জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প— কম্বোডিয়া (এশিয়া)হুলো বেড়ালের বিড়ম্বনা /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প— কম্বোডিয়া (এশিয়া)
হুলো বেড়ালের বিড়ম্বনা

চিন্ময় দাশ


এক হুলো বেড়াল আর একটা টিয়াপাখি। কাছাকাছিই থাকে দুজনে। এটা ওটা খেয়ে মুখ ধরে গেছে হুলোর। মনে ভারি সাধ, টিয়ার মাংস খাবার। কিন্তু লোভ হলেই তো আর খাওয়া হয় না। ফন্দি বের করতে হবে তার জন্য। 
বেশ কিছু দিন চেষ্টার পর, টিয়ার সাথে বেশ একটু ভাব জমিয়ে ফেলল হুলো। একদিন হুলো টিয়াকে বলল—দিনের পর দিন নিজের বাড়িতে নিজে খেয়ে খেয়ে, একঘেয়ে হয়ে গেছে খাবার ব্যাপারটা। একটু অন্য রকম হলে ভালো হয় না? 
টিয়া বলল—অন্য রকম মানে? কী রকম? 
হুলো বলল—ধরো, একদিন তুমি আমাকে নেমন্তন্ন করলে। আমি তোমার বাড়ি গিয়ে খেয়ে এলাম। পরে একদিন আমি নেমন্তন্ন করলাম। সেদিন তুমি এলে আমার বাড়ি।
টিয়া সাধাসিধে জীব। তার মনে কোন ছল নাই। সে বলল— বাহ, বেশ বলেছ। ভালোই তো হবে।
--তাহলে, আমার বাড়ি দিয়েই শুরু হোক। হুলো বলল—কেন না, আমিই তো ভেবেছি ব্যাপারটা।
টিয়া কোন আপত্তি করল না। পরদিন এলো বিড়ালের বাড়ি। স্বভাবে বিড়াল যেমন বদমাস, তেমনি কিপটে। বিশেষ কিছুর আয়োজন করেনি সে। খানিকটা দুধ, এক টুকরো মাছ আর একটা বিস্কুট।
টিয়া যেমন ভদ্র, তেমনি অমায়িক। মুখে কিছুই বলল না। তবে দিনটা তার ভালো কাটেনি।
পরে একদিন টিয়ার পালা। বেশ ভালো আয়োজন করেছে সে। কষা মাংস, এক কেটলি চা, এক ঝুড়ি ফল। সব চেয়ে বড় কথা, আগের দিন অনেক সময় নিয়ে, প্রচুর কেক বানিয়েছে সে। ছোট ছোট, মশলাদার, মুচমুচে, বাদামী রঙের কেক। শ’পাঁচেক তো হবেই। 
খাবার সময় টিয়া মাত্র দুটো কেক রেখেছে নিজের জন্য। বাকি সব  সাজিয়ে দিয়েছে বেড়াল বন্ধুর সামনে।   

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


 চোখ টেরিয়ে সব দেখে নিয়েছে বিড়াল। খেতেও শুরু করেছে। দেখে মনে হবে, খাচ্ছে না, গিলে ফেলছে এক এক করে। কষামাংস খেল। ফল খেল। চা শেষ করল এক চুমুকে। খাচ্ছে তো খেয়েই যাচ্ছে। গুণে গুণে চারশ’ আঠানব্বইটা কেকও সাবাড় করে ফেলল দেখতে না দেখতে।
এবার বলল—পেট তো ভরলো না হে। আছে না কি আর কিছু? 
টিয়া বলল—আছে তো। আমার ভাগে দুটো কেক রেখেছিলাম। চাইলে, তুমি নিতে পারো।    
কিচ্ছুটি না বলে, সেই কেক দুটোও পেটে চালান করে দিল বিড়াল। বলল—আর কিছু নাই? 
টিয়ার মনে একটু রাগ হয়েছে এবার। বলল—আছেই তো। অন্য কিছু তো দেখছি না। তবে, আমি তো আছি। চাইলে, আমাকেও দেখছি খেতে পারো তুমি।
টিয়া ভেবেছে, একথা শুনে লজ্জা পাবে বিড়াল। ফল হোল উলটো। টিয়ার কথা শেষ হবার আগেই, লম্বা জিভখানা ঠোঁটে বোলাতে শুরু করেছে বিড়াল। হাসিমুখ করে বলল—ঠিক বলেছ। বন্ধুর বাড়ি থেকে আধপেটা খেয়ে ফিরে যাওয়া ভালো কথা নয়। তাতে অকল্যাণ হবে তোমার। 
বলেই এক লাফ। তার বিরাট হাঁয়ের মধ্য দিয়ে গলে গেল টিয়াটা। 
থাবা দিয়ে ঠোঁট আর গোঁফ মুছে নিয়ে, এদিক ওদিক চেয়ে দেখল বিড়াল। নাহ, ঘরে আর কিছু নাই। 
এবার রাস্তায় নামল বিড়াল। হয়েছে কী, এক বুড়ি দাঁড়িয়ে দাঁডিয়ে দেখছিল বিড়ালের কাণ্ড।
বুড়ির আর সহ্য হোল না। বিড়ালটাকে সামনে পেয়ে, বলল—হ্যাঁরে, আহাম্মক! এটা কী করলি? নিজের বন্ধুকে গিলে ফেললি? আক্কেল বলে কিছু আছে তোর?
মুখে কিছু বলল না হুলো। চোখ টেরা করে দেখল শুধু। মনে মনে বলল—করার এখনো বাকি আছেরে, বুড়ি। এবার সেটা করছি। মনের কথা শেষ হতে না হতেই, বুড়িকেই কপ করে গিলে ফেলল বিড়াল।
আবার চলতে শুরু করল সে। খানিক দূর গিয়েছে, এক বুড়োর সাথে দেখা। নিজের একটা গাধাকে টানতে টানতে বাড়ি ফিরছে মানুষটা। গাধাটার চলবার ইচ্ছে নাই। বুড়ো তাকে লাঠিপেটা করে করে টেনে নিয়ে চলেছে। 
এমনিতেই মেজাজ ভালো নাই বুড়োর। এখন পথের একেবারে মাঝখানটিতে কোত্থেকে একটা বিড়াল এসে হাজির। বুড়োর মেজাজ গেল খিঁচড়ে। খেঁকিয়ে উঠে বলল—রাস্তা থেকে সরে দাঁড়া হতভাগা। গাধার পায়ে পিষে, মারা পড়বার সাধ হয়েছে না কি?
শুনে, ভারি মজা লাগল বিড়ালের। মুচকি হেসে বলল—কে কিসে মারা পড়ে, আগে ভাগে কি আর বলা যায় গো? তোমার গাধাকে রেয়াৎ করতে বয়েই গেছে আমার। এক্টু আগে একটা ভোজ খেতে গেছলাম। গুনে গুনে পাঁচশ’ কেক খেলাম। নিজের বন্ধু টিয়াপাখিকে পেটে চালান করেছি। এইমাত্র একটা বুড়িকে গিলে খেলাম। এখনও দেখছি রাজ্যের খিদে আমার পেটে। এসেই যখন পড়েছ, ছাড়ি কেন? এবার তোমার দুটিকেও খেয়ে ফেলি। 
বলেই কপ কপ করে বুড়ো আর তার গাধা—দুজনকেই গিলে ফেলল বিড়াল। দু’-দুটো মানুষকে খেয়ে, ভারি পুলক এখন তার। বেশ দেমাকের সাথে চলেছে দুলকি চালে। 
খানিক দূর গিয়েছে, সামনে এক শোভাযাত্রা। এদিকেই এগিয়ে আসছে। 
তাকিয়ে দেখল, ভীড়ের সামনে দেশের রাজা। সদ্য বিয়ে করা, নতুন বউয়ের হাত ধরে হেঁটে আসছে। পুলক উপচে পড়ছে দুজনের চোখেমুখে। 
রাজার ঠিক পিছনে জনা আটেক সেপাই। দেহরক্ষীর দল তারা। পাহারা দিয়ে চলেছে রাজারানিকে। তাদের পিছনে খানিক তফাত রেখে, আরও ক’জন সেপাই। সেই সেপাইদের পিছনে হাতির দল। জোড়ায় জোড়ায় পাশাপাশি হেঁটে আসছে হাতিগুলো।
এদেশের রাজার খুব নামডাক দয়ালু বলে। তার উপর নতুন বিয়ে করা বউ এখন সাথে। সামনে বিড়ালকে দেখে, রাজা বলল—সামনে থেকে সরে দাঁড়া। হাতির পাল আসছে আমার। পায়ের তলায় পড়লে, চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবি তখন।
হাতির ভয়ে আমি সরে দাঁড়াব? দেশের রাজার দেখছি জ্ঞানগম্যি নাই। বিড়াল দেমাক দেখিয়ে বলতে লাগল-- এইমাত্র ভোজ খেয়ে ফিরছি। গুনে গুনে পাঁচশ’টা কেক খেয়েছি। নিজের বন্ধু টিয়াকে গিলে খেলাম। এক বুড়িকে খেলাম। শুধু তাই নাকি? এক বুড়োকে গিলে খেলাম। এমনকি, বুড়োর গাধাটাকেও ছাড়িনি। আমাকে হাতির ভয় দেখানো?
বলেই, সোজা রাজার সামনে হাজির হোল বিড়াল। রাজাকে গিলে খেলো। রাজার নতুন বউকে খেলো। এর পর একে একে সেপাইকগুলোকে খেল।
সেপাইগুলোর ঠিক পিছনে ছিল হাতির দল। জোড়ায় জোড়ায় হাতি। কপ কপ করে সামনের হাতি দুটোকেও গিলে ফেলল বিড়ালটা।
তখন এক হুলুস্থুল কাণ্ড। দু’দুটো হাতিকে বিড়ালের পেটে চালান হয়ে যেতে দেখে, পিছনের হাতির দল গেল বেদম ঘাবড়ে। পড়ি কি মরি করে যে যেদিকে পারল, দৌড় লাগাল। 
সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। প্রত্যেকটা হাতি দৌড়চ্ছে লেজ উঁচিয়ে। তাদের শুঁড়গুলোও আকাশে উঁচিয়ে তোলা। বিশাল গর্জন করতে করতে পালাচ্ছে তারা। আকাশ বাতাস গাছগাছালি সব কাঁপছে সেই বিকট শব্দে।
আর বিড়ালটা? সেই দৃশ্য দেখে, আর হাতিদের গর্জন শুনে, হাসি যেন আর থামতেই চায় না তার। একটা বিড়ালের ভয়ে, রাজার হাতিরা দৌড়ে পালাচ্ছে লেজ উঁচিয়ে—এমন দৃশ্য দেখলে কার না হাসি পায়? বিড়াল তো কোন ছার!
এখন আর মনে কোন খেদ নাই। পেটও বেশ ভার এখন। হেলতে দুলতে ঘরের পথ ধরল বিড়াল। 
খানিক দূর গিয়েছে। দুটো ভুঁই-কাঁকড়া হেঁটে আসছে রাস্তা দিয়ে। এই এক জীব, চোখে পড়লেই গা ঘিন-ঘিন করে ওঠে বিড়ালের। ছোট্ট পুঁচকে একটা জীব! তার দ্যাখো দশ-দশখানা ঠ্যাং! আর চোখ দুটোরও কত কেরামতি! এই গর্তে ঢুকে আছে, এই খাড়া হয়ে উঠে পড়ছে মাথার ওপর! আর, কিলবিল করে হাঁটবারও বা কী বিচ্ছিরি ভঙ্গী! গা-পিত্তি জ্বলে যায় দেখলে!
এইসব ভাবছে বিড়াল, ততক্ষণে কাঁকড়া দুটো সামনে এসে পড়েছে। কাঁকড়ারা খিঁচিয়ে উঠল—রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সরে দাঁড়াও একদিকে। 
হা-হা করে হেসে উঠল বিড়াল—মুখ সামলে কথা বল হতভাগার দল। এই মাত্র দুটো রাজা আর রানিকে গিলে খেয়েছি। তার হাতি আর সেপাই-সান্ত্রী, সব এখন আমার পেটে। তার আগেও দুটো মানুষ, একটা গাধা, একটা পাখি খেয়েছি। তারও আগে গুণে গুণে পাঁচশ’ কেক খেলাম। তারও আগে …
বিড়ালকে হিসেব দেওয়া শেষ করতে না দিয়ে, কাঁকড়ারা চেঁচিয়ে উঠল—ওসব হিসেব-পত্তর তুমি নিজের ঘরে গিয়ে করো বসে বসে। রাস্তা ছাড়ো আমাদের। 
--তবে রে হতভাগার দল। মজা দেখাচ্ছি তোদের। বলেই ভরপেট খাওয়ার পর মুখশুদ্ধির মতো করে, গপাগপ কাঁকড়া দুটোকেও পেটে চলান করে দিল বিড়াল।
কাঁকড়া দুটো তো এখন বিড়ালের পেটের ভিতর এসে পড়েছে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই ঘটে গেছে ব্যাপারটা। এখন চারখানা চোখ উঁচু করে তুলে ধরে, জায়গাটা জরীপ করে দেখতে গেল দুজনে। কোথায় এসে পড়লাম? কিন্তু কিছুই তো চোখে পড়ছে না। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার চারদিকে। 
খানিক বাদে চোখ সয়ে এলো যখন, এদিক ওদিক চেয়ে চেয়ে দেখল দুজনে। বেচারা রাজা! একটি কোণে বসে আছে জড়সড় হয়ে। পাশে তার নতুন বউটি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বেচারি!
রাজার পাশটিতে তার সৈন্যসামন্তের দল। তদের পাশে ইয়াব্বড় দুটো হাতি। একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গা কুলিয়ে উঠতে পারছে না কোন মতে।
অন্য দিকটাতে একটা বুড়ি জবুথবু হয়ে বসা। তার পাশে বুড়ো একজন বসে আছে। গাধার দড়িটা হাতে ধরে আছে তখনও। এক গাদা কেক  কোণের দিকটায় ডাঁই হয়ে আছে। কেকগুলোর পাশে, সত্যিসত্যিই একটা টিয়াপাখি। 
টিয়ার দিকে চোখ পড়তেই, চমকে গেল কাঁকড়ারা। এক একটা করে পালক খসে পড়তে শুরু করেছে বেচারার। পাখিটাও ঝিমিয়ে আসছে একটু একটু করে। 
কিছু বুঝতে বাকি রইল না কাঁকড়াদের। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে, বেঘোরে মারা পড়তে হবে। চোখ মটকে দুজনেই বলে উঠল—আয়, কাজে লেগে যাই। 
অমনি কুট-কাট। কুট-কাট। বিড়ালের পেটে ফুটো করতে লেগে গেল দুজনে। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই, রাজামশাই বলে উঠল—একটু বড় করেই কাটিস গর্তটা। আমার হাতিদুটোও যেন বেরোতে পারে। 
বেশ মজা লাগল কাঁকড়াদের। রাজার উপকারে লাগবার সুযোগ পেয়ে গেল তারা। এম মওকা ছাড়া যায়? কুট-কাট, কুট-কাট। কুট-কাট, কুট-কাট। ফূর্তিতে কাজ শুরু করে দিল দুজনে।
এক জোড়া করে শক্ত দাঁড়া আছে কাঁকড়াদের। বেশি সময় লাগল না। বড়সড় একটা ফুটো হয়ে গেল খানিক বাদেই। 
রাজা বেরোল প্রথমে। জ্ঞান হারানো রানিকে ঘাড়ে নিয়েছে রাজামশাই। সৈন্যরা বেরুল। জায়গা একটু খালি হতে, হাতি দুটো বেরোল আড়মোড়া ভেঙে। বুড়ি বেরোল। গাধাকে নিয়ে বুড়োটাও বেরিয়ে এল। 
এবার কাঁকড়াদের চোখ গেল টিয়ার দিকে। কাহিল হয়ে পড়েছে বেচারা। তাকে ধরে ধরে আনতে গেল দুই কাঁকড়া। 
টিয়া বলল—অত ছটফট করিস না তো। আমার ভাগের কেকদুটো নিতে দে আগে।
দুটো কেক নিয়ে, তবে বাইরে এল টিয়া। কাঁকড়া দুটো বেরোল সবার পিছনে। সব কাজ শেষ করে। 
আর বিড়াল? তার তখন বেজায় কাহিল অবস্থা। মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। পেটের ফুটো সেলাই হবে কী করে, সেই ভাবনাতেই, মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়।
সেদিন থেকে আর সব জিনিষেই বিড়ালের লোভ। কিন্তু চোখে পড়ে গেলেও, ভুলেও কাঁকড়াদের দিকে লোভ দেয় না বিড়াল।

Post a Comment

0 Comments