জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি মানস রায়চৌধুরী / নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি মানস রায়চৌধুরী 

নির্মল বর্মন


কবি মানস রায়চৌধুরী অধুনা বাংলাদেশের খুলনায় পৈত্রিক বাসভূমি হওয়া সত্ত্বেও কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতা মহানগরীতেই । মানস রায়চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, সেই সঙ্গে কবিতা চর্চাও শুরু করেছিলেন। সমাজমনস্কতা ও আঙ্গিক সচেতনতার জন্য তাঁর কবিতাগুলো চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। কবি মানস রায়চৌধুরী অনার্স সহ এম. এস. সি পাস করেন মনোবিজ্ঞানে এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন ।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন । ১৯৬২ তে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের জন্য আমেরিকা ও  ইউরোপ দেশ বিদেশ ভ্রমণ করেন। মানস রায়চৌধুরী মনোবিজ্ঞানী হিসাবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেছেন।

কবি মানস রায়চৌধুরী প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল --- " "অনিদ্র গোলাপ";  "আবহ শিখা" ;  "বাঁচার এই শব্দ"; "উচ্চারণ" (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে);  "যাওয়া আসা" ; "সমান অভাব" ও  "বইছে বাতাস স্বপ্ন ভাঙ্গার" ইত্যাদি।
কবি মানস রায়চৌধুরী কবিতা চর্চা  ও লেখালেখির জন্য ১৯৮২ তে "জীবনানন্দ পুরস্কার" লাভ করেছেন।

১৩৬৯ বঙ্গাব্দে চৈত্র সংখ্যায় স্বনামধন্য "কৃত্তিবাস" পত্রিকায় "দিনযাপন" নামে একটি গদ্য কবিতা প্রকাশ করে বাংলা সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন । এই কবিতার ভাব ভালোবাসা ভাষা সুন্দর বন্ধন সৃষ্টি করেছিলেন ; সুতরাং এই সৃষ্টির জন্য কবি রায়চৌধুরীকে সিরিয়াস কবি রূপে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছিল। "দিনযাপন" নামক গদ্য কবিতায় দৈনন্দিন জীবনের গ্লানি কে সুন্দর ও চমৎকারভাবে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ---

"বড় ভালবাসা পায় একেক সন্ধ্যা ।  বৃষ্টি থেমে গেছে , শহরটা বেশ ঝকঝকে। ট্রামবাসশূন্য রাস্তার মোড়ে বন্ধুর প্যাকেট থেকে শেষ চারমিনার ভাগ করে দুজনে খেতে গিয়ে যখন দেখি পাড়ার সবচেয়ে কমসুন্দর মেয়েটি ভিজে মাথা, ভিজে কাপড়ে আমাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নির্বিকার চলে গেল , তখন শরীরটা মোচড় দিতে থাকে ।মনে হয় এরপর একটা কিছু ঘটতে যাবে। আঠাশ বছর বয়সটা হাড়ে  মাংসে মগজের মধ্যে একটা বিস্ফোরণের প্রতীক্ষা করছে । এইবার কিছু একটা হল বলে" ।

কবি মানস রায়চৌধুরী বর্তমান সময় ও সমাজে অসহায় বেকার জীবন, শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক নিয়ে কলম ধরেছিলেন । তাঁর সেই তীক্ষ্ণ উদ্ধার কলম থেকে বেরিয়ে আসে---
"সম্প্রতি টালিগঞ্জে একটা হরিজন অধ্যুষিত পানীয়ের দোকানে আমি।
দন্তে  স   ও তালব্য  শ খানিকক্ষণ সৎভাবে কথা বলেছিলাম। বিষয়: প্রেম , শিল্প পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ও বন্ধন, ছোট ভাই এর অসুখ, বোনের অ্যানিমিয়া এবং চীনা আক্রমণ। আমাদের তিনজনেরই বয়েস ত্রিশের নীচে। কারো রোজগার তিনশোর বেশি নয়।
দন্ত্য  - স  যে আমাদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী বলে খ্যাত ও নিন্দিত, হঠাৎ বলল : বাবা- মা , ভাইবোন , এদের নিয়ে আমার ভালভাবে বেঁচে থাকা,
গাড়ি চড়া নয়, এগুলো হচ্ছে না এসব বাদ দিয়ে সাহিত্য ফায়িত্য তেমন কিছু জরুরী ব্যাপার নয়"।
--------------------------++--+-----+---++--------------_------------:
                                          আটমাস বেকার,
বন্ধুদের অনুগ্রহে দিনযাপন , এ অবস্থায় আমার চেয়ে বেশি কে বুঝবে"।

কবি রায়চৌধুরীর "অন্ধকারে" কবিতায় অন্ধকারের মধ্যে আলোর অনুসন্ধান এভাবে উপলব্ধি করেছিলেন---
"পাথরে আচ্ছন্ন রাত্রি । বাতাসে শ্রবণ তুমি রাখো অন্যমন
শুনতে পাবে, কে যেন বলছে মগ্ন এক রূপকথা।
পৃথিবীর শূন্য সব বাগানের অধ্রুব শাখায়
সেই যাদুকর এসে মায়ামন্ত্রে ফোটায় কুসুম ।
ঘুম ভেঙ্গে তুমি আমি দেখতে পাই শিশিরে আলোতে
দিগন্ত আচ্ছন্ন আর গায়ক পাখিরা স্বচ্ছতায়
গান গাইছে"।
কবি মানস রায়চৌধুরী সময়ের ব্যবধানে আশা-নিরাশায় পরিণত হয় , এ ধরনের বিষাক্ত শূন্যতাবোধ --কে কবিতায় স্থান দিয়েছিলেন ----উদাহরণ
"ঘরের ফুলদানি জুড়ে রজনীগন্ধার গাঢ় পুরোনো সুবাস
পারাপার সহজ হলেও তার সান্নিধ্য সহজ নয়, আর
সাহস জেগে থাকে স্মৃতি,  কৈশোর ও তারুণ্যের ফেলে আসা মাঠ"।
কবি মানস রায়চৌধুরী বুদ্ধিমান সমালোচক ছিলেন , সাম্প্রতিক কালের কবিতা নিয়ে তার সুচিন্তিত বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য----
"কবিতা নিয়ে একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার ।ইদানীংকার বুশ - সার্ট- ট্রাউজার - পরা  দেড় হাজারী কভেনেন্টেড স্টাফ চেহারার কবিতা দেখলে ঘুম পায়। চৌকো অথবা দোহারা লম্বা কবিতা, পয়ারে লেখা, প্রায়শই মিল থাকে, কিন্তু তা একেবারে মাপা, কোন অভাবনীয় ঘটনা নেই। প্রতি লাইন ছন্দে নির্ভুল, বিষাদ,জ্বালা,শোক অস্তিত্ব   ইত্যাদি শব্দের যান্ত্রিক প্রয়োগে নির্ধারিত রচনা দেখলে মাথায় খুন চাপে । একটা হেস্তনেস্ত করতে চাই। কবিতা, হয়  উঠে যাক, নয় একটা অচেনা চেহারার আবির্ভাব ঘটুক । এই চেনা শরীর, শারীর সংস্থান , যথাস্থানে ইত্যাদি সবকিছু অপহ্য"।
কবি রায়চৌধুরী বর্তমান লেখকদের লেখা পড়ে যাঁরা নাসিকাকুঞ্চন করেন তাঁদের জন্য জানিয়েছেন।

"কে কাকে নম্বর দেয় ? একজন আঁধার বলে তুমি কী আঁধার!
কথা শুনে হেসে ওঠে আলোকিত দীপ্ত চারিধার।
"একটু আস্তে কথা বলো', অহমিকা তা-ও  এর কাছে
কুন্ঠায় লজ্জায় যেন পিঁপড়ে হয়ে আছে।
কে কাকে সামান্য বলে? গবেষণা রাক্ষসের দেখেছ তো দাঁত
আমরা দেখেছি আরো, সুন্দরের অন্তরালে রক্তাক্ত করাত  
একবার এসো তোমরা, এসো হে, সাহিত্য-বৈশ্য,এসো অনম্বর
অনন্তে উত্তর লিখি , নীলিমায় মেঘপত্রে, কেমন কলমে দেবে পাসের নম্বর"!
 কবি মানস রায়চৌধুরী সারা জীবন ধরে কবিতা, জীবন কবিতাকে নিয়ে সমালোচনা সব কিছুরই জবাব দেন কবিতায় এবং দীপ্তভঙ্গিতেই , এজন্যই কবি রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

2 Comments