জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—মঙ্গোলিয়া (এশিয়া)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—মঙ্গোলিয়া (এশিয়া)
হায়, হায়! উটের শিং আর লেজ কোথায় গেলো?

চিন্ময় দাশ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন কথা বলতে পারত বনের জীবজন্তুরা। ভাবসাবও ছিল বেশ নিজেদের ভেতর। 
সেসময় সুন্দর এক জোড়া ঝাঁকড়া শিং আর এক গোছা লম্বা বাহারি লেজ ছিল উটের। সেই সময়ের গল্প এটা। কেবল মঙ্গোলিয়া নয়, চীন দেশের উত্তর দিক জুড়ে, এখনও ছড়িয়ে আছে এই কাহিনী।  
এক উট প্রতিদিন একটা লেকে জল খেতে আসে। যত না তেষ্টা মেটাতে আসে, তার চেয়ে বেশি আসে নিজের ছায়া দেখতে। টলটলে নীল জল লেকের। উটের ছায়া পড়ে তাতে। মুখ নামালেই, জলের আয়নায় নিজেকে দেখতে পায় উট।
নিজেকে চেহারা দেখতে ভারি ভালো লাগে উটের। বিশেষ করে শিং আর লেজ নিয়ে ভারি আহ্লাদ তার। এমনটি আর কারও নাই। 
একদিন জল থেকে মুখ তুলেছে, সামনে একটা হরিণ দাঁড়িয়ে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে, হরিণ বলল—উটদাদা, উটদাদা! একটা উপকার করবে আমার? 
--তোমার উপকার? আমি কী উপকার করবো তোমার?
হরিণ বলল—আজ রাতে রাজামশাই একটা সভা ডেকেছে। আমার নেমন্তন্ন আছে সেখানে। 
উট বলল—সিংহমশাইর সভা? তা যাও না। আমাকে আবার কী দরকার?
হরিণ—আমার এই ন্যাড়া মাথা নিয়ে কী করে যাই বলো তো? যদিও মাত্র ঘন্টাখানেকের ব্যাপার। আমার খুব ইচ্ছে, তোমার শিং জোড়া মাথায় চাপিয়ে যাই। দাও না দাদা, শিং জোড়াটা। আজকের রাতটার মতোই কেবল। কাল সকাল হলেই, ফেরত পেয়ে যাবে তুমি। তুমি জল খেতে আসবার আগে থেকে, আমি এসে হাজির থাকব এখানটিতে।
রাজার ভোজসভায় যাওয়ার জন্য তার শিং চাইতে চাইতে এসেছে কেউ, এটা ভেবেই বেশ গর্ব হোল উটের। তাছাড়া এমনিতেই উটের স্বভাব বেশ ভালো। দয়া বলো, করুণা বলো, আছে তার শরীরে। পুঁচকে হরিণটাকে ফেরাতে মন চাইল না তার। 
--কাল সকালেই ফেরত দিও কিন্তু। জল খেতে এসে যেন পেয়ে যাই। এই বলে, মাথা থেকে শিংজোড়া খুলে হরিণকে দিয়ে দিল উট। 
হরিণকে আর পায় কে? শিং জোড়া মাথায় চাপিয়ে, নেমে গেল জলের ধারে। মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের নতুন চেহারাটা কেমন দাঁড়িয়েছে, পরখ করে নিল জলের ছায়ায়। তারপর এক দৌড় মনের আনন্দে। 
যেতে যেতে এক ঘোড়ার সাথে দেখা হরিণের। তাকে দেখে, ঘোড়াটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। 
--আরে, এটা কী ব্যাপার হোল? কালকেও তোমার সাথে দেখা হয়েছে আমার। রাতের মধ্যেই এমন ঝাঁকড়া এক জোড়া শিং গজিয়ে গেল কী করে? ঘোড়ার মাথায় ঢুকছে না কিছুই। 
হরিণ বেশ মুরুব্বির গলা করে বলল—হুঁ-হুঁ, বুদ্ধি খাটাতে হয়, বন্ধু। নইলে, হরিণের মাথায় আবার শিং গজায় না কি? তাও আবার এক রাতের মধ্যে? 
ঘোড়া বুঝল না কিছুই। বলল—ব্যাপারটা কী, একটু খুলে বলো তো, শুনি। আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না।
হরিণ তাকে সব কথা খুলে বলল। জিজ্ঞেস করল—আজ রাজার সভায় তোমার নেমন্তন্ন নাই? 
--থাকবে না কেন? আছে । যাবোও আমি। ঘোড়াকে থামিয়ে দিয়ে, হরিণ বলল—তাহলে, আমার একটা পরামর্শ শোন। তোমার এই ম্যাড়মেড়ে চেহারা নিয়ে ভোজসভায় যাবে কেন? একটু সেজেগুজে যাওয়ার কথা ভাবো। সবাই তোমাকে নতুন চেহারায় দেখবে, আর তারিফ করবে। 
ঘোড়া মনে মনে খুশি। কিন্তু কিন্তু করে বলল—সাজবো বললেই কি আর সাজা যায় গো? কী দিয়ে সাজগোজ করবো? 
হরিণ বুদ্ধি দিয়ে দিল ঘোড়াকে—তাড়াতাড়ি যাও। লেকের পাশেই পেয়ে যাবে উটকে। নিশ্চয় গাছের পাতা চিবোচ্ছে এখন। তার কাছ থেকে লেজটা চেয়ে আনো। উটের লেজখানা কিন্তু ভারি বাহারি।
একটুও দেরি নয় আর। ঘোড়া চলল লেকের দিকে। সেখানে পেয়েও গেল উটকে। বলল— ভারি দরকারে এলাম তোমার কাছে। আমার একটু উপকার করো, বন্ধু। 
উট বলল—আমি আবার তোমার কী উপকার করবো? 
ঘোড়া—রাজবাড়ির ভোজসভায় যেত হবে। তোমার বাহারি লেজখানা পরে যাবার ভারি সাধ হয়েছে। বেশি সময়ের জন্য নয়। আজকের রাতটুকু কেবল।
উট একটু দোনোমনো করছিল। ঘোড়া বলল-- একই বনে থাকি আমরা। কোন দিন কিছু চাইনি তোমার কাছে। আজ চাইছি। না কোর না দয়া করে।
উট তো স্বভাবে দয়ালু। লেজখানা খুলে দিয়েই দিল ঘোড়াকে। লেজ পরে, ঘোড়াও জলে নেমে নিজের ছায়া দেখল। তার পরে এক লাফ। দৌড় লাগাল মনের আনন্দে।
রাজার ভোজসভায় ঠিক কী হয়েছিল, জানা হয়নি উটের। তবে, সারা রাতটা অপেক্ষা করে কাটিয়েছে সে। কখন সকাল হবে। কখন ফেরত পাবে তার শিংজোড়া আর লেজখানা।
সকাল হতেই, সোজা লেকের পাড়ে গিয়ে হাজির হয়েছে উট। জলের জন্য নয়, শিং আর লেজ ফেরত পাওয়ার জন্য। বসে আছে তো বসেই আছে। না হরিণ, না ঘোড়া—কারুরই দেখা নাই। দূপুর গড়িয়ে, বিকেল হোল। সন্ধ্যাও নামল একসময়। কারুর পাত্তা নাই। 
শুধু সেদিন নয়। পরেও, কোনদিনই আর শয়তান দুটোর পাত্তা পায়নি উট। আসলে, শিং আর লেজ পেয়ে, দুজনেরই মনে বেশ পুলক। এমন জিনিষ ছাড়তে মন চায় না তাদের। সেদিন থেকে জলের খোঁজে অন্য দিকে যায় তারা। উটের সামনে পড়তে চায় না কিছুতেই।
আসলে হয়েছে কী, সেদিন রাতের ভোজসভায় দুজনের নতুন চেহারা দেখে সবাই বেশ তারিফ করেছিল। এমনকি, রাজামশাই স্বয়ং সিংহও নাকি প্রশংসা করেছিল বলে, শোনা যায়। 
রাজার প্রশংসায় মাথা ঘুরে গিয়েছে দুজনের। তারা ঠিক করে নিয়েছে, এমন বাহারি জিনিষ কিছুতেই শরীর থেকে খুলে দেওয়া যাবে না। তাতে যা হবার হবে।
হরিণ একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল। ঘোড়া বলেছে—হবে আবার কী? এমনিতে উট বেশ শান্ত শিষ্ট জীব। কোঁদল বা ঝগড়াঝাটি করতে আসবে না আমাদের সাথে। 
হরিণ বলেছিল—কিন্তু সামনা সামনি দেখা হলে, তখন কী বলব? 
ঘোড়া হেসে উঠল—কী যে বলো না, ভায়া, তার নাই ঠিক। দেখা হবেটা কেন? 
--এক বনে থাকি। দেখা তো হয়ে যেতেই পারে। এক জোড়া শিংয়ের জন্য, আমি তো আর বন ছেড়ে পালাতে পারি না। 
--দেখাই বা হবে কেন, আর পালাতেই বা যাবে কেন? ঘোড়ার হাসি থামে না—চোখ নাই আমাদের? অতো বড় চেহারা উটবাবাজীর। দূরে থাকলেও, দেখতে পেয়ে যাবে। আর চার-চারখানা পাও আছে তোমার। চোখে পড়ে গেলে, সেই এলাকা থেকেই সরে পড়বে। মিটে গেল ঝামেলা।

কথাটা বেশ মনে ধরেছিল হরিণের। কোন দিনই উটের সামনা সামনি হয়নি তার পর থেকে। ঘোড়ার বেলায় সে প্রশ্ন তো ওঠেই না। 
সেদিন থেকে একটা পরিবর্তন দেখা যায় উটের স্বভাবে। জল খেতে মুখ নামালেই, এদিক ওদিক করে, ঘণ ঘণ মাথা নাড়তে থাকে উট। আসলে, জলে নিজের ন্যাড়া মাথাটা চোখে পড়ে যায় বেচারার। মনের দুঃখে মাথা ঝাঁকাতে থাকে তখন। 
কখনও বা লম্বা গলাখানা ঘুরিয়ে, শরীরের পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথায় গেল তার এমন সুন্দর ফুলো ফুলো বাহারি লেজখানা! এখন যেটা পিছনে ঝুলতে থাকে, দড়ির মত, সরু লিকলিকে জিনিষটা দেখলে ভারি কষ্ট হয় উটের। 
আজও সেই কষ্ট মনে চেপে বসে আছে উটের। চুপচাপ থাকে সব সময়। মনে ফূর্তি দেখা যায় না। মনের দুঃখে, বনের জীবনও ছেড়ে দিয়েছে চিরকালের মত। শীতের দেশ ছেড়ে, বরাবরের মতো দূরে চলে গিয়েছে। অনেক দূরে, গরমের দেশ আরব এলাকায় দেখা যায় তাদের। 
গল্প শেষ। এবার চুপিচুপি একটি গূঢ় কথা বলে যাই। পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, মানুষের মধ্যে কিছু লোক, যারা ধার নিয়ে শোধ দেয় না, তারা না কি স্বভাবটা পেয়েছে হরিণ আর ঘোড়ার কাছ থেকেই।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

3 Comments