জ্বলদর্চি

একমুঠো ভিয়েতনাম(পঞ্চম পর্ব)/স্বপন কুমার দাস

একমুঠো ভিয়েতনাম
(পঞ্চম পর্ব)

স্বপন কুমার দাস


হা লং বে- তে  ১১০০এর বেশি দ্বীপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর সেই সব দ্বীপে আছে বড় বড় পাহাড়। আবার সেই সব পাহাড়ের পেটের মধ্যে আছে কেভ অর্থাৎ গুহা। ভূতাত্বিকদের মতে, এই সমস্ত পাহাড়ের মূল উপাদান হলো চুনাপাথর। অসংখ্য শম্বুক গোত্রীয় প্রাণির খোলশগুলির স্তুপাকার পরিণতি হলো এই সমস্ত পাহাড়। এই উপসাগরের সবচেয়ে বড় গুহাটির নাম হলো সারপ্রাইজিং কেভ। জাহাজ থেকে নেমে গুহাটিতে প্রবেশ এবং পরিদর্শনের সুবন্দোবস্ত করেছেন এ দেশের সরকার। দ্বীপটির প্রায় ১০০টি ধাপ উপরে উঠলেই পর্যটকেরা দেখতে পাবেন হা লং বে-এর মোহময়ী রূপ। এখানেই আমাদের যাত্রাপথের বিরতি। এখান থেকেই ফিরতে হবে আমাদের। আজ আর আলাদা করে ব্রেকফাস্ট করার সুযোগ নেই। ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ একসাথেই সেরে নিতে হবে। তার পর ছাড়বে ক্রুজ।
কেবিনে ফিরে আজ আমি সকাল সকাল স্নান সেরে নিতে বাধ্য হলাম। তারপর লাগেজ পত্র গুছিয়ে আমরা সবাই গেলাম ডাইনিং হলে। 


চেয়ার দখল করে বসার সঙ্গে সঙ্গে সার্ভিস বয় এসে হাজির। সবাই যে যার পছন্দের খাবার অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সার্ভ করলো ওরা। ভোর থেকে ডেকে দাঁড়িয়ে সাগরের রূপ দেখে মন ভরলেও পেট ভরেনি একটুও। সুতরাং, “ প্রাপ্তি মাত্রেন ভক্ষয়েৎ”।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফিরে এলাম কেবিনে। ততক্ষণে সব যাত্রীদের মধ্যে একটা তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে ক্রুজ। অনেকেই দোতলা এবং তিন তলা থেকে নিচে নামলেও আমরা আবার উঠলাম ডেকে। শেষ বারের মতো প্রেয়সী, রূপসী হ্যা লং বে সুন্দরীকে দেখতে হবে না?
ঠিক দুপুর ১২ টায় চলতে শুরু করলো ক্রুজ। “ আর সামনে নয়, এবার পেছন ফেরার পালা।” 
সেই চেনা পথ। সেই অনন্ত জলরাশি। তারই নীল বুক চিরে ফিরে চলেছে আমাদের ক্রুজ অ্যাডেলা। উপরে নীল আকাশ। দুপুরের জ্বলন্ত সূর্য। যাত্রা পথের দু’ধারে একের পর এক ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এগিয়ে আসছে সমুদ্রের বুকে অনাদি অনন্তকাল মাথা উুঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় পাহাড়। চলেও যাচ্ছে তারা।
আস্তে আস্তে করে গতি কমিয়ে ব্রেক করলো আমাদের ক্রুজ। একের পর এক সশব্দে জলে নামলো তীক্ষ্ণ ফলা যুক্ত নোঙ্গর। থামলো জাহাজ। বুঝলাম, এখানেই অ্যাডেলার যাত্রাপথের সমাপ্তি। নোঙ্গর করে দাঁড়ালো সে।আমরাও ডেকের থেকে নেমে এলাম নিচের তলায়।
তিরতির করে এগিয়ে এলো কয়েকটি স্পিড বোট। একে একে তারা  ঠেকলো জাহাজের গায়। প্রথমে লাগেজ, তারপর আমরা সওয়ার হলাম একে একে। 
ছাড়লো বোট। হাত নেড়ে বিদায় সংবর্ধনা জানালো ক্রুজের কর্মিবৃন্দ। মাত্র এক দিন এক রাত্রে আত্মীয় হয়ে ওঠা ক্রুজ কর্মীগুলোর জন্য সত্যিই কেঁদে উঠলো মনটা।
পিছন ফিরে সৈকত অভিমুখে ছুটলো আমাদের ছোট্ট জলযান।
তীরে তরী ভেড়া মাত্রই সেই একই ছবি। হুড়োহুড়ি আর গুঁতোগুঁতি। সব্বাই আগে নামতে চায়। এক মুহূর্ত তর সয়না কারুর। অগত্যা সবার শেষেই নামলাম আমরা। সমুদ্র সৈকতের সাদা সরু বালিতে সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে এসে উঠলাম বাঁধানো ঘাটে।
শেষবারের মতো মুগ্ধ বিস্ময়ে ফিরে তাকালাম ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো স্বীকৃত ভিয়েতনামের কুয়াংনি প্রদেশের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপসী হা লং বে-এর দিকে। মনে মনে উপলব্ধি করলাম, কেন ২০০৭ সালে এটিকে পৃথিবীর অন্যতম সপ্তাশ্চর্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

আমার একটা ব্যামো আছে। কোনখানে বেড়াতে যাওয়ার আগে সে সম্পর্কে একটু পড়াশুনা করা। ভিয়েতনামে আসার আগেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। হা লং বে সম্পর্কে আমি বিশদেই পড়েছি।
ভিয়েতনামি ভাষায় ‘হা লং’ কথার অর্থ হলো, মাটিতে নেমে আসা ড্রাগন। এই কথাটির সঙ্গে ‘বে’ অর্থাৎ উপসাগর শব্দটি যুক্ত হয়েছে।
আমাদের দেখার বাইরে আরও দেখার অনেক কিছুই আছে এই রূপসী উপসাগরের বুকে। যা এতো সংক্ষিপ্ত সময়ে উপভোগ করা সত্যিই অসম্ভব। 
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই উপসাগরের বুকে আছে চারটি ভাসমান গ্রাম। গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকেই এগুলিতে মনুষ্য বসতি রয়েছে। আজও প্রায় দু’হাজার মানুষ সেখানে বসবাস করে। তারা সবাই পেশায় মৎস্যজীবী। 
অনেকগুলি গুহা আছে এখানে। গুহাগুলি সত্যিই দর্শনীয়। এখানকার সবচেয়ে বড় গুহাটির নাম হলো, ‘সাঙ্গ সট’। যার অর্থ হলো, আশ্চর্য গুহা। গুহাটি সত্যিই আশ্চর্য সুন্দর। গুহার ছাদের পাথরের কার্য্য নজর কাড়ার মতো। চোখ ফেরানো যায় না। এ ছাড়াও এখানকার ‘মেজ কেভ’ টিও একটি বিস্ময় গুহা। আলোকের প্রতিফলনের কারণে এটি অত্যন্ত রহস্যময়। ঠিক যেন গোলকধাঁধা।
হা লং বে- এর ‘চুয়া ভান ফিশিং ফ্লোটিং ভিলেজ’ টি  নাকি বিশ্বের একটি সুন্দরতম গ্রাম! স্থানীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি ও জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় এই গ্রামে। এ ছাড়াও ‘ভুং ভিং ফিশিং ফ্লোটিং মার্কেট’ আছে এখানে। সমুদ্র বক্ষে মাছ কেনা বেচা হয় এই ফ্লোটিং মার্কেটে।
 হা লং বে -তে যা আছে তা দেখে শেষ করার নয়। এতো অল্প সময়ে তো নয়ই। যাক্ কিছুটা তৃপ্তি আর কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই হাঁটলাম গাড়ির উদ্দেশ্যে।
নির্ধারিত গাড়িতে লাগেজ তুলে দিয়ে আমরা সীট দখল করে বসলাম। ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে বসেই ছিল। আমরা সীটে বসার পরক্ষণেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। সেই চেনা পথ ধরেই ফিরছি আমরা। গন্তব্য, হ্যানয় শহরের  সেই শেরেটন হোটেল।
টানা ঘণ্টা দেড়েক পরেই গাড়ি থামলো একটি হল্টিং স্টেশনে। আমরা কিছু বোঝার আগেই ড্রাইভার তড়িৎ গতিতে গাড়ি থেকে নেমেই পালালো খেতে।  ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজীতে বলে গেল, ওর খুব খিদে পেয়েছে।
গাড়ির দরজা বন্ধ। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গাড়িতেই বন্দি হয়ে বসে থাকলাম পাক্কা আধঘণ্টা। তারপর ড্রাইভার দ্রুত গতিতে ফিরে এসে গাড়ির দরজা খুলেই সবিনয়ে সরি সরি বলে  আমাদের নেমে যেতে অনুরোধ করলো। আরও বললো, আধঘণ্টা পরেই ছাড়বে গাড়ি। বুঝলাম, খিদের জ্বালায় বেচারার মাথা কাজ করছিল না। যাই হোক্, আমরা সাবাই নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। তক্ষুণি  কারুর খাওয়ার দরকার ছিলনা। টুকিটাকি কেনাকাটা করে যথাসময়েই ফিরে এলাম গাড়িতে।
কিন্তু ততক্ষণে সঙ্গী গাড়িগুলো সবাই পলাতক। আমাদের গাড়িটা একা। নির্জন পথে ঝড়ের গতিতে ছুটলো গাড়ি। 
বিকেল পাঁচটার পরে পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম হোটেলে। তারপর একটু ফ্রেশ হয়েই গেলাম চা খেতে। পথের ক্লান্তি ঘুচাতে একটু চা না হলে আর চলছিল না।
আজ সন্ধ্যায় তেমন কিছু প্রোগ্রাম ছিলনা। হোটেলের কাছেপিঠে বাজারে টুকিটাকি কেনাকাটার পর বাইরেই নৈশভোজ সেরে ফিরে এলাম হোটেলে। পথশ্রমের কারণে এক ঘুমেই রাত কাবার। গাত্রোত্থান করেই সোজা জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। শেষ বারের মতো দু’চোখ ভরে দেখলাম মোহময়ী হ্যানয় সুন্দরীকে। 
বিয়োগ ব্যথায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মেঘাচ্ছন্ন আমার মনটাও। যাই হোক্, ন’ তলার জানালা থেকে শহর হ্যানয়ের একটা ফটো নিয়েই আমি আমাতে ফিরে এলাম।                        
এবার যাওয়ার পালা। ১১টা ৫৫ মিনিটের ফ্লাইটে আমাদের ফিরতে হবে সিঙ্গাপুর। সুতরাং সকাল সকাল স্নান ইত্যাদি সেরে, একেবারে তৈরী হয়েই গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। তারপর চেক আউট পর্ব শেষ করে, লাগেজপত্র নিয়ে উঠলাম গাড়িতে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম হ্যানয় ইন্টারন্যাশনাল এয়ার পোর্টে। তারপর সিঙ্গাপুর ফ্লাইটে চড়ে বসলাম আমরা। যথা সময়েই আকাশে উড়লো ফ্লাইট। 
টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা আমার শরীরটা ফ্লাইটের সীটবেল্টে আটকা থাকলেও মনটা সেখানে ছিল না। মনটা সারাক্ষণ  ঘুরে বেড়াচ্ছিল ভিয়েতনামে আমার দেখা আর অদেখার জগতে। মন বলতে চাইছিল, “আবার আসিব ফিরে………..”।
আর ভিয়েতনাম আসা হবে কিনা জানি না, তবে ভিয়েতনামের যেটুকু দেখেছি সেটুকু আমার মনের মণিকোঠায় আজীবন অম্লান হয়ে থাকবে।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇

Post a Comment

0 Comments