আমি আমার মতো
পর্ব -১৮
সুকন্যা সাহা
বাসা-বাড়ি
ছোটো থেকে বড় হওয়ার পথে একজন মানুষ অজস্র মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন। তাদের কেউ আত্মীয় , কেউ বন্ধু কেউ বা শুধুই পড়শি । ছোটোবেলার কাঁচা মাটির মতো মনে এদের অনেকের চিরস্থায়ী ছাপ পড়ে যায় ।পরবর্তীতে তার চরিত্র গঠনে এদের অবদান থেকে যায় বিরাট। তেমনিই একজন মানুষের কথা আজ এখানে বলব । তিনি ছিলেন আমার মেজপিসি।আদর করে যাকে আমি মেজো বলে ডাকতাম। মনে আছে পিসি প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন , বাড়ি থেকে পালিয়ে ... নতুন বিয়ে করার পর বাসা ভাড়া করে এসে উঠেছিলেন এয়ারপোর্টের কাছে সুকান্ত নগরে । সেইসব দিনে প্রায় প্রতি রবিবার আমার নেমন্তন্ন থাকত পিসির বাড়িতে । তখন আমার কতই বা বয়েস! এই ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি...সেই বয়েসে আমাদের সময়ে এখনকার মতো পড়াশুনার সর্বগ্রাসী চাপ কোমল কৈশোরকে খেয়ে ফেলেনি বলে খানিকটা বাঁচোয়া ছিল । সুকান্ত নগরে পিসির বাসা ছিল গাছপালার ছায়ায় মায়ায় ঘেরা এক চিলতে একতলা বাড়ি। সেখানে নতুন সংসারে পিসি পিসেমশাই । মনে আছে পিসির বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে গেলে একটা বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে হত ।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
আসলে বাড়িটাই ছিল বাগান ঘেরা । একতলা বাসার উঠান ছিল লাল সিমেন্টের মেঝে । সন্ধ্যা হয়ে গেলে বারান্দাতেই বসে শোনা যেত ঝিঁঝিঁ পোকার কনসার্ট। অন্ধকারে ঝুপসি কালো কালো আম জাম কাঁঠালের গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকত নিশ্চুপ। আর বর্ষা কালে জল ভরা মেঘ নেমে আসত আমগাছগুলোর মাথায় মাথায়। কালো হয়ে আসা পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে গান গাইতাম আমি। মনে আছে খুব বৃষ্টি হলে বাগানে জল জমে যেত তখন যাতায়েতের অসুবিধে হত খুব। মূল রাস্তা থেকে বাসা পর্যন্ত ইঁট পাতা থাকত সেই ইঁটের ওপর দিয়ে ব্যালেন্স করে আসতে হত বাড়িতে । রবিবার মেনুতে থাকত মুরগীর মাংস ,ভাত, চাটনি আর দই । আমাদের নিজেদের বাড়িতে তখনও মুরগীর মাংসের চল ছিল খুব কম । পিসির বাড়িতে গেলেই মুরগীর মাংস খাওয়া হত । দু তিন বছর ছিল মেজ পিসিরা সেই সুকান্ত নগরের বাড়িতে । কাছেই এয়ার পোর্ট ; ছাদ থেকেই দেখা যেত বিকট শন্দ করে উঠছে নামছে বিমানগুলো। গরমকালে সেই আম বাগানে আম হত খুব। সময় বয়ে যায় দ্রুত । আমিও বড় হতে থাকি ধীরে ধীরে । পিসিরাও ওই বাসা বাড়ি বদল করে ... আমবাগানে ঘেরা একচিলতে বাসা বাড়ি স্মৃতিতে রয়ে যায় অমলিন।
বাসা বাড়ি বলতে যেমন চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুয়োতলা , কলপাড় ,একচিলতে শ্যাওলা ধরা উঠোন , দোতালার বারান্দার দড়িতে মেলা আধ শুকনো কাপড় চোপড় সেই রকম বাসাবাড়ির অভিজ্ঞত আমার কোনোদিনই হয় নি । হয়নি একাধিক ঘর ভাড়াটেদের সঙ্গে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার নিয়ে ঝাগড়াঝাঁটি করার অভ্যাসেও । আসলে আমার জন্মের বছরেই লেকটাউনে আমাদের নিজেদের বাড়ি হয় । তবে চিলেকোঠার ঘর , ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে দুপুরের পড়ন্ত রোদ্দুরে লুকিয়ে আচার খাওয়া এসব অভিজ্ঞতা তো ছিলই। ছোটোবেলায় আমাদের পাড়াটা নিতান্ত ঘরোয়া ছিল । সব বাড়ীগুলোই হয় একতলা বা দোতলা। সব বাড়ীতেই সংলগ্ন বাগান ছিল ।সবাই চিনত সবাইকে । আর ছিল পি এন পি সি করার অনন্ত অবকাশ । আজ পিছন ফিরে দেখলে মনে হয় সময় আর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ দুটোই যেন ক্রমশঃ ছোটো হয়ে যাচ্ছে ... (ক্রমশ:)
0 Comments