জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি ফণিভূষণ আচার্য /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি ফণিভূষণ আচার্য 
নির্মল বর্মন


অধ্যাপক ফণিভূষণ আচার্য রোমান্টিক অনুভূতি , আভিজাত্য , বর্তমান সময় ও সমাজকে পাথেয় করে তাঁর কবিতাগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা দিতে পেরেছেন। ফণিভুষণ আচার্য কবি ও অধ্যাপক হিসাবে সুনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন সাহিত্য চর্চা করেছেন। নদীয়ার ফুলিয়ার কৃত্তিবাস সর্বজনবিদিত কিংবদন্তি ।  সেই "কৃত্তিবাস"নামাঙ্কিত পত্রিকায়  সর্বদা লেখা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
কবি ফণিভূষণ আচার্যের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হলঃ--
'ধূলি মুটি সোনা' ১৯৫৫ ; ' আমরা ভাসানে যাচ্ছি' ১৯৭১ ; 'ধর্মদা আর কতদূর' ১৯৭৩ ;  'মনীষা কোথায় আছো'১৯৭৭ ;  'আমিই অভিমুন্য , আমি লখিন্দর' ১৯৯০ ; 'জংলা  পাড়  ডুরে শাড়ি' ১৯৯০  ;  'ভালোবাসার জন্ম' ১৯৯৪ ; 'অশ্রুদীঘল নদীর ভাষা' ১৯৯৬  ; 'গর্ভধারিনী মা-কে' ১৯৯৮ ; 'কবিতা সমগ্র' ২০০০ ; 'রোদ্দুর ঘরে ফিরছে' ২০০১ ইত্যাদি।

১৩৭০ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসের "কৃত্তিবাস" পত্রিকায় প্রকাশিত "তৃষ্ণায় গুলির শব্দ"  কবিতায় মানব জীবনে চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্বের মধ্যে  যে ব্যবধান তাকে কবি ফণিভূষণ আচার্য সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছেন--
"এত যে আঁধার ছিল গাঙশালিকের চোখে কখনো ভাবিনি।
আকাশে সমুদ্র আর বাতাসের অক্লান্ত প্রসারে তোমাকে খুঁজেছি আমি।
ঘুঘুর কান্নায়, শুকনো পাতা, ঝরা পাপড়ির গোপনে
লাশকাটা ঘরে, মৃত শবগন্ধি পচা অন্ধকারে তোমাকে খুঁজেছি আমি।
এত যে হতাশা ছিল আমার দুচোখে আমি কখনো ভাবিনি।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


কবি ফণিভূষণ আচার্য লাশকাটা ঘরের যন্ত্রণা পচা শব গন্ধির মধ্যেও খোঁজার চেষ্টা করেছেন আপনজনকে। এই হতাশা যন্ত্রণা কবির অতীত ও বর্তমানের সেতুকে যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে, তাই কবি কণ্ঠে সরস উচ্চারণ করেছেন-----
"তৃষ্ণায় গুলির শব্দ , আর্তনাদে মাটিতে লুটানো,
                                                ক্লান্ত রাত্রির উজানে 
আঙুলের ফাঁক দিয়ে উর্বর ঋতুরা ঝরে গেছে-------
                                                   গাছে গাছে মুখ----
কে আমাকে নিয়ে এল এমন শীতল এক পচা অন্ধকারে" ?


অধ্যাপক কবি ফণিভূষণ আচার্য পরিষ্কারভাবে কবিতায় দেখিয়েছেন মানুষের মৃত্যুর পর প্রেম-ভালোবাসা উপলব্ধি করা অতি আধুনিক জীবনের যে যুগলক্ষণ সেই লক্ষণটিকে কবি "পোস্ট-মর্টেমে জানা গেল" কবিতায় সুন্দরভাবে পাঠককে উপহার দিয়েছেন ; দৃষ্টান্তস্বরূপ---
"পোস্ট-মর্টেমে জানা গেল বুকে তার ঈষদুষ্ণ ভালোবাসা ছিল
দরজা জানালা চিলেকোঠা ঝুলে - পড়া বারান্দায় রাণুদির মতো এক
তুষার - মানবী চুল খুলে নেমে গেছে মোষের শিঙের মতো
ঘোরানো সিঁড়িতে তার এলোমেলো পদচিহ্ন পুরনো প্রেমের
--++++++-_-------------------
পোস্ট-মর্টেমে জানা গেল বুকে তার বিস্তীর্ণ যবের ক্ষেত
আমলকী ছায়া মিতাক্ষরা নদী উদোম উঠোন জুড়ে ধানভানা রোদ
এবং বাংলা দেশ অনুপূর্ব ছিল"।
উক্ত ভাবনা ও কথার পরিপ্রেক্ষিতে 
 বর্তমান সময় ও সমাজের জনৈক কবির কবিতা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে--++-
"ভালোবাসার ফুল ঝরে পড়বে কংক্রিটের রাস্তায়
বহু মানুষ আর অ্যাম্বুলেন্সের চাপে
পড়ে থাকবে চাপ চাপ রক্ত----
যন্ত্রণা ক্লিষ্ট ক্ষতবিক্ষত একটা নিথর দেহ"!

কবি ফণিভূষণ আচার্যের "কোথায় গমন করো রাত্রিবেলা" কবিতায় কল্পনাধর্মিতা ও বর্তমান সময় ও সমাজের প্রেক্ষিতকে সুন্দরভাবে  ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর এই কবিতায় --- শৈশবের ভাঙ্গা সুটকেস ও নারীর বুকের আঁচল খুলে তুলে নেয় ভালো মন্দ কথা , ইলিশ মাছের বাঁশি অম্বল সবকিছু মিলেমিশে আধুনিক সমাজ ভাবনার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন। কবি ফণিভূষণ  আচার্য সব সময়ই আটপৌরে জীবন যাপনের যাপনচিত্রলিপি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন দৃষ্টান্ত স্বরূপ---

"কোথায় গমন কর রাত্রিবেলা কার কাছে চেয়ে খাও জল
বেপাড়ায় কার কাছে ফেলে আসো শৈশবের ভাঙ্গা সুটকেশ
কোন নারী বুকের আঁচল খুলে তুলে নেয় অগোচর
ভালো - মন্দ কথা
কোন নারী মাটির হাঁড়িতে বেঁধে ইলিশ মাছের বাঁশি অম্বল রেখেছে
কোথায় গমন করো রাত্রিবেলা কার কাছে জ্যোৎস্নার লবণে
যামিনী রায়ের ছবি ভেসে উঠে গাড়ি বারান্দায়
উলঙ্গ হাওয়ার মতো বাল্যস্মৃতি খেলা খেলা করে
ছত্রাখান উঠনের ধারে
গল্পেভরা নটেগাছ রহিমের ছাগলটা মুড়িয়েছে খুব ভোরবেলা
ওখানে গভীর রাতে যাও তুমি কেন যাও তুমি
জানো না কি নির্ঝতির ঝড়ে কবে ভেঙে গেছে
রাণুদির জাপানি লন্ঠন"।

অধ্যাপক কবি ফণিভূষণ আচার্য গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে তাঁর কবিতায় যেমন স্থান দিয়েছেন তেমনি নস্টালজিয়ার ছবি ফুটে উঠেছে তার  "মৃত প্রজাপতি" কবিতায় -----
"জন্মভূমি সব কিছু ছেড়ে দেয়
কেবল বুকের কাছে নষ্ট স্মৃতি
শৈশবের মৃত প্রজাপতি"
কবি ফণিভূষণ  আচার্য মহোদয়ের প্রেম সম্পর্কিত ধারণা ভালো নয়, কবির  নৈরাস্যবোধ সবসময়ই ছিল। দৈনন্দিন জীবনের ঘরোয়া রূপ ও প্রেম বিভিন্ন কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। কবি ফণিভূষণ  আচার্য'র  সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার টুকটাক মিল, যৌনতা  ও অভিযোগ খুঁজে পাই। হয়তো হুবহু মিল না থাকলেও কোথাও হয়তো এদের মধ্যে একটা আত্মানুভূতি রয়েছেই। তাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "দ্বারভাঙ্গা জেলার রমণী" কবিতাটি স্মরণযোগ্য---

"হাওড়া ব্রীজের রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল
দ্বারভাঙা জেলা থেকে আসা এক টাটকা রমণী"

কবি আচার্যের প্রেমের জ্বালা ও যন্ত্রণাকে "গুপ্ত ভুবন" কবিতায় উপস্থাপিত করেছেন সুন্দরভাবে। এভাবেই  কবি র মাহাত্ম্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে---
"কিশোর তুমি দেখতে পাচ্ছ এই পৃথিবীর ব্যস্ত গমন
দেখতে পাচ্ছ নিজের নখে গা আঁচড়ায় উদো বিড়াল
দেখছ ধুলোর বিষাদতন্ত্রে ঝগড়া করে ছাতার পাখি
ঝগড়া করে সিংদরোজায় দুঃখপ্রবণ গুপ্তপ্রেমিক"।

Post a Comment

2 Comments

  1. অসাধারণ পর্যালোচনা পড়ে সত্যি অনেক কিছু জানতে পারছি। আরো অনেক কিছু জানতে চাই। ধন্যবাদ জ্বলদর্চি ও ধন্যবাদ জানাই লেখক অধ্যাপক ড. নির্মল বর্মন ডি লিট মহাশয়কে।

    ReplyDelete
  2. অসাধারন । কলম সচল থাকুক ।

    ReplyDelete