জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ইউক্রেন (ইউরোপ)পাতা ঝরার গল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ইউক্রেন (ইউরোপ)
পাতা ঝরার গল্প

চিন্ময় দাশ

হাজার হাজার বছর আগের কথা। 
এক দিন দেখা গেল, ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সবাই বুঝে গেল, শীত আসছে। পাখির দল, যে যেখানে ছিল, দক্ষিণে গরমের দেশের দিকে ডানা মেলে দিল। বসন্তকাল অবধি সেদিকেই থেকে যাবে তারা। 
একটা পাখি ছিল, যার একটা ডানা ভাঙা। উড়তে পারে না বেচারা। লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয় তাকে।
এখন কী করা যায়, কী করা যায়-- পাখিটা বুঝতেই পারছে না। এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়। এদিকে যায়, ওদিকে যায়। যেতে যেতে, বড় বনের কাছে গিয়ে হাজির।
বনটা বেশ বড়ই। অনেক গাছগাছালি। বড় বড় সব গাছও অনেক সেখানে। নিশ্চয় শীতকালটা কাটানো যাবে এখানে। এই ভেবে, বেশ ভরসা এলো মনে। সামনে একটা সিলভার বার্চ গাছ। 
পাখিটা লাফিয়ে লাফিয়ে, ডানা ঝাপটিয়ে গাছটার কাছে গিয়ে বলল—বার্চদাদা, বার্চদাদা! আমার তো একটা ডানা ভাঙা। উড়ে দূর দেশে চলে যাবো, সে ক্ষ্মতা নাই। বসন্তকাল আসা পর্যন্ত তোমার ডালগুলোতে একটু থাকতে দেবে আমাকে? 
--কী যে বলো না, তার নাই ঠিক। বার্চগাছটা বলল—শীতে তো আমারই সঙ্কট। নিজের পাতাগুলোকে বাঁচাতেই হিমসিম খেয়ে যাবো আমি। তার উপর আবার তোমার বোঝা? হবে না গো। অন্য কোথাও যাও তুমি। 
ভাঙা ডানা নিয়ে লাফাতে লাফাতে, একটা ওকগাছের কাছে হাজির হল পাখিটা। কত দিনের বিশাল গাছ। পাখি বলল—ওকদাদা, ওকদাদা! ভয়ানক শীত আসছে। আমার তো ডানা ভাঙা। উড়তে পারি না। বসন্ত আসা পর্যন্ত তোমার ডালে থাকতে দেবে আমাকে? 
ওক বলল—এটা একটা কথা হোল? পুরো শীতকালটা আমার ডালে থাকলে, একটা ফলও থাকবে নাকি আমার? সবই তো খেয়ে ফেলবে তুমি? সেটি হচ্ছে না, বাছা। সরে পড়ো এখান থেকে।
কী আর করা যায়! খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এগিয়ে চলল পাখি। কতক্ষণ বাদে হাজির হোল একটা উইলোগাছের কাছে। বলল—উইলো দিদি, উইলো দিদি! আমার তো একটা ডানা নাই। এদিকে শীত তো এসেই গেল। তোমার উষ্ণ ডালগুলোতে একটু থাকতে দেবে আমাকে? বসন্তকাল এলেই, নেমে যাব আমি।
--না, বাপু! সেটি হবে না। উইলো বলল—আলাপ-পরিচয় নাই, জানি না, শুনি না—এমন কারও সাথে কথাই বলি না আমি। থাকতে দেওয়া তো অনেক পরের কথা। ভালোয় ভালোয় সরে পড়ো এখন।
ভয়াণক ঘাবড়ে গেল পাখিটা। বড় আশা করে এসেছিল বনের কাছে। এতসব বড় বড় গাছ। ছোট্ট একটা পাখিকে কটা দিন একটু আশ্রয় দেবে নিশ্চয়। কিন্তু কেউ তো সাড়া দিল না। উপায় তো কিছু নাই। বেঘোরেই মারা পড়তে হবে। 
কোন রকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলেছে। যাচ্ছে কোথায়, নিজেই জানে না সে। 
--কীগো, পাখির ছানা! চললে কোথায়? আহারে, একটা ডানাও তো আবার ভাঙা দেখছি। 
পাখিটা চমকে গেল। কী মিষ্টি গলা! অতো দরদ দিয়ে কে বলছে কথাগুলো! এদিক ওদিক তাকাতে লাগল পাখি। সামনে একটা স্প্রুস গাছ। গাছটা বলল—আমি গো, আমি বলছি কথাগুলো। কোথায় চলেছ খোঁড়াতে খোঁড়াতে?
মিষ্টি গলা শুনে, মন ভরে গেল পাখির। দুঃখের কথা শোনালো গাছকে—শীতকাল আসছে। সব পাখি চলে গিয়েছে দক্ষিণে, গরমের দেশে। আমার তো ডানা ভাঙা। উড়তে পারি না। তাই একটু আশ্রয় খুঁজতে বেরিয়েছি। কতো গাছকে বললাম কাকুতি মিনতি করে। কিন্তু একজনও থাকতে দিল না আমাকে।
গাছটা বলল—চিন্তার কী আছে? ঝাঁকড়া ডালপালা আমার। এখানেই থেকে যাও। আরামেই থাকবে। 
পাখি তাকিয়ে দেখল, গাছটার পাতা সরু আর ছুঁচালো। তবে, গাছটা ভারি ঝাঁকড়া। ঘন ডালপালা। আরামেই থাকা যাবে এখানে।  


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


বেশ ভরসা এল পাখির মনে। গাছকে বলল—সারা শীতকালটা থাকতে দেবে আমাকে? বসন্ত আসা পর্যন্ত? 
স্প্রুস বলল—হ্যাঁগো, হ্যাঁ। দেবো থাকতে। তুমি থাকলে, ভালোই লাগবে আমার।
পাশেই ছিল বড়সড় একটা পাইন গাছ। সব দেখছিল এতক্ষণ। সে বলল—আমার পাতার আড়ালে তেমন ওম পাবে না তুমি। তবে ঠাণ্ডা বাতাস আটকে দিতে পারব আমি। কেন না, যেমন বড় আমি, তেমনি শক্ত আমার ডালপালা। ঠাণ্ডা বাতাসকে জব্দ করে দেব আমি।

শুনে ভালোই লাগ্ল। আঁচড়ে কামড়ে গাছে উঠে পড়ল পাখিটা। 
সেখানে অন্য পাশে ছিল একটা জুনিপার গাছ। সবই দেখছিল আর শুনছিল গাছটা। সে বলল—চিন্তা কোর নাগো, বাছা। যত দিন থাকবে, তোমার পেট ভরাবার দায় আমার।  সবাই জানে, আমার তো ডালভরা ফল। জুনিপারের ফল খাবার জন্য, ছোট পাখিদের আখড়া বসে যায় আমার ডালগুলোতে। তোমাকে প্রতিদিন খাবার জুগিয়ে যাবো আমি। নিশ্চিন্তে থাকো এখানে।
আরামেই আছে পাখিটা। ঘন পাতার আড়ালে বাসা পেয়েছে। পাইন গাছ বাতাস আড়াল করে রেখেছে। নিত্যদিন দু’বেলা মিষ্টি ফল জুগিয়ে যাচ্ছে জুনিপার। তোফা দিন কেটে যাচ্ছে তার।
বনের অন্য গাছেরা সেসব দেখে, আর হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরে। 
বার্চ বলে—আমি বাপু কোন অচেনা পাখিকে ডালে ঠাঁই দিই না।
ওক বলে—আমি বাপু কন ঝুঁকি নিই না। ফলগুলো বাঁচাতে হবে তো।
উইলো বলে—অচেনা কারও সাথে কথাই বলি না আমি।
তিনটে গাছই নিজের নিজের অহঙ্কার আর গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
একদিন রাত্রে উত্তুরে বাতাস বনে এসেছে খেলা করতে। সাথে তার বাবা, বরফ-রাজা। বরফের মতই কনকনে হাত মেয়েটিরও। এক একটা গাছের পাতায় হাত বুলোতে থাকে সেই মেয়ে। যে পাতাটিতে হাত বুলোয়, সেটি টুক করে খসে পড়ে গাছের ডাল থেকে। 
গাছেদের এই পাতা ঝরা দেখতে, খালি ডাল দেখতে ভারি মজা লাগে মেয়ের। যে গাছেই হাত ছোঁয়ায়, তারই পাতা ঝরে পড়ে। ডাল খালি হয়ে যায়।
বাতাস-মেয়ে তার বরফ-বাবাকে বলল—বাবা, সব গাছেই হাত বোলাতে পারি আমি? 
বাবা বলল—না, মা। ওটি কোর না। যে গাছেরা ডানা-ভাঙা পাখিদের আশ্রয় দেয়, তার গায়ে হাত বুলিয়ো না। তাদের একটি পাতাও যেন না ঝরে যায়। শুধু গাছ নয় রে, মা। দুনিয়ার যে কেউ, অন্যকে আশ্রয় দেয় যে, ভরসা দেয়, সাহায্য করে—তাদের যেন ক্ষতি না হয় কোন দিন।
বাবার কথা রেখেছে তার উত্তুরে বাতাস মেয়ে। শীতকালে সব গাছের পাতা ঝরে যায়। কিন্তু স্প্রুস, পাইন আর জেনিপার-এর পাতা কোন দিন ঝরে না।

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব সুন্দর গল্প গাছেদের ও ডানা ভাঙা পাখির যা আমাদের জীবনের জন্য শিক্ষণীয়।

    ReplyDelete
  2. সুন্দর গল্প।

    ReplyDelete