জ্বলদর্চি

গায়ত্রী জানা (ব্রতচারী প্রশিক্ষক, সঙ্গীতজ্ঞ, রাধামনি, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৫

গায়ত্রী জানা (ব্রতচারী প্রশিক্ষক, সঙ্গীতজ্ঞ, রাধামনি, তমলুক)

ভাস্করব্রত পতি

যেসব মানুষ কোনো অভীষ্ট সিদ্ধির লক্ষ্যে একাগ্র চিত্তে ব্রতী হয়ে ওঠে তিনিই 'ব্রতচারী'। জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য এবং আনন্দ - এই পাঁচকে নিয়ে ব্রতচারীর ভিত্তিভূমি। ব্রতচারীর ভাষায় এগুলিকে বলে 'পঞ্চব্রত'। প্রত্যেক ব্রতচারীকে এই পঞ্চব্রত পালন করতে হয়। আর যিনি এই ব্রতচারীর প্রতিষ্ঠাতা, তিনি হলেন গুরুসদয় দত্ত। আজ তাঁর দেখানো পথে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু মানুষ বয়ে চলেছেন ব্রতচারীর ঐতিহ্য। তাঁদের মধ্যে একজন পূর্ব মেদিনীপুরের রাধামনির গায়ত্রী জানা। একাধারে তিনি ব্রতচারী প্রশিক্ষক এবং সংগঠক। সেইসাথে সঙ্গীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী এবং সমাজ গড়ার কারিগর। এই অবক্ষয়িত সমাজে সারা জীবন ধরে ব্রতচারী আন্দোলনকে সারা বঙ্গে ছড়িয়ে দিতে নিজের জীবন উজাড় করে দিয়েছেন। ব্রতচারীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং টান আজ জেলা জুড়ে তাঁকে অন্য আসন দিয়েছে। হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন। 

চরম দূরদর্শী পুরুষ গুরুসদয় দত্ত বুঝেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বার্থে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশী চেতনার জাগরণ এবং ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মীলন করে তোলাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি কাজ৷ কারণ পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ রচিত না হলে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি মিলবে না। 
১৯৩২ সালে গুরুসদয় দত্ত চালু করেন ব্রতচারী শিক্ষা। ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনা ও নাগরিকত্ববোধ তৈরি করাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। তাই তিনি রায়বেঁশে, রণপা, কাঠিনাচ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের আঙ্গিককে প্রাধান্য দেন ব্রতচারীর মধ্যে। শুধু তাই নয়, তিনি ব্রতচারীর জন্য তৈরি করেন অসংখ্য গান। সেইসব গান আসলে ছিল সমাজশিক্ষার উপকরণ দিয়ে ঠাসা। গুরুসদয় দত্তের সেই ভাবধারাকে পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন। গায়ত্রী জানা তাঁদের মধ্যে একজন। আজীবন এই ব্রতচারীকে আশ্রয় করেই বেঁচে থাকতে বদ্ধপরিকর। ছাত্র ছাত্রীদের কাছে তিনি মন্ত্রপাঠের মতো শেখান ---
"ব্রতচারী হয়ে দেখো,
জীবনে কী মজা ভাই,
হয়নি ব্রতচারী যে সে,
আহা কী বেচারীটাই!”

১৯৯৩ তে পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ থেকে স্নাতক। পরবর্তীতে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের চলমান বাহিনীতে লোকসংস্কৃতি প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। একটানা নয় বছর কাজ করেছেন এখানে। যদিও ১৯৯১ থেকে রাধামনিতে ব্রতচারী চর্চা শুরু করেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে প্রথম ছেলে মেয়েদের কাছে ব্রতচারী প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করেন বাড়িতে। এ বছর ব্রতচারীর 'ব্রতমনি' অধ্যায় সমাপ্ত করেন। রাধামনির কেলোমাল গার্লস স্কুলেও প্রশিক্ষণ দেন। যদিও অফিসিয়ালি প্রশিক্ষণ শুরু করেন তমলুকের উত্তরচড়া শঙ্করআড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৯৭ এর ১ লা নভেম্বর। এরপর এই ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরে ব্রতচারী কেন্দ্রীয় নায়ক মণ্ডলী থেকে পান ব্রতচারী প্রশিক্ষকের তকমা। আসলে তার আগে ব্রতচারীর সাতটি ধাপ সম্পূর্ণ করে ফেলেছেন। ব্যাস, আর থেমে থাকার কোনো উপায় নেই। লাগাতর চলছে তাঁর কর্মযজ্ঞ। প্রতি বছর গড়ে ৪০ টি করে শিবিরে ব্রতচারী প্রশিক্ষন দেন কোচবিহার থেকে দীঘা, পুরুলিয়া থেকে কল্যানী পর্যন্ত। ২০০১ থেকে নিয়মিত যাচ্ছেন পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামে। এখানে একটি স্কুলের সাথেও জড়িয়ে রয়েছেন। 
১৯৮৬ থেকে শুরু করেন 'রাধামনি বিবেকানন্দ শিশু কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন'। এখন এই সংস্থার মাধ্যমে নাচ, গান, আবৃত্তি শেখানোর কাজ করে চলেছেন। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদের অধীনে রয়েছেন ২০ বছর। ২০০৬ থেকে শুরু করেন 'বিশ্ব ভূবনের ব্রতচারী' নামে পৃথক একটি সংস্থা। এই বিশ্ব ভূবনের ব্রতচারীর সচিব প্রধান গায়ত্রী জানার কথায়, ব্রতচারী শিবিরের মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীদের চরিত্র গঠন, সামাজিক শিক্ষার পাশাপাশি শরীরচর্চা, গান, নাচ এবং মানবিক সম্পর্ক গঠনের শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্রতচারীতে অংশ নেওয়া ছাত্র ছাত্রীদের উৎসাহ থাকে নজরকাড়া। 

গায়ত্রী জানার হাতের স্পর্শে আজ প্রায় পঞ্চাশ হাজার ছাত্র ছাত্রী ব্রতচারী প্রশিক্ষন পেয়েছে। যা অবাক করার মতোই। মোট ৪২২ টি শাখাতে এই প্রশিক্ষন দিয়েছেন তিনি। তবে এই মুহূর্তে সারা পশ্চিমবঙ্গের ১০০ টি শাখা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত রয়েছে। প্রতিটি শাখাকে গুরুজী তথা গুরুসদয় দত্তের প্রতিকৃতি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন। আর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে তৈরি করেছেন ৭০-৮০ জন প্রশিক্ষক। তাঁরাই বিভিন্ন শাখায় গিয়ে গুরুসদয় দত্তের সৃষ্ট ব্রতচারী ভাবধারার গান, ছড়া, বাণী শেখানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। ছাত্র ছাত্রীদের আগামী দিনে সুস্থ সবল নাগরিক হয়ে উঠতে ব্রতচারীর মতো শৃঙ্খলাপরায়ন প্রশিক্ষণ খুব জরুরি। 

অনেকের কাছে ব্রতচারী মানে 'দরিদ্র কালচার'! এর কোন ভবিষ্যৎ নেই। সারবত্তা নেই। কিন্তু তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল। ২০০৬ থেকে বিশ্বভুবনের ব্রতচারীর মাধ্যমে তিনি শেখানো শুরু করেন নবাঙ্কুর, আনন্দব্রতী প্রতিক, জ্ঞানাঙ্কুর ব্রতী প্রতিক, জ্ঞানাঞ্জন ব্রতী প্রতিক। সেইসাথে গুরুজীর সৃষ্টি করা ফৌজাল, নায়ক, নায়ক আলা রেখেছেন প্রশিক্ষনের অঙ্গ হিসেবে। 
১৯৪৮ এর একটা ঘটনা ভোল বদলে দেয় রাধামনি বাজারের। সেসময়েও এখানে হাট বসতো। তবে তা ছিল বেশ অপরিসর যায়গায়। হাটের মালিকানা ছিল মহিষাদল রাজাদের অধীনে। তাঁদের কাছ থেকে সেই হাট কিনে নেন মন্মথনাথ জানা, পঞ্চানন ভৌমিক এবং মন্টু সাঁতরা। শুরু হয়ে যায় রাধামনি হাটের উত্তরণ। ধীরে ধীরে এই হাট সম্প্রসারিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। আজ পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম জামা কাপড়ের হাট হিসেবে পরিগণিত। রাধামনি হাটের অন্যতম মালিক মন্মথনাথ জানার মেয়েই গায়ত্রী জানা। বাবার মতো জিনিস পত্রের সওদা করার কাজে নিজেকে জড়াননি। তিনি চেয়েছিলেন সংস্কৃতির সওদা। সেই লক্ষ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন যৌবন। না, মেয়ের মনোবাসনা বুঝতে পেরে মন্মথনাথ জানা কোনোদিনই বাধা হয়ে দাঁড়াননি।  আজ সেই রাধামনির হাটের বুকে এক চিলতে বাড়িতে বসে চলমান সংস্কৃতির সাথে বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পাঠদান করে করে চলেছেন নিবিষ্ট মনে, নিবিড়ভাবে। 

গায়ত্রী জানার কথায়, ব্রতচারী আন্দোলনে বিশাল একটা সংঘর্ষ। এটা সহ্য করা মুশকিল। একসময় আমাকে ছেড়ে সবাই চলে গিয়েছিল। পরে অনেকেই আবারও ফিরে এসেছে। আসলে জীবিকার তাড়নায় অনেকেই ছেড়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু এখানে দরকার সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম। আর শ্রমদান করার মানসিকতা থাকলেই একমাত্র সম্ভব সফলতা। সেটা তিনি বুঝেছেন ব্রতচারী আন্দোলনের মধ্যে নিবিড়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে।



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

2 Comments

  1. জ্বলদর্চি পত্রিকার প্রিয় লেখক ভাস্করব্রতপতি মহাশয়কে নমস্কার।🙏🌹🙏🌹🙏🌹🙏🌹🙏🌹🙏

    ReplyDelete
  2. আমার শিক্ষা গুরু শ্রদ্ধেয়া গায়েত্রী জানা মহাশয়াকে
    আপনার (ভাস্করব্রত পতি) লেখার মধ‍্য দিয়ে যে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে কঠিন সংগ্রামী সাংস্কৃতিক কর্ম জগতের কিছুটা অংশ অবগত করার জন‍্য আমাদের বিশ্ব ভুবনের ব্রতচারী (RVSCA) পক্ষ থেকে আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা, অভিনন্দন।
    দুই গুনি মানুষের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা
    ভালো থাকুন।

    ReplyDelete