জ্বলদর্চি

চৈত্র নবরাত্রি /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬৫

চৈত্র নবরাত্রি

ভাস্করব্রত পতি

সাধারণত চৈত্র নবরাত্রির শুরুতে উত্তরা ভাদ্রপদ নক্ষত্র থাকে। শাস্ত্রানুযায়ী এই নক্ষত্র জ্ঞান, সুখ ও সৌভাগ্যের পরিচায়ক। এই উত্তরা ভাদ্রপদ নক্ষত্রের অধিপতি হলেন শনি দেবতা এবং রাশির অধিপতি হলেন গুরু। এই নক্ষত্রের প্রভাবে সমস্ত রাশি শুভ ফল পায় বলে অভিমত। 

চৈত্র নবরাত্রির শুরুতে মীন রাশিতে একসাথে ৫ টি গ্রহ পরিভ্রমণ করে। এই দিনের সাথে অনেক শুভ যোগ তথা -- বুধাদিত্য যোগ, হংস যোগ, শশ যোগ, গজকেশরী যোগ, রাজ লক্ষ্মণ যোগ এবং ধর্মাত্ম যোগ থাকে কখনো কখনো। এর ফলে নানা শুভকর ঘটনা ঘটে ভক্তদের মধ্যে। 

মোট চার ধরনের নবরাত্রি উদযাপিত হয় এদেশে। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে চারটি নবরাত্রির নামকরণ করা হয়েছে মাসের নাম সংযুক্ত করে। প্রথমতঃ আষাঢ় নবরাত্রি, শারদ নবরাত্রি, মাঘ নবরাত্রি এবং চৈত্র নবরাত্রি। এই চারটি নবরাত্রির মধ্যে ২ টি কে বলা হয় 'গুপ্ত নবরাত্রি' এবং বাকি ২ টি হল 'প্রকাট নবরাত্রি' বা 'সরাসরি নবরাত্রি'। হিন্দু ধর্মানুযায়ী চৈত্র নবরাত্রির দিন থেকে শুরু হয় নতুন বছর। চৈত্র এবং আশ্বিন মাসে যে নবরাত্রি হয় তাতে দেবী দুর্গার নয়টি রূপের পূজার্চনা হয়। আর আষাঢ় এবং মাঘ মাসে হয় গুপ্ত নবরাত্রি। তবে এই দুই নবরাত্রিতে দেবীর ১০ টি মহাবিদ্যার পুজো করা হয়। 

তবে সকল নবরাত্রির মধ্যে চৈত্র নবরাত্রি একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্র বলছে, হিন্দু নববর্ষ নাকি শুরু হয় চৈত্র শুক্লা প্রতিপদ তিথির দিন। তাই বছরের প্রথম নবরাত্রি শুরু হয় এই তিথি থেকেই। আর চৈত্র মাসে আয়োজিত হয় বলেই একে বলা হয় 'চৈত্র নবরাত্রি' বা 'চৈতি নবরাত্রি'নবরাত্রি'। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এই লৌকিক উৎসবটি বেশ ঘটা করেই পালিত হচ্ছে। 
চৈত্র নবরাত্রিতে টানা নয় দিন ধরে দেবী দুর্গার নয়টি রূপের পূজা করা হয়। নবরাত্রির প্রথম দিনে হয় মা শৈলপুত্রীর পুজো ও দেবীর ঘটস্থাপন। নবরাত্রিতে এই ঘটস্থাপন তথা কলস প্রতিষ্ঠার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ঘটস্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় মা দুর্গার আরাধনা। মানুষের বিশ্বাস যে, ঘটস্থাপন সঠিক সময়ে তিথি দেখে পালন করা উচিত। এর পরের দিন তথা দ্বিতীয় দিনে হয় মা ব্রহ্মচারিণীর পুজো। তৃতীয় দিনে মা চন্দ্রঘন্টার পুজো আয়োজিত হয়। চতুর্থ দিন মা কুষ্মাণ্ডার পুজো ও পঞ্চম দিনে হয় মা স্কন্দমাতার পুজো। ষষ্ঠ দিনে পালিত হয় মা কাত্যায়নীর পুজো। সপ্তম দিনে মা কালরাত্রির পুজো। অষ্টম দিনে মা মহাগৌরীর পুজো। নবম দিনে মা সিদ্ধিদাত্রীর পুজো। এই দিনকে বলে রামনবমী। এদিন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পূজা করা হয়। সবশেষে আসে বিজয়া দশমী। নবরাত্রির শেষ দিন। 
অষ্টমী ও নবমীতে মহিলারা পূজা করেন। বিশ্বাস যে, এই দুদিন ছাড়া ৯ দিনের পূজা অসফল। মা দুর্গা হলেন সুখ ও সমৃদ্ধির দেবী। নবরাত্রিতে উপবাস সহকারে দেবীর আরাধনা করলে দেবী সন্তুষ্ট হন। তিনি সকলের মনোবাসনা পূরণ করেন। এই উপবাস শেষ হয় নবরাত্রির অষ্টমীতে।

ড. শীলা বসাক গুজরাটে পালিত শারদ নবরাত্রি উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন। এই উৎসবের সাথে চৈত্র নবরাত্রির অনেক মিল রয়েছে। তিনি লিখেছেন -- "গুজরাটে আশ্বিন মাসের শুক্ল প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নবরাত্রি পালন করা হয়। এই ব্রত নয়দিন ধরে পালন করা হয়। দেবী অম্বিকার মূর্তি যাঁর বাহন বাঘ, সেই মূর্তি এই সময়ে পূজিত হয়। মন্দির বা যেকোনও স্থানে মহা- আড়ম্বরের সঙ্গে নয়দিন ধরে এই পূজা বা ব্রত নারীপুরুষ উভয়েই পালন করে। এই ব্রত পালনের নয়দিনের দিন গুজরাতের মেয়েরা লোকনৃত্য গরবা নাচ পরিবেশন করে। তাঁরা একটি শতছিদ্র সাদা রঙ করা হাঁড়ির মধ্যে একটা জ্বলন্ত দীপ রাখে এবং সেই হাঁড়িটিকে ঘিরে নাচ গান করে। একজন বযস্কা মহিলা সেই হাঁড়িটি মাথায় নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় দেখিয়ে ও গান গেয়ে বেড়ায়। এই নৃত্যগীতের নামই হল ‘গরবা’। হাঁড়িটির ছিদ্র দিয়ে দীপের রশ্মি বের হয়। হাঁড়িটি হল সূর্যের প্রতীকস্বরূপ। এই পূজা পশ্চিমবাংলার ‘দুর্গাপূজা'র সঙ্গে তুলনীয়।"


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments