জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৬৫/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬৫   

   খুবই চাপের মধ্যে আছি, দিন দিন চাপ বাড়ছে। তবে উনি এখন অনেকটাই সুস্থ, আজ একা একা   ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন। এটুকুই অনেক। যদিও তাতে আমার ভার কিছু লাঘব হচ্ছে না। আগামিকাল খড়গপুর যাব খোকনকে (ইএনটি ‘এফ আর খান’) দেখাতে। দুজনেই একবার  দেখিয়ে নেব। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোথাও তেমন একটা যাওয়া হয় না। আমার হলেও খান সাহেবের হয়  না। আমাকে দৌড়াতে হয় কাজের প্রয়োজনে। আজই সকাল থেকে কোথায় কোথায় দৌড়েছি, তার ঠিক নেই। সকালে বাজার করে এনেছি, রান্না শেষ করে আবার  বেরিয়েছি জেরক্স করতে দেওয়ার জন্য। বিকেলে এল আই সি থেকে ওনার ওষুধ কিনে আনলাম। দাসেদের দোকানে আমার ঘুমের ওষুধের জন্য প্রায় ১ ঘণ্টা দাঁড়াতে হল। তারপর ফোনের দোকানে গেলাম। সেখান থেকে একজনের বিষয়ে জানার জন্য তাঁর বাড়ি গেলাম। ইনি একজন বৃহন্নলা, বয়স প্রায় ৭০/৭২ হবে। ইনি বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ের সমস্ত রকম দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই ওনাকে নিয়ে কিছু একটা ভাবছি।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


           এভাবে ব্যস্ততার মধ্যেই দিন কাটছে। ব্যস্ততাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিভাবে দিন, সপ্তাহ, মাস কেটে যাচ্ছে তার আর হিসেব রাখিনা। রবি সোমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই আমার জীবনে। আজ খান সাহেবকে নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলাম। মোটামুটি সব ঠিক থাকলেও হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। তার  জন্য সপ্তাহে ১টা করে ইঞ্জেক্সন নিতে হবে। বাইরে যাওয়া যাবে কি না জানতে চাইতে বললেন, যেতে পারেন, অসুবিধা নেই। তবে ওষুধ, ইঞ্জেক্সন সঙ্গে নিয়ে  যেতে হবে। মেয়ের কাছে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেও সমস্যা হচ্ছে বাড়িতে কে থাকবে? এখন ভাড়াটিয়াও নেই।

     ২২ এপ্রিল বিকেলে মুকুলও ঝরে গেল। এমন নিদারুণ ঘটনা ইতিহাসেও মিলবে না। পরদিন সকালে আমি, খান সাহেব ও পাপু গেছলাম। আমি ওর মুখ  দেখিনি, সহ্য করতে পারব না। মেয়েকেও জানাইনি। এসব থেকে কিছুটা সময় আমাকে দূরে রাখে একমাত্র আমার লেখা। আজ বর্তমানের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ৭ মে আমার ভ্রমণকাহিনীটি সাপ্তাহিক বর্তমানে প্রকাশিত হবে। জীবনে আনন্দ বলতে এটুকুই। কয়েকদিন পরে আরম্ভ পত্রিকার অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার লেখাটি মে  মাসের সংখ্যায় ছাপা হবে।

      ছেলেটা (মুকুল) চলে গেল, তার কাজও হয়ে গেল। এভাবেই দিনে দিনে সময়ের চাপে সব ইতিহাস হয়ে যাবে, যে ইতিহাস কেউ খুলে দেখবে না। ঘুমের  মধ্যে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠি। ঘুমের ওষুধেও কাজ হয় না। সাপ্তাহিক বর্তমানে আমার স্কটল্যান্ড ভ্রমণ পড়ে, বানুমাসি (আজহার সাহেবের স্ত্রী) একবাক্স মিষ্টি নিয়ে এসে বললেন, তুমি আমাদের বিনা খরচায় স্কটল্যান্ড ঘুরিয়ে নিয়ে এলে, তাই মিষ্টি নিয়ে এলাম। এই বোধগুলো সবার মধ্যে থাকে না।   

      আমার নতুন বইটির নাম  ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’। বইটির বিষয়গুলি দেখে  ‘সহজপাঠ’ ছাপার দায়িত্ব নিয়েছে। ২০১৭ বইমেলায় বইটি হয়ে যাবে বলে প্রকাশক শুভাশিস মণ্ডল জানিয়েছে। অনেক সময় হাতে আছে। দেখা  যাক কি হয়। আবার নতুন লেখায় মন দেবার চেষ্টা করছি। যে ভাবে হোক নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। কী ভাবে দিনগুলো কাটছে, সে আমিই জানি। একদিন কত স্বপ্ন ছিল, বড় নামি পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হবে!  আর আজ আনন্দ দূরে থাক, কোন উৎসাহও বধ করি না।

     গত রাতে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম। এটা প্রায় হয়। মন এতটাই দুর্বল যে, যা সামনে পাই আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করি। ডুবন্ত মানুষ যা  করে। এদিকে শরীরটাও ঠিক রাখতে হবে। কয়েকদিন আগে চোখ দেখিয়েছিলাম, গতরাতে ড্রপ লাগানোর পর সকালে দেখি চোখ ফুলে গেছে, চোখ জড়িয়ে গেছে। এখন এপ্রিল মাস, প্রচণ্ড গরম। এমনিতেই মেদিনীপুরে খুব গরম পড়ে।

      আজ খান সাহেবের ইনজেকশন নেওয়ার ডেট ছিল। কিন্তু দাস মেডিকেল এনে দিতে পারেনি। আমাকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। ডাঃ দাস একটা নাম্বার দিয়েছিলেন। সেই নাম্বারে ফোন করে  যাকে পেলাম, তাঁর লোক স্পন্দনে আসেন, নাম লোকনাথ। তিনি বাড়িতে এসে ইঞ্জেক্সন দিয়ে যাবেন। যাক বাবা, চিন্তা মুক্ত হলাম।

    আমরা এ(২০১৬) বছর আবার ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। আজ অসিত দাস ফোন করে জানালেন, ১৮ জুন আমাদের ইংল্যান্ড যাওয়ার  টিকিট হয়েছে। ফেরা ১৮ সেপ্টেম্বর। এবার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষ একটা জীবনে আর কত কষ্ট সহ্য করবে? সব থেকে বেদনাদায়ক কষ্ট তো বুকে নিয়ে বয়ে চলেছি। আর কত কাল বয়ে বেড়াতে হবে কে জানে! যে দিকে তাকায় সবই আগের মত আছে, আমাদের জীবনটাই শুধু ছন্দহারা হয়ে গেছে। আজ দুপুরে ছেলে কখন আমার পাশে এসে শুয়েছে, টেরই পাইনি। বললাম যা তো বাবা ডালপুরি নিয়ে আসবি। কথাটা আমার কানেই নিল না। থাক ওর খেয়াল খুশি মত।

   রফিককে আগেই বলে রেখেছি আগামীকাল কলকাতা যাব ভিসার জন্য। টিকিট হয়ে গেছে, সময় মত ভিসা না পেলে মুশকিলে পরে যাব। আসিত দাস টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবে ভিসা অফিসে জানলাম দিন ১৫ র বেশি সময় লাগবে  না। ভিসা ঠিক সময়েই পেলাম। ১৬ জুন কলকাতা এসে ফ্ল্যাটে উঠলাম। বোন এসেছে সঙ্গে। আমার দ্বারা রান্না বান্না কিছু হবে না, তাই বোনকে নিয়ে এসেছি। মনি(ভাই) অফিস করে ১৭ জুন সন্ধ্যায় এল। পরদিন ভোরে মনি আমাদের ট্যাক্সি ডেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল। ওনার জন্য হুইলচেয়ার বলা হয়েছিল। চেক-ইন এর সময় হুইল চেয়ার কেন প্রয়োজন হয়েছে? জিজ্ঞেস করতে সত্যি কথাই বলেছি। তখন ওঁরা ‘ফিট সার্টিফিকেট’ দেখতে চাইলেন। ডাক্তার আমাদের দেননি। জানতামও না এটা লাগে বলে। ওনারা নিজেরাই বললেন, আমরা ছেড়ে দিচ্ছি, ফ্লাইটের গেটে যদি আটকায়, তাহলে বলবেন পায়ে ব্যথা। তবে কেউ কিছু জানতে চাননি। হুইলচেয়ার নেওয়ার জন্য আমাদের উইন্ডো সাইড সিট দেয়নি। কী আর করা যাবে? আমাদের এ আর ইণ্ডিয়ার ফ্লাইট ৬ টা ৩০ মিনিটে দিল্লীর উদ্দেশ্যে উড়ান দিল।                                                                                                                      বারমিংহাম পৌঁছে গেলাম দিনের আলো থাকতে থাকতে, দীপ এয়ারপোর্টে এসেছিল আমাদের নিতে। দেশে তখন মাঝ রাত তবুও মনিকে ফোন করে  পৌঁছানোর খবর দিলাম।                                                  
     শরীরটা ভাল নেই,বিছানে থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ওয়েদার খুব খারাপ, বৃষ্টি হচ্ছে। এদেশে শুধু সারা বছর ঠাণ্ডা, বছরের ৪/৫ মাস তুষারপাত হয়, সে ঠিক আছে। অসহ্য লাগে বৃষ্টি হলে। প্রায় সারা বছরই বৃষ্টি হয়। সেইসঙ্গে  ঠাণ্ডা বাতাস। সাড়ি পরে বের হলে ঝড়ো বাতাসে সাড়ি মাথায় উঠে যাওয়ার অবস্তা হয়। তাই সবসময় সাড়ি পরে বাইরে যায় না। আমি আবার সাড়ি ছাড়া অন্যকিছু পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। অন্যকিছু পরতেও ভালও লাগে না।

    আজ ওয়েদার কিছুটা ভাল। সকালে উঠে চা খেয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম।  বেশ কনকনে শীত। সেই চেনা পথ, কোয়াপের দোকান সব বন্ধ.২/১ টি কফিসপ খোলা আছে...। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাইওয়ের কাছে পৌঁছে গেলাম। রাস্তার ওপারে আপেল গাছগুলো যেন পাতা নেড়ে কাছে ডাকছে। রাস্তা ক্রস করে ওপারে গিয়ে দেখলাম খুব ছোট ছোট আপেল ধরেছে। এদিকেও বেশ কিছুটা হেঁটে  ফেরার পথ ধরলাম। বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে, কিছু কাপড়জামা পিছনের লনে রোদে শুকোতে দিলাম। সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, নইলে আমাদের দেশের শরতের মেঘের মত কখন যে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাবে টেরই পাব না।

    বয়সের সঙ্গে অভিজ্ঞতাও বাড়ে। তা থেকেই উপলব্ধি করেছি দুঃখ জিনিসটা খুব ভারি। এর স্থায়িত্বও বেশি। তাই বহন করতে কষ্ট হয়, জীবনের অনেকটা সময় চলে যায়।সুখ হাল্কা পলকা, নিমেষে ফুরিয়ে যায়। জোর করে তাকে ধরে রাখা যায় না। আমার দুঃখ আমাকে ভালবেসে ফেলেছে বন্ধুর মত,আত্মীয়র মত।তাই আমাকে ছেড়ে যেতে পারছে না। দেখা যাক কতদিন এই বন্ধুত্ব থাকে। জীবনে কত বন্ধুই তো দেখলাম। ‘বন্ধু যে যত স্বপ্নের মত বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ’। সুখের অংশীদার অনেকেই হয়, দুঃখের ভাগ কেউ নেয় না। একাকেই বহন করতে হয়।সুখ আমার জীবনে ডোডো পাখি হয়ে গেছে। তাই চেষ্টা করি যা আছে তা নিয়েই বাঁচতে।

                             ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments