জ্বলদর্চি

দেশান্তরী-১১/হিল্লোল রায়


দেশান্তরী-১১

হিল্লোল রায়


রাজা হেথায়পূজা সেথায়চলে অভিসার

শীতের রাতে রাস্তার নিশ্চুপতার মাঝে আমরা দুটি প্রাণী-ডঃ চৌধুরী ও শ্রীমান। আর্গোসিতে ফিরতে প্রায় রাত ৯-১৫ মিনিট।

সঞ্চয় ঘোষ ও আমার ছোটমামা তুষার নিয়োগী-দুজনে মিলে জম-জমাট আড্ডা বসিয়ে ফেলেছে আর্গোসিতে ড্রইং রুমে। আমার আকস্মিক প্রবেশ ওঁদের গুরুগম্ভীর আলোচনায় ক্ষণিকে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিল। আমিও নিজেকে কিছুটা অপ্রস্তুত মনে করলাম এবং ওঁদের আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটানোয় কিছুটা লজ্জিত ও হলাম।

কিন্তু আগেই বলেছি,- বন্ধুবর সঞ্চয় ঘোষ হল নিষ্প্রাণ আলোচনায় সজীবতা আনতে এক অত্যাশ্চর্য্য “এনারজাইসার”।

-“হ্যাভ এ লুক এ্যাট হিরে-হি ইস নট স্লীপিং-অলোয়েজ থিংকিং অন ইমিগ্রেশ্যান”সঞ্চয়ের কথাগুলো বলতেই ছোটমামাও মুচকি হেসে আমাকে আলোচনায় অংশ নিতে পরোক্ষ ইংগিত জানালেন। আমিও সানন্দে ছোটমামার চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে চাঙ্গা হওয়ার চেষ্টা করলাম।

ইমিগ্রেশ্যানের প্রস্তুতি নিয়ে আমার পেছনে লাগার বিষয়টা নতুন আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল। আমাদের তিনজনের আলোচনার মুখরতা তখন সপ্তমে। উৎসাহকে দ্বি্গুণ করার প্র্য়াসে উইলস ফ্লেকের মুখাগ্নি করে নেওয়া হল।


আলোচনা চলছে তো চলছেই। ইমিগ্রেশ্যান ছাড়াও অন্য বিষয়বস্তুও আলোচনার মাঝে এসে ভীড় করেছেএদিকে শীতের রাতঘড়িতে কটা বাজে কারও খেয়াল নেই। যখন হুঁষ হল তখন রাত ১১-২০।

-আর নয় চলিশুভরাত্রি-বলে সঞ্চয় ঘোষ আর্গোসি থেকে বিদায় নিল রাত সারে এগারোটায়। আগামী কাল অর্থাৎ নভেম্বর ৯১৯৭৪ শনিবার আমাদের কর্মপ্রস্তুতি অর্থাৎ পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট ব্যাপারে নতুন প্রচেষ্টা শুরু করার প্রোগ্রাম ঠিক করা রইল। বেশ একটু রাত করে শোওয়ার ফলে ঘুম আসছিল না। তার উপর কাল আবার আলিপুর ছুটতে হবে -এই সব ভেবে মনটা সুস্থ ছিল না একটুও। যাই হোক খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে শুতে রাত সওয়া -বারোটা। আবার ভোরে উঠে ছুটতে হবে তো!

খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় ৬-৩০ নাগাদনভেম্বর ৯১৯৭৪ শনিবার। কারণ আজকের কাজের চাপ ভীষণ বেশী। ঘুম থেকে উঠেই ছুটলাম ডঃ সুবোধচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে। এন.সি.সিক্যাপ্টেন সূত্রে ডঃ চৌধুরীর কাছ থেকে একটা “ক্যারাকটার সার্টিফিকেট” নিলাম। ওঁর ওখানেই আমার ব্রেকফাস্ট-কাজুচানাচুর ও গরম কফি দিয়েই। সামান্য গল্পগুজব করে ডঃ চৌধুরীর বাড়ী থেকে বেরুলাম সকাল ৭-৪০তারপর সোজা আর্গোসিতে। আনন্দবাজারের হেড লাইনগুলোতে চোখ বুলাতেই সাড়ে আটটা। ব্যস্ত হয়ে ছুটলাম স্নান করতে। কারণ সঞ্চয় ঘোষ ও আমি আলিপুর যাব সকাল ৯-১২ এর ট্রেণ ধরে।

http://www.jaladarchi.com/2023/03/late-sandeep-dutta-in-respect.html


আলিপুর পুলিশ সুপারের অফিস আগে কোন দিনও যাই নি। তার উপর কলকাতার ডালহৌসী-এসপ্ল্যানেড ছাড়া অন্য অঞ্চল সম্পর্কে আমার পরিষ্কার ধারণাও নেই-না যাওয়ার সূত্রে। সঞ্চয়ের শনিবার অফিস ছুটি থাকায় সংগী হিসাবে ওঁকে পেলাম। আমরা দুজনেই গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছালাম-এগারোটা চল্লিশ মিনিট নাগাদ। পুলিশ সুপার মিঃ অমল দত্তর চেম্বারে ঢুকবার আগে অনুমতি নিতে হল। তারপর প্রবেশাধিকার পত্রে আমাদের নাম-ঠিকানা ও দর্শন হেতু সমস্ত কিছু লিখে আমরা ভিজিটরস ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছি। মিঃ দত্তের দ্বাররক্ষী ও পিওন সর্বদাই ব্যস্ত। এদিকে তখন ওয়েটিং রুমে কম করে পঞ্চাশ জন লোক অপেক্ষারত। তারপর আমাদের ডাক পড়বে। অর্থাৎ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ভাবছি কি করব। পুলিশ ব্যারাকে গিয়ে অপেক্ষা করাটাও রীতিমত বিরক্তিকর ব্যাপার।

লাক ভালো থাকায় মিঃ দত্তের পিওন ভূলক্রমে আমাদের স্লিপখানা এনে ওয়েটিং রুমে ডাকতে শুরু করলো মিনিট পাঁচেক পরেই। অন্যান্য সবাই একটু রোষান্বিত চোখে আমাদের দুজনকে দেখছেন। ব্যাপারটা কি হল, “ওঁরা পরে এসেই এ মুহূর্ত্তেই ঢুকবার অনুমতি পেয়ে গেলেন, "শ্লাএখানেও জোচ্চুরী” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা ঢুকে পড়লাম মিঃ অমল দত্তের চেম্বারে।

-নমস্কার!

সৌজন্যমূলক নমস্কার জানিয়ে আমি ও সঞ্চয় ঘোষ আমাদের পদার্পণ বিশ্লেষণ করলাম। সমস্ত বিষয় মন দিয়ে শুনলেন মিঃ দত্ত। আমার কাগজপত্র দেখালাম। ডাকের গোলমালে ভিসা পাবার ব্যাপারে আমার দেরী হওয়ার ব্যাপারটা তিনি শুনলেন।

-খুবই ভালো কথাউচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকা যাবেন সত্যি-ই আনন্দের খবর-বল্লেন মিঃ দত্ত।

-আমি কি সাহায্য করতে পারি?

সমস্ত কাগজ দেখার পর মিঃ দত্তসঞ্চয় ঘোষ ও আমার আলোচনার সারাংশ নিম্নরূপঃ

-হ্যাভ ইউ গট ইওর পাসপোর্ট মিঃ রে?

-ইয়েস

-মিঃ রে রিকয়ার্স এ পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট স্টেটিং দ্যাট হি হ্যাজ নাইদার বিন কনভিক্টেড অফ নর বিন এ্যারেস্টেডএ্যান্ড মে বি গিভন এ ভিসা ফর হায়ার স্টাডিজ। সঞ্চয় ঘোষের উক্তি ।

-ওকে ইউ বেটার রাইট অ্যান অ্যাপ্লিকেশন ফর দ্যাট। আই উইল ট্রাই মাই লেভেল বেস্ট সো দ্যাট ইউ ক্যান হ্যাভ ইট আর্লি।

-ওয়ান থিং আই লাইক টু নো মিঃ দত্তইজ ইট নট ফানি দ্যাট আই গট মাই পাস্পোর্ট বাট নো পুলিশ ভেরিফিকেশান ইজ ডান সো ফার।

-ডু ইউ থিংকদ্যাট উই অলওয়েজ কন্ডাক্ট দি ভিজিবল ইন্সপেকশান। সামটাইম ইউ ডু সো ফ্রম হেয়ার।

অতি কষ্টে আমি ও সঞ্চয় হাসি চেপে রাখলাম। কারণ আলিপুর অফিসে বসে হাবড়ায় ইন্সপেকশান হয় না। পুলিশবাহিনীর সক্রিয়তায় মনে মনে হাসি পেলেও প্রয়োজনের তাগিদে চটিয়ে দেওয়া অনুচিত মনে করলাম। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মিঃ দত্তের পরামর্শমত পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্র্টফিকেটের জন্য একটা এ্যাপ্লিকেশন ওঁর হাতেই দিয়ে দিলাম। উনিও সঙ্গে সঙ্গে লাল কালি দিয়ে সই করে পিওন ডেকে স্পেশ্যাল মেসেঞ্জার দিয়ে আন্দুলরাজ রোডে অবস্থিত ডিস্ট্রিট ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ (D.I.B) অফিসে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন সংগে সংগেই। আমরাও নমস্কার বিনিময় করে মিঃ দত্তের চেম্বার থেকে বেরুলাম বেলা ১টা নাগাদ।

ক্ষিদে পেয়েছে বেশ। কারণ হাবড়া থেকে ৯-১২ এর ট্রেণ চেপে এসেছি। তখনকার খাবারগুলো ততক্ষণে পাকস্থলীর পরিপাক ক্রিয়াকে অনেক সহজতর করে নিয়ে এসেছে। কিংবা সারাংশ দেহের রক্ত তৈ্রীর কাজে লেগে গিয়েছে। সঞ্চয়ের অবস্থাও তাই। ওখানকারই পুলিশ ক্যান্টিনে ঢুকে কেকবিস্কুট ও চা খেয়ে পেটটাকে কিছুটা ঠান্ডা করবার চেষ্টা করলাম। বেলা ১-৩০টায় আলিপুর পুলিশ সুপারের অফিস ছেড়ে বেরুলাম। তারপর “শুরু হল পথ চলাশুরু হল কথা বলা।” আমি ও সঞ্চয় হেঁটেই আসছি। শীতের দুপুরে সূর্যের তেজ বেশিক্ষণ ভালো লাগছিল না। তবুও হাঁটছিপথ চলছিকথা বলছি। এবার আমাদের লক্ষ্য আন্দুল রাজ রোডের ডি.আই.বি.অফিস। লোকমুখে জিঞ্জাসা করে আসতে আসতেই বেশ সময় কেটে গেল। যখন গিয়ে পৌঁছালামতখন ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটে।

ঘুরে ফিরি দ্বারে দ্বারেহতাশ হই বারে বারে

শনিবার আমাদের দেশের অফিস সাধারণতঃ ২-৩০ টের মধ্যেই ছুটী হয়ে যায়। কাজেই কোন কাজ হবে কিনা তাই নিয়ে আমি ও সঞ্চয় ঘোষ পরামর্শ করছিলাম। ডি.আই.বিঅফিসে ক্লারিক্যাল স্টাফরা অফিস থেকে বের হতে শুরু করেছেন আমরা পৌঁছানোর পর থেকেই। কষ্ট করে পায়ে হেঁটে আসাটা কি ব্যর্থ হয়ে যাবেডি.আই.বিস্টাফদের সংগে দেখা করতে গেলে একতলায় উপবিস্ট প্রহরীর খাতায় নাম লিখিয়েসই করতে হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে তবে দোতলায় উঠতে হবে। প্রহরী তো কোন কথাই শুনতে চায় না। অনেকক্ষণ গাঁই-গুঁই করে শেষ পর্য্যন্ত শুনলো আমাদের আগমনের হেতু। আমরা যখন বললামআলিপুর এস.পিঅফিস থেকে ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ অমল দত্ত একটা এ্যাপ্লিকেশন কিছুক্ষণ আগে স্পেশ্যাল মেসেঞ্জার দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং সেটা আপনাদের অফিসে পৌঁছেছে কিনা সেটুকু জানতে চাই।

প্রথমে রাজী না হলেও আমরা নাছোড়বান্দা হলাম এবং শেষ পর্য্যন্ত ঢুকবার অনুমতি জোর করেই আদায় করলাম। সঞ্চয় আমার কাগজপত্র নিয়ে নীচেই অপেক্ষা করছিল। আমি সোজা দোতলায় উঠে গিয়ে ডি.আই.বি. (হেড২৪ পরগণা)র সংগে দেখা করে পরিস্কারভাবে পুলিশ ক্লীয়ারেন সার্টিফিকেটের ব্যাপার বুঝিয়ে বল্লাম। উনিও শুনলেন। হায়ার স্টাডিজ এর জন্য বিদেশ আসছি শুনে উনিও খুব খুশী হলেন। “যথাসাধ্য সাহায্য নিশ্চই করব”আশ্বাসও দিলেন -এখন তো ক্ল্যারিক্যাল স্টাফ কেউ নেই। শনিবারের বাজার সবাই বাড়ী মুখী। আপনি কষ্ট করে সোমবার সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ আসুন।”-আচ্ছা চলিনমস্কার। বলে চলে এলাম।

আন্দুল রাজ রোডের ডি.আই.বিঅফিস থেকে বেরিয়ে এলাম বিকাল তিনটে নাগাদ। সঞ্চয় নীচেই আমার কাগজপত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আলোচনার সারাংশটুকু তুলে ধরলাম ওর কাছে। পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে মুচকি হাসি বিনিময় করে আবার দুজনে পথ চলছি। আসতেই ট্রাম পেয়ে গেলাম। দুজনে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম এসপ্ল্যানেড মুখী ট্রামে। এবার আমাদের গন্তব্যস্থল- “চাইল্ড এ্যান্ড কোং৩এ চৌ্রংগী রোডকলকাতা-১৩।”

এটা একটা ফটোর দোকান। হ্যারিসন রোডস্থ পূরবী সিনেমা হলের সংলগ্ন চৌধুরী স্টুডিও থেকে আমার পাসপোর্টের ছবি তুলেছিলাম। নেগেটিভ ৬ খানা আমার সঙ্গে ছিল। চাইল্ড এ্যান্ড কোং-এ নেগেটিভ ৫ খানা দিয়ে ভিসার জন্য ১ ১/২ ''x১ ১/'' সাইজের ৬ কপি ফটো তুলে দিতে বল্লাম। সবশুদ্ধ বিল হল ২ টাকা ৫৫ পয়সা। এর মধ্যে ২ টাকা এ্যাডভান্স দিয়ে সোমবার র্থাৎ নভেম্বর ১১১৯৭৪ বিকাল ৬টা নাগাদ ডেলিভারী নেওয়ার কথা বলেই ক্যাশমেমো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

সঞ্চয় ও আমি দুজনেই বেশ ক্লান্ত। ক্লান্ত শরীরটাকে চাঙ্গা করতে চায়ের সংগে “টা” খেতে ঢুকলাম ধর্মতলা রোডের ছোট্ট চায়ের দোকান অন্নপূর্ণা টি স্টলে। পঁচিশ পয়সার ভাঁড়ের চা ঠিক মেজাজ আনতে পারল না। কিছুটা বিরক্ত হলাম দুজনেই। ফালতু পয়সা গচ্চা গেল। সঞ্চয় বেশ বিরক্তই হচ্ছিল। পয়সাটা নেহাৎই অনিচ্ছাসত্ত্বে দিয়ে আমরা শিয়ালদাগামী ১২ নম্বর ট্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে উঠলাম। শনিবারের অফিস ছুটির পর উপচে পড়া ভীড়।

কোনরকমে গুঁতোগুঁতিধাক্কাধাক্কি করে উঠলাম দুজনেই। শিয়ালদা আসতেই বিকাল ৪-২৫ হল। সঞ্চয়ের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমরা দমদম জংশনে ৫টা নাগাদ পৌঁছে পায়ে হেঁটে যাচ্ছি সঞ্চয়ের পিশেমশায়ের বাড়ীতে। এক ঘণ্টা মত গল্পগুজব করে ওখান থেকে হেঁটে আবার দমদম জংশন স্টেশনে। শিয়ালদা থেকে বিকাল ৫-৪৫ এর ট্রেণটা বোধহয় একটু লেট করে ছেড়েছিল কারণ আমরা সন্ধ্যা ৬-১০ নাগাদ জংশন থেকে ট্রেণটা পেয়ে গেলাম। ভালই হল। সময় বাঁচল কিছুটা।

হাবড়া স্টেশন পৌঁছালাম সন্ধ্যা ৭-১৯ নাগাদ । বাড়ী ফিরবার পথে হাবড়া থানায় গিয়ে অফিসার -ইন-চার্জ (যিনি পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটের ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন আশ্বাস দিয়েছিলেন)- এর সংগে দেখা করে আজকের ঘটনার সমস্ত কিছুই বলে এলাম। তারপর পায়ে হেঁটে ডঃ সুবোধ চৌধুরীর বাড়ীতে।

ডঃ চৌধুরীর ড্রইংরুমে ঢুকতেই সাদর অভ্যর্থনা পেলাম। সারাদিনের ছুটাছুটির পর ক্লান্তি যেন কিছুটা কমল ডঃ চৌধুরীর সংগে কথা বলে। উষ্ণ চা এর সংগে চানাচুর সৎ্কার করে আমিসঞ্চয় ঘোষ ও ডঃ চৌধুরী প্রায় দেড় ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম। ডঃ চৌধুরী যথাসাধ্য সাহায্য করবেন বল্লেন এ ব্যাপারে। প্রয়োজন হলে বারাসাত মহকুমার এস.ডি.ও (যিনি ডঃ চৌধুরী-র সংগে ভীষণ পরিচিত এবং বন্ধু পর্য্যায়ের) -কে দিয়ে জোগাড় করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

শীতের রাত। আর্গোসিতে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় রাত ৯টা বেজে গিয়েছে। সঞ্চয়কে মিনিট পনেরো বসিয়ে গল্পগুজব করে বিদায় জানালাম। বেশ ক্লান্ত। হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নিলাম। শুতে যেতে যেতে প্রায় ৯-৪৫ মিঃ। পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটটা না পাওয়া পর্য্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না।

ভোর ৬-৫০ নাগাদ ঘুম থেকে উঠলাম আর্গোসিতে আমাদের পাড়া প্রতিবেশী সন্তোষ রায় নামে জনৈক ভদ্রলোক পুলিশের আই.বিঅফিস কৃষ্ণনগর চাকরি করেন। তাঁর কাছেই ছুটলাম নভেম্বর ১০১৯৭৪ রবিবার। ভদ্রলোক একটা চিঠি লিখে দিলেন আন্দুলরাজ রোডের আই.বিঅফিসের ক্ল্যারিক্যাল স্টাফ সুহাস রায়চৌধুরীর সংগে দে্খা করতে। সন্তোষ বাবুর চিঠিখানা নিয়ে আর্গোসিতে ফিরে এলাম সকাল ৯-৩০ নাগাদ। দুপুরে বিশ্রাম নিলাম সন্ধ্যায় সঞ্চয়ের পদার্পণআর্গোসিতে। আলোচ্য বিষয় “পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট”।

আমার যায় বেলাদেখি ধৈর্য্যের খেলা

নভেম্বর ১১১৯৭৪ সোমবার খুব ভোরে ৬-০৫ নাগাদ উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। আজকের দিনটা ভীষণ কর্মব্যস্ততায় কাটবে বুঝতে পারছি। হাবড়া থেকে সকাল ৭-১২ এর ট্রেনে চলে এলাম । আন্দুলরাজ রোডের ডি.আই.বিঅফিসে পৌঁছালাম ৯-৩০। ক্ল্যারিক্যাল স্টাফ তখনও কেউ আসে নি। প্রহরীর মুখে শুনলাম এগারোটার আগে নাকি কেউ আসেন না। বাধ্য হয়ে নীচে একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলাম। মাঝে মাঝে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে সময় কাটাবার চেষ্টা করছি।

-আরেআপনি এখানেকি ব্যাপারহঠাৎ প্রশ্ন করলেন মিঃ জোয়ারদারহাবড়া থানার ডি.আই.অফিসার। সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা মনে করিয়ে দিতেই উনি বল্লেন,

-বেশ ভালই হলআপনাকে আজই পাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

স্বয়ং আই.বিঅফিসার আমার সংগে ডেকে কথা বলছেন দেখে গেটের প্রহরী কিছুটা বিস্ময় বোধ করছিল। এবার ঢোকার অনুমতি চাইতে গেলে উনি আর আপত্তি জানান নি।

-স্বয়ং অফিসার যখন আপনাকে চেনেনতখন আর চিন্তা কিআপনি ওঁর সংগেই ঢুকে পড়ুন। কিছু স্লিপ লাগবে না। প্রহরীর বক্তব্য।

আমিও মিঃ জোয়ারদারের পিছু নিলাম। আসন্ন কালীপুজা উপলক্ষ্যে শান্তি বজ়ায় রাখার জন্য আই.বিঅফিসারদের একটা কনফারেন্স হচ্ছিল ঐদিনই। সেই উপলক্ষ্যে মিঃ জোয়ারদারের আগমন। আই.বিঅফিসারদের মিটিং চলছে। আমি এক কোণে চুপচাপ বসে সব কিছু শুনছি।

আই.বিঅফিসার মিঃ জোয়ারদারের সংগে পরিচিত হবার ফলে সবাই আমার দিকে একটু তাকাচ্ছিলেন। মিঃ জোয়ারদারও দু-একজন অফিসারের সংগে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং হায়ার স্টাডিজ- জন্য বাইরে আসছি সে কথাও উল্লেখ করলেন আলোচনা প্রসংগে। পারস্পরিক সৌজন্য বিনিময় করেই আমরা চেয়ারে বসে পড়লাম। একটু বিরক্ত লাগছিল নিজেরইকারণ সকাল ৯-৩০টা থেকে দুপুর ২-৩০ টে পর্যন্ত নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে থাকা তখন আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। কারণ অফিস কামাই দিয়ে এই সমস্ত কাজগুলো করছি। অফিসের লোকেরাই বা কি ভাববে?

কনফারেন্স শেষ হতেই মিঃ জোয়ারদারকে একটু 'রিমাইন্ডারদিলাম।

-ঠিক আছেআপনার সার্টিফিকেট আমি লিখে ফেলেছি। শুধু টাইপ করিয়ে নিলেই হল।

মিঃ জোয়ারদার বল্লেনঃ

-আপনি টাইপিং সেকশনে চলে যান।

কিন্তু টাইপিং সেকশনের টাইপিস্ট সবেমাত্র “টু হুম...” টাইপ করতে শুরু করেছেন। সংগে সংগে হেড ক্লার্ক বলে উঠলেন

-ওটা টাইপ করবেন না। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। আপনি পাস্পোর্ট অফিসে চলে যান। ওখান থেকেই পাবেন।

আমি বললামঃ

-আমার DSL 869 ফর্মে লেখা আছে লোক্যাল পুলিশ স্টেশন থেকে নিতে হবে।

-না। ঐরকম কোনো সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। ১৯৪৮ সালে একজন 'জিওকেমিষ্ট কে জেরক্ম সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। তারপরের ক্যান্ডিডেট আপনি...... হেডক্লার্ক বললেন।

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সুহাস রায়চৌধুরীর সংগে দেখা করে ব্রাবোর্ণ রোডস্থিত পাস্পোর্ট অফিসে ঢুকলাম। পৌঁছাতে প্রায় ৩-৩০ হল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ সমস্ত দিনটাই পন্ড। দেরী হওয়ার ফলে ঊর্ধ্বতন অফিসার কারোর সংগে দেখা করবার অনুমতিটুকু পর্যন্ত পেলাম না। কারণ ২-৩০ -এর মধ্যে দেখা করতে হয়।

সৌভাগ্যক্রমে ঐ পাসপোর্ট অফিসের লাইনে জনৈক অবাঙ্গালী মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের সংগে পরিচয় হল। সাদা হাফপ্যান্ট ও শর্ট পরিহিত ভদ্রলোক-কে বেশ স্মার্ট লাগছিল। ওঁকে আমার পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটের ব্যাপারগুলো বল্লাম। উনি বললেনঃ

-ইউ সিদিজ টু পিওন্স (পাব্লিক রিলেশানস অফিস এবং পাসপোর্ট অফিসার আর পি.এদের দুজনের চেম্বারে দাঁড়িয়ে থাকা পিওন দুটোউইল ডু মিরাকল ফর ইউ। জাস্ট গিভ টু রুপিসএন্ড হি উইল ডু এভরিথিং ফর ইউ।

-দ্যাটস ট্রু?

-ইয়্যাঁইন মাই কেসআই ডু ইট এভরি টাইম । ওই মেরিন ঞ্জিনিয়ারের নাম আজ আমার মনে নেই। কিন্তু অশেষ উপকার আমার করলেন নতুন উপায় বাৎলে দিয়ে ।

আমিও পিওন দুজনকে না চটিয়ে ওনার পরামর্শ মত আগামীকাল অর্থাৎ নভেম্বর ১২১৯৭৪ মংগলবার সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে আসব ঠিক করলাম।

নভেম্বর ১১১৯৭৪ দিনটা বৃথায় কেটে গেল। অফিস কামাই হয়ে গেল শুধু শুধু। বিকাল ৩-৩০টে থেকে ৫টা পর্যন্ত সময় কাটাবার জন্য সি.এম.পি. গেলাম। ওখানে বড়মামার বন্ধু এবং মেজমামার সহপাঠী একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ অজিত ভূইঞ্যাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। গল্পগুজব করে ওঁকে ছেড়ে বেরুলাম বিকাল ৪-৩৫ নাগাদ। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে সোজা ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস ইন্সটিটিউশনেসঞ্চয় ঘোষের চেম্বারে। সঞ্চয়ের ওখানে গিয়ে ঢুকলাম ৫-০৫ মিনিট। ওঁদের অফিস পাঁচটায় ছুটী হয়। ওঁর সংগেই বেরিয়ে এলাম। অফিসের সামনের “সাবিত্রী কেবিনে” চা ও কেক খেয়ে ধর্মতলা রোড পেরিয়ে চৌ্রংগী রোডস্থ চাইল্ড এ্যান্ড কোং-এ। ভিসার ফটো ডেলিভারী নেওয়ার জন্যই গেলাম। দু টাকা এ্যাডভান্স দেওয়া ছিল। বাকি পঞ্চান্ন পয়সা দিয়ে মোট ছকপি ফটো ডেলিভারী নিয়ে এলাম।

অফিস ছুটির পর ট্রামে-বাসে বাদুড়ঝোলা অবস্থা। পায়ে হেঁটেই শিয়ালদা যাবার পরিকল্পনা করলাম।

আজ সারাদিন হেঁটে হেঁটে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তবুও ভবিষ্যৎ সুখের আশায় এগুলোকে কষ্টই মনে হচ্ছে না। শিয়ালদা থেকে সন্ধ্যা ৬-৫২ মিঃ-এর ট্রেন ধরলাম। হাবড়ায় পৌঁছাতে রাত ৮-০৫চা খেয়ে ডঃ চৌধুরীকে সমস্ত কিছু জানিয়ে আমি ও সঞ্চয় পরস্পর বাড়ির দিকে এগুলাম। রাত তখন ৯-৩০টা।

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments