীবনে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষদের মতো ভারত বিখ্যাত পরিচালকদের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। যা তাঁকে অন্য মার্গে পৌঁছে দিয়েছিল। মেদিনীপুরের বুক থেকে কলকাতায় গিয়ে রূপোলী পর্দায় যায়গা করে নেওয়ার কৃতিত্ব তিনি দেখিয়েছেন নিজের দক্ষতা, পারদর্শিতা এবং প্রবল ইচ্ছেশক্তির ওপর ভর করে। অভিনেতা শমিত ভঞ্জ যে মেদিনীপুরের মানুষ ছিলেন, তা অনেকেই জানেন না। কিন্তু অভিনয়ের কৃতিত্ব দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন। একসময়ে বাংলা সিনেমার নায়ক ও ভিলেন চরিত্রে তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। 
অভিনয়ের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুলের নাটকে অভিনয় করতে করতেই ইচ্ছে হয় সিনেমাতে অভিনয় করার। অভিনয় করার সেই ভূত মাথা থেকে নামাতে পারেননি সেই থেকে। স্কুল ছাড়ার পর ঝাড়গ্রাম পলিটেকনিক কলেজে পড়ার সময়ই কলকাতায় আসার ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। পলিটেকনিকে পড়া মাঝপথে বন্ধ করে শমিত কলকাতায় চলে আসেন। তারপর পড়াশোনাই ছেড়ে দেন। কলকাতায় গিয়ে নাটকের দলে যুক্ত হন। আর কাজ ছিল সিনেমা পাড়ায় ঢুঁ মারা। সেসময় অভিনয়ে চান্স পাওয়ার জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল আকাশছোঁয়া। বাবা চাইতেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করুক। আর তিনি চাইতেন 'লাইট ক্যামেরা সাউন্ড'! 

বলিউডের মেগাস্টার 'বিগ বি' অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও একটি ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন সমিত ভঞ্জ। কিন্তু এই ছবিটি হিন্দি নয়। 'জবান'(১৯৭২) নামের এই বাংলা ছবিতে অমিতাভ বচ্চন অতিথি শিল্পী ছিলেন। অভিনয় করার জন্য তমলুক ছেড়েছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও বন্ধ করে দেন। অনেক লড়াইয়ের পর তিনি পেয়েছিলেন পায়ের তলার মাটি। 

তমলুকে থাকাকালীন তিনি প্রেমে পড়েন রঞ্জার। সে তখন তমলুক কলেজের ছাত্রী। বেকার অবস্থায় বিয়ে করে ফেলেন। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তখন অন্য লড়াই। ভাড়া বাড়িতে থেকে কাজ খোঁজা। কলকাতায় থাকাকালীন একসময় আলাপ হয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অন্যতম সহায়। যাইহোক পরিচালকদের দোরে দোরে ঘুরে ঘুরে ছোটখাটো রোল থেকে একসময় পেয়ে যান নায়কের চরিত্র। শুধু অভিনয় নয়, তিনি ভালো গান করতেন, তবলা বাজাতেন। তিন মেয়েকে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার -- রাখী, বিদিশা এবং সহেলী। 

১৯৬৫ তে বলাই সেনের 'সুরের আগুন' সিনেমাতে হাতেখড়ি। প্রথম হিন্দি সিনেমা 'গুড্ডি'। নায়কের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন তপন সিনহার 'আপনজন'তে। এখানে পাড়ার দুই মস্তান রবি এবং ছেনোর দলবলসহ একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প ছিল। আসলে সমাজের সবচেয়ে খারাপ, বখাটে, মস্তানদের জীবন অবলম্বনে এটিই প্রথম বাংলা ছবি ছিল। মস্তান ছেনোর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন এখানে। কখনো তিনি ছেনো (আপনজন), কখনো ভজহরি মান্না (প্রথম কদম ফুল) চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের চোখে লেগে রয়েছেন আজও। তাঁর অভিনীত গিরিন (পরিনীতা), হরি (অরণ্যের দিনরাত্রি), নবীন (গুড্ডি), রাসবিহারী (প্রথম প্রতিশ্রুতি), বলরাম (রূপসী), প্রসেনজিৎ রায় (চিঠি), বিলাসবিহারী (দত্তা), রতন (হারমোনিয়াম), রেবেল (মৃগয়া), ড. চ্যাটার্জী (শহর থেকে দূরে), অনিরুদ্ধ (গণদেবতা), হারাধন (সানাই), রাজা রায়চৌধুরী (সবুজ দ্বীপের রাজা), অনিল (দাদার কীর্তি) চরিত্রগুলি একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে। 

শুধু অভিনয় নয়, কয়েকটি বাংলা ছবিও পরিচালনা করেছেন সমিত ভঞ্জ। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি 'ওরা চারজন' (১৯৮৮)। এতে নায়ক নায়িকা ছিলেন প্রসেনজিৎ এবং দেবশ্রী রায়। এছাড়াও পরিচালনা করেছেন 'সাধারণ মেয়ে' (১৯৯১)। এতে জুটি ছিল তাপস পাল এবং দেবশ্রী রায়। তাঁর পরিচালিত 'রাজার রাজা' (১৯৯৪) ছবিতে আবারও দেখা যায় প্রসেনজিৎ দেবশ্রী জুটিকে। এরপর 'বনফুল' (১৯৯৬) এবং 'ধর্ম যুদ্ধ' (১৯৯২) পরিচালনা করেন। শমিত ভঞ্জের পরিচালিত সর্বশেষ ছবি 'ভালোবাসা' (১৯৯৭)। উল্লেখযোগ্য যে, এখানেও নায়ক ছিলেন প্রসেনজিৎ। তবে 'উল্টো পাল্টা' নামে তাঁর পরিচালিত একটি সিনেমা শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। 
শমিত ভঞ্জ অভিনীত ছায়াছবি গুলি হল সুরের আগুন (১৯৬৫), হাটে বাজারে (১৯৬৭), আপনজন (১৯৬৮), প্রথম কদম ফুল (১৯৬৯), পরিনীতা (১৯৬৯), নতুন পাতা (১৯৬৯), বনজ্যোৎস্না (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), রূপসী (১৯৭০), গুড্ডি (১৯৭১), জননী (১৯৭১), আটাত্তর দিন পরে (১৯৭১), প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৭১), আজকের নায়ক (১৯৭২), শেষ পর্ব (১৯৭২), শপথ নিলাম (১৯৭২), জবান (১৯৭২), পিকনিক (১৯৭২), অচেনা অতিথি (১৯৭৩), ওহি রাত ওহি আওয়াজ (১৯৭৩), চিঠি (১৯৭৩), ফুলেশ্বরী (১৯৭৪), অসতী (১৯৭৪), আনজানে মেহমান (১৯৭৫), সালাম মেমসাব (১৯৭৫), কিতনে  পাস কিতনে দূর (১৯৭৬), হারমোনিয়াম (১৯৭৬), জীবন মরুর প্রান্তে (১৯৭৬), দত্তা (১৯৭৬), বিল্বমঙ্গল (১৯৭৬), এক বিন্দু সুখ (১৯৭৭), কবিতা (১৯৭৭), মৃগয়া (১৯৭৭), গোলাপ বউ (১৯৭৭), সানাই (১৯৭৭), স্ট্রাইকার (১৯৭৮),  সবুজ দ্বীপের রাজা (১৯৭৯), বনবাসর (১৯৭৯), দাদার কীর্তি (১৯৮০), পরবেশ (১৯৮০), উপলব্ধি (১৯৮১), কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), শহর থেকে দূরে (১৯৮১), রাজবধূ (১৯৮২), ফয়শালা (১৯৮২), উত্তর মেলেনি ১৯৮২), অমৃত কুম্ভের সন্ধানে (১৯৮২), রাজাবাবু (১৯৮২), রাজেশ্বরী (১৯৮৩), অভিনয় নয় (১৯৮৩), প্রায়শ্চিত্ত (১৯৮৩), দেবীগর্জন (১৯৮৪), দিদি (১৯৮৪), জীবন সাথী (১৯৮৫), দুই অধ্যায় (১৯৮৬), উর্বশী (১৯৮৬), শুধু তোমারই (১৯৮৮), যাঁর যে প্রিয় (১৯৮৯), ঝঙ্কার (১৯৮৯), আশা ও ভালোবাসা (১৯৮৯), গরমিল (১৯৯০), সুরের ভূবনে (১৯৯২), জুয়া (১৯৯২), রক্তেলেখা (১৯৯২), দাগী (১৯৯৪), বনফুল (১৯৯৪), সর্বজয়া (১৯৯৪), প্রতিধ্বনি (১৯৯৫), মোহিনী (১৯৯৫), দৃষ্টি (১৯৯৫) এবং আবার অরণ্যে (২০০৩)। 

এই 'আবার অরণ্যে'তে (পরিচালনা - গৌতম ঘোষ) তাঁর শেষ অভিনয় ছিল। ক্যানসার আক্রান্ত হয়েও চরম অসুস্থতার মধ্যেও তিনি অভিনয় করেছেন এতে। একজন অভিনেতার কাছে এটা ছিল প্যাশন। আসলে শমিত ভঞ্জের রক্তে ছিল অভিনয় দক্ষতা। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও ছাড়তে পারেননি অভিনয়। আর আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেলেন ডেডিকেশন কাকে বলে!  যে মুহূর্তে তিনি এই সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পান, সেই মুহূর্তে তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল 'ফ্যান্টাস্টিক'!


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

1 Comments