জ্বলদর্চি

দেশান্তরী গল্প -১২/হিল্লোল রায়


দেশান্তরী গল্প -১২

হিল্লোল  রায়

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার এর সাক্ষাৎ হলো দৈবাৎ


ভীষণ ছুটাছুটির মধ্যে গতকাল কেটেছে। বেশ ক্লান্তি আসছে শরীরে। তার উপর চিন্তা সার্টিফিকেট না পাওয়া পর্যন্ত। নভেম্বর ১২১৯৭৪ মংগলবার ভোর ৬-৪৫ নাগাদ আর্গোসিতে বিছানা থেকে উঠতে একটুও ইচ্ছে করে নি। তার উপর আবার চান খাওয়া সেরে ছুটতে হবে ব্রাবোর্ণ রোডের পাসপোর্ট অফিসে। প্রয়োজনের তাগিদে শারীরিক কষ্টকে কষ্টই মনে হচ্ছিল না। নভেম্বর ১২১৯৭৪ সকাল ৮-৩৬ এর হাবড়া লোকালে ছুটলাম পাসপোর্ট অফিসে। গিয়ে পৌঁছালাম সকাল ১০-৩৬ মিঃ। আমার মেজভাই কল্লোল (ডাক নাম কমলও আমার সংগ নিল। উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে ওর বিদেশে আসার ব্যাপারে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখা। বিশেষ করে বিভিন্ন অফিস-কোনটা কোথায় অবস্থিত তার একটা ছবি ওর কাছে তুলে ধরা। শিয়ালদা থেকে বাসে -ট্রামে বাদুড়ঝোলা অবস্থা। আমি ও কল্লোল দুজনেই পায়ে হেঁটে পৌঁছালাম পাসপোর্ট অফিসে। দোতলায় বসা জনৈক পিওনের কাছ থেকে পাব্লিক রিলেশন্স অফিসার (P.R.O.) এর সংগে দেখা করবার জন্য স্লিপ নিলাম । কিন্তু P.R.O.র সঙ্গে দেখা করার আগে আমার ঐ স্লিপ টা P.A. To P.R.O. র Coountersign, না হওয়া পর্যন্ত ঢুকতে পারব না। কাজেই P.R.O. র পাশের ওয়েটিং রুমে বসে আছি একা। কমল বাইরে। কমলকে বাইরে রাখার কারণ ওর অনুমতিপত্র মেলে নি। ওর জন্য পাসপোর্ট এ্যাপ্লিকেশন ফর্ম নিলাম একখানা । ওকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে আমি ভেতরে চলে গেলাম। মিনিট পনেরো অপেক্ষার পর P.R.O. র পিওন আমাকে দেখা করবার জন্য ডেকে নিয়ে গেল প্রায় এগারোটা নাগাদ।


P.R.O. ভদ্রলোকের নাম জানি না, অবাঙালীখুব সাদাসিধেউৎসাহী আমার বিদেশ আসার ব্যাপারে।

ইংরেজিতে ওর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল...

-আর ইউ মিঃ রেইউ আর সিকিং ফর এ পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট?

-ইয়েসআই এ্যাম গোইং টু ইউ এস এ ফর হায়ার স্টাডিজ।

-এ্যাজ আই সি ফ্রম ইওর এ্যাপ্লিকেশনইউ কাম ফ্রম হাবড়া রেগুলারলিহোয়ার ইট ইস?

-এ ডিসট্যান্স অব এ্যাবাউট থার্টি মাইলস ফ্রম শিয়ালদা স্টেশন। ইট ইজ অন শিয়ালদা-বনগাঁ রেল লাইন।

-আই থিঙ্ক ইওর ট্রেন জার্নি ইজ টু মাচ টাফ?

-ইয়েসইট টেক্স অল মাই এনার্জি।

-আর ইউ এম্পলয়েড এনি হোয়ার?

-ইয়েসইন প্ল্যাকন লিমিটেড১৩৮ ক্যানিং স্ট্রীটকলকাতা

-ওকে মিঃ রেগ্ল্যাড টু টক উইথ ইউ। আই এ্যাম পুটিং এ্যান আর্জেন্সি অন ইওর এ্যাপ্লিকেশন। আই থিঙ্ক উইদিন থ্রি ডেজ ইউ উইল গেট ইওর পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট।

-থ্যাঙ্ক ইউ

মিনিট পনেরো আলোচনার পর P.R.O. র চেম্বার থেকে বেরুচ্ছি। ঘড়িতে তখন ১১-১৫ মিঃ। মনটা একটু শান্ত হল বটে কিন্তু ভেবেছিলাম আজই অর্থাৎ নভেম্বর ১২১৯৭৪ ঐ সার্টিফিকেট টা পেলে ঝামেলা চুকে যেত

মনে মনে ভাবছি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের কথা। P.R.O. চেম্বার থেকে বেরুতেই পিওন বলল, “পাস্পোর্টের সঙ্গে এ্যাপ্লিকেশনটা ঐ কাউন্টারে জমা দিন। চারদিন পরে একবার খোঁজ নেবেন হল কিনা জানতে?”

আমি ভাবছি টাকা দিলেই (ঘুষ হিসেবে)ঐ সার্টিফিকেট টা পাব হয়ত কিন্তু জীবনে আজ পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে কোন কাজ করি নি তাই কখনকিভাবেকোন মুহূর্তে কাকে টাকা দিয়ে কাজ উদ্ধার করা যায়-সে অভিজ্ঞতা তখনও হয় নি। এটাও ভাবছি পিওনকে টাকা দিতে গেলে ও যদি নিতে অস্বী্কার করেকিংবা দু চার কথা শুনিয়ে দেয় ইত্যাদি...

কাজেই ঐ পিওনের মতিগতি জানার জন্য আমার ডান পকেট থেকে কিছু টাকা বাঁ পকেটে স্থানান্তরিত করলাম পিওনকে দেখিয়েই। ম্যাজিকের মত কাজ হয়ে গেল। পিওনের ও গলার সুর বদলে গেল। আমিও বুঝলাম সে 'লাইনেএসেছে।

আমি শুধোলাম “সার্টিফিকেটটা আমার ভীষণ জরুরীআজই পেলে ভাল হয়। কোনো উপায় নেই আজ পাবার?” বলেই

পকেট থেকে দুটো টাকা বার করছি। পিওন বলছে, “জানেন তো পুলিশ সার্টিফিকেট পাওয়া কত গোপন ব্যাপার। অনেক সময় লাগে। তবে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি তাড়াতাড়ি পাবার। উপায় বলে দিতে পারি।”

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পিওনের পকেটে দুটো টাকা গুঁজে দিতে যাচ্ছি। সংগে সংগে ও একগাল হেসে বলে উঠল, “ ঠিক আছেআপনি আজই পেয়ে যাবেন”।

একটু সরে গিয়ে আড়াল করলো আমাকে। কারণ R.P.O র চেম্বারে বসা পিওন জিনিসটা যদি দেখে ফেলেওকেও তো আবার শেয়ার দিতে হবে।

-দিন আপনার পাস্পোর্ট ও এ্যাপ্লিকেশন ফর্ম। একটা চেয়ার জোগাড় করে আমায় বসতে বলে পিওন চলে গেল ভেতরে কাউন্টারের দিকে। কাউন্টারে ওগুলো জমা দিয়ে Token টা আমাকে এনে দিল মুহূর্তের মধ্যেই। সার্টিফিকেট্ টা আজ পাব কিনা আবার প্রশ্ন করলাম। পিওন মস্তানের মত(নিজের বুক চাপড়েবেশ উদ্ধত গলায় বলে উঠল,

জানেন তো আমি যতক্ষণ আছি -ততক্ষণ আপনার কোনোই চিন্তা নেই। আজ বিকাল চারটেয় আসুনপেয়ে যাবেন।”

পিওনের কথায় বিশ্বাস করতে পারি নি। যে পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য শনি এবং সোমবার দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে পরেছিসেটা আজ বিকালেই পেয়ে যাবএ যেন আলাদীনের প্রদীপঘষে দি্লেই ম্যাজিক এ্যাকশন। উক্ত পিওনকে ভবিষ্যতে আরো “খরিদ্দার” এ ধরণেরজোগাড় করে দেবো আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ১১-২০ নাগাদ।

ওখান থেকে পায়ে হেঁটে সোজা আমার অফিস। আজ আর কামাই করব না। আমার আসতে দেরী দেখে কমলও চলে গিয়েছিল। অফিস গিয়ে পৌঁছালাম ১১-৪০ নাগাদ। যথারীতি কাজকর্ম করে একটু আগে থাকতে বিকাল ৪টায় (৫টার পরিবর্তেঅফিস থেকে বেরুলাম।


নজরানা-তেই হল কাজবলতে আমার নাহি লাজ


অফিসের কাজের পর শরীরটা একটু ক্লান্ত লাগছিল। তবুও পায়ে হেঁটে পাস্পোর্ট অফিসে চলে গেলাম। পৌছালাম বিকাল ৪-২০ মিঃ। সোজা উক্ত পিওনের কাছে চলে গেলাম। ওর ভাব গতিক দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন আমার আগমনের অপেক্ষায় চিন্তামগ্ন। আমার নিজের মনেই আস্থা ছিল না সার্টিফিকেট আজই পাব কিনা। কাঁচুমাচু মুখে প্রশ্ন করলাম, “ আমারটা কি রেডি?”

-আপনার কোন চিন্তা নেইআপনি ডেলিভারি কাউন্টারে চলে যান। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

ওর পরামর্শমত ডেলিভারী কাউন্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাউন্টারে তখন অসম্ভব ভীড়। বিরাট লাইনমনে হল ঘন্টা দুয়েক সবাই দাঁড়িয়ে। কাউন্টারের কাছে যেতে না যেতেই আমার ডাক পড়লো। নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম কিন্তু অন্যান্য সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন নিজেদের মধ্যে

-কি ব্যাপারএকজন তো বলেই ফেললেন।

আমি আসতে না আসতেই আমায় কেন ডাকল তাই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমি কাউন্টারে গিয়ে আমার পাসপোর্ট ও পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট ডেলিভারী নিলাম। তখন মনে হচ্ছিল এই সার্টিফিকেটের জন্য কতই না দৌড়ঝাঁপ করলাম। শেষে কিনা দু টাকায় পেয়ে গেলাম। অবশ্য কিছুটা নিজের অজ্ঞতায় পরিশ্রম করতে হয়েছে কারণ DSL 869 ফর্মে একটা রাবার স্ট্যাম্প মেরে লেখা ছিল, “টু বি কালেক্টেড ফ্রম রিজিওন্যাল পাস্পোর্ট অফিস।”

কথায় বলেলোকে ঠেকে শেখে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল। ঠেকে শিখলাম। দৌড়ঝাঁপ করার প্রয়োজন ছিল না। পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট টা নিয়ে উক্ত পিওনকে ধন্যবাদ জানাবার জন্য আবার ভেতরে ঢুকলাম। নিজের মনে সন্দেহ হচ্ছে ঐ সার্টিফিকেটে কাজ চলবে কিনা -পিওনকে প্রশ্ন করতেই উত্তর পেলাম,

-হ্যাঁহ্যাঁআপনার কোনই চিন্তা নেই। আপনার আমেরিকা যাওয়া কেউই ঠ্যাকায়(উচ্চারণ বিকৃতি 'ঠেকিয়েনা বলেরাখতি পারবে না। আপনি নিশ্চিন্তমনে চলে যান। এই সার্টিফিকেটেই কাজ হবেদ্যাখবেন। এই শর্মা ওসব কাজ খুব ভালো করে জানবেন।

-ধন্যবাদজানালাম পিওনকে । দুটাকার বিনিময়ে পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট -নিজের মনে বেশ হাসি পাচ্ছিল। কষ্ট করে হাসি চেপে বললামঃ

-এত তাড়াতাড়ি সার্টিফিকেটটা আমাকে ব্যবস্থা করে দিলেন কি ভাবে?

পিওন যেন উত্তরটা তৈরি করেই রেখেছি্ল।

-কেনআমি কি তাতে কোন অসুবিধার কারণ করেছিও ফাইলকাগজপত্র তো আমিই ঘাঁটি। আর.পি.ও সাহেবের সীল তো আমার হাতে। আপনি দুটো টাকা দিলেন। আপনার ফাইল সংগে সংগে সাহেবের কাছে নিয়ে গেলাম। সাহেবের সীল আমিই মেরে দিলামকাজ ও ফিনিশ। আপনিও খুশ।

ওর স স কথাগুলো শুনে হাসি আসছে। ভবিষ্যতে আর ও দু-চারটে পাসপোর্ট করাব পিওনকে জানালাম।

-দক্ষিণেডা এট্টু বেশী দিয়েন। তিনদিনের মধ্যেই পাসপোর্ট ডেলিভারী পেয়ে যাবেন ঘরে বসেই। কোনই সুবিধা হবে না। শুধু এই শ্রীমানকে মনে রাইখেন। ব্যাসকাজ হাসিল হইয়ে যাবে। কথার মধ্যে বেশ একটা হিরো মার্কা হাবভাব দেখতে পেলাম।

মংগলবার নভেম্বর ১২১৯৭৪ বিকাল সাড়ে চারটের সময় পুলিশ ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট পেয়ে গেলাম। মনে তখন ভরা জোয়ার। কারণ ভিসা(VISA) সংক্রান্ত সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আজ নভেম্বর ১২১৯৭৪ জোগাড় হয়ে গেল। মনের আনন্দে পায়ে হেঁটে শিয়ালদায় চলে এলাম। সৌভাগ্যক্রমে বিকাল ৫-১০ এর ট্রেণ মিনিট পনেরো 'লেটথাকায় পেয়ে গেলাম। অফিস ফেরৎ প্যাসেঞ্জারদের ভীড় ট্রেণের প্রতিটি কামরায়। তবুও ভবিষ্যৎ সুখের আশায় দাঁড়িয়ে থাকাটাকে একটুও কষ্ট মনে হচ্ছিল না। হাবড়ায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৬-৩০ মিঃ । এই কদিনেঠান্ডার মধ্যে স্নান করা ও হুড়োহুড়ির ফলে সর্দি মত হয়েছিল। বুকটা ব্যথা ব্যথা করছিল। তবুও মনে ভীষণ আনন্দ ভিসা পাবার আশায়। বন্ধু সঞ্চয় ঘোষ আমার সংগে দেখা করতে এল আর্গোসিতে। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭-৪৫ । সমস্ত বিষয় আলোচনা হল। উৎসাহ-উদ্দীপনাহাসি-ঠাট্টা চললো। সঞ্চয়কে বিদায় জানালাম রাত ৯-১৫। এরপর খাওয়া-দাওয়া সেরেগল্প-গুজব করে রাত্রির সুখনিদ্রায়।


আগামীকাল অর্থাৎ নভেম্বর ১৩১৯৭৪ কালীপূজো উপলক্ষ্যে অফিস-স্কুল-কলেজ সবই ছুটী। তার উপর ভিসার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সবই তৈ্রী। নিশ্চিন্তমনে ঘুমাবো এই পরিকল্পনা নিয়ে শুয়ে পড়লাম।। উঠব একটু বেলা করে -কারণ কাল তো ছুটির দিন। ব্যস্ততা বা কিসের?

বুধবার নভেম্বর ১১৯৭৪ বিছানা ছেড়ে উঠলাম সকাল ৭-১৫ মিনিটেআর্গোসিতে। চারিদিকে কালিপূজোর বাজনাপটকায় উৎসবমুখর। হৈ-চৈ মাইকের চীৎকার। ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক 'নিত্যকর্মসেরে চা খেয়ে 'আনন্দবাজারনিয়ে বসেছিলাম। আবহাওয়াটা খুব একটা মনোরম না হলেও উৎসবের মুখরতায় মোটামুটি 'সরগরম'। সকাল ও দুপুরটা ঘুম ও গল্পগুজব করে কেটে গেল। সন্ধ্যার দিকে বেরুব এই পরিকল্পনা করছি। এর মধ্যেই হঠাৎ দুঃসংবাদ পেলামসঞ্চয়ের বাবা শ্রীযুক্ত সন্তোষ ঘোষ পরলোকগমন করেছেন। এই ধরণের সংবাদ মোটেই আশা করি নিনিজের কান দুটোকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ ওর বাবার তো বয়স খুব একটা হয় নি। কিন্তু উজ্জ্বলের (সঞ্চয়ের ভাইমুখে খবরটা শুনে আমি নিজেই মুষড়ে পড়লাম।

পরণে পায়জামাগায়ে বেড কভার (হাতের কাছে কিছু না পেয়েজড়িয়ে ছুটলাম সঞ্চয়ের বাড়িতেবিদ্যাসাগর রোডে। ভীষণ খারাপ লাগছিল কারণ গতকাল রাত্রে আমরা দুজনে কত গল্পগুজবহাসি-ঠাট্টা করলাম রাত ৯-১৫ পর্যন্ত। তারপর সঞ্চয় ওদের বাড়িতে লক্ষ্মী্পূজা উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রণ করল

আর আজ ওদের বাড়িতে শোকের দিন। শুনলাম সমস্ত কিছুই সঞ্চয়ের মুখ থেকে। সান্ত্বনা দিলাম। আমার নিজের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল কারণ ভবিষ্যৎ সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ল সঞ্চয়ের। আশ্বাস দিলাম ভবিষ্যতে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করব।

না সখামনের ব্যাথা কোরো না গোপন

সঞ্চয়কে সান্ত্বনা দিয়ে বেরিয়ে এলাম রাত ৮টায়। ওঁর বাড়ীতে গিয়েছিলাম ৬-৪৫ নাগাদ (বিকাল)। এই সওয়া এক ঘন্টা শুধুই কান্নাকাটিশোকের ছবি দেখলাম। ভীষণ মন খারাপ লাগছিল। সঞ্চয়ের এই আকস্মিক বিপদে নিজেকেই অসহায় লাগছিল।

সঞ্চয়কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আর্গোসিতে ফিরছি। শীতের সন্ধ্যা ৮-টা। লক্ষ্মী্পূজার নিমন্ত্রণ থাকায় কয়েকটা বাড়ীতে (আমার পাড়ারগেলাম। কিন্তু মনে সব সময়ই ভাসছে সঞ্চয়ের পরণবেশবাসপিতৃবিয়োগের মূর্ত্ত ছবিগুলো । নিমন্ত্রণ রক্ষা করে আর্গোসিতে ফিরলাম সাড়ে নটা। সমস্ত ঘটনা বল্লাম বাড়ীতে । রাত্রের ক্ষিদে অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে । মন ভীষণ ভারাক্রান্ত। সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়লাম।

কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কখন ঘুমিয়েছি জানি না।। পরদিন অর্থাৎ নভেম্বর ১৪১৯৭৪ বৃহস্পতিবার উঠলাম ভোর ৬-১৫। আজ আমার কর্মব্যস্ততার হিসেব নেই। কারণ DSL 869 এর জমা দেবার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে আমেরিকা কনসোলেট অফিসে যেতে হবে। আর্গোসি থেকে বেরিয়ে ৮-৩৬ এর হাবড়া লোক্যাল ধরে চলে এলাম শিয়ালদা। সেখান থেকে ভীড় ঠেলাঠেলি করে বাসে চেপে কন্সোলেট অফিসে পৌঁছালাম ১০-৪৫ নাগাদ। রিসেপ্সনিস্ট এর কাছে স্লিপ লিখে তিন তলায় চলে গেলাম মিঃ হিতব্রত রায়ের সংগে দেখা করতে। দেখাও পেলাম।

ডক্যুমেন্টস(Documents) গুলো দেখালাম মিঃ হিতব্রত রায়কে। তারপর নীচে এসে DSP 70 ফর্ম (BIOGRAPHIC DATA FOR VISA PURPOSES) জমা দিলাম। কলসাল অফিস থেকে ১১-১৫ নাগাদ বেরিয়ে ট্রামে চেপে সোজা সঞ্চয়ের অফিসে অর্থাৎ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস ইন্সটিটিউশনে । সঞ্চয়ের পিতৃবিয়োগ ও ছুটির দরখাস্ত জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম ১১-৩৫। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে আমার নিজের অফিস পৌঁছাই ঠিক বারোটায়। অফিসের কাজকর্ম সেরে বিকাল পাঁচটায় বেরিয়ে পড়লাম। শিয়ালদা থেকে ৫-৪৫ এর ট্রেণে চেপে হাবড়ায় ৭-১৫। গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্লান্তিবোধ করছিলাম। কিন্তু আগামীকাল নভেম্বর ১৫১৯৭৪ ভাইফোঁটায় অফিস যাব না ঠিক করলাম। আর্গোসি থেকে বেরিয়ে সকাল ৯-২৪ এর ট্রেণে চেপে মধ্যমগ্রাম স্টেশনে নামলাম। তারপর ওখান থেকে বন্ধুর বাড়ীতে সুব্রত মুখার্জ্জীর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (যাদবপুর বিশ্ববি্দ্যালয়১৯৭৪ ব্যাচ)। ওখানে গল্পগুজব করে কয়েকটা প্যান্ডেলে কালীপ্রতিমা দর্শন করে বাসে চেপে সোজা চলে এলাম পাইকপাড়ায়। তখন রাত ৯-১৫। সামান্য খাওয়া-দাওয়াগল্পগুজব করে শুয়ে পড়লাম রাত দশটায়। ভাইফোঁটার আনন্দ ঠিক পেলাম না। যাই হোকআগামী কালের অর্থাৎ নভেম্বর ১৬১৯৭৪ শনিবারের কর্মপ্রস্তুতি নিয়ে আপন মনে ছক কাটছি। কখন ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই।

পাইকপাড়ায় বড় মামার বাড়ীতে খুব সকালে ৬-৪৫ এর সময় উঠে পড়লাম ঘুম থেকে। সকালে কিছু জলখাবার খেয়ে মামার নীচের তলার ফ্ল্যাটে কুমার চক্রবর্ত্তীর বাড়ীতে গেলাম। ওর দিদি মিস জয়শ্রী চক্রবর্ত্তী সম্প্রতি LLB পাশ করে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে প্র্যাক্টিশ করছেন। আমার বার্থ সার্টিফিকেট এফিডেভিট এর ব্যাপারে পরামর্শের জন্য ওঁর কাছে গি্যেছিলাম। আলোচনা বিশেষ ফলপ্রসূ মনে হল না। ঘন্টাখানেক গল্পগুজবের পর সোয়া নটা নাগাদ উপরে উঠে এলাম। তারপর চান-খাওয়া সেরে পাইকপাড়া থেকে ১১-০৫ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম আমার অফিসের দিকে। অফিস যাওয়ার পথে দুটো এ্যারোগ্র্যাম (মেজমামাকে স্পন্সরশিপ সার্টিফিকেট পাঠানোর ব্যাপারে লিখেছিদুটো এ্যারোগ্র্যাম পোস্ট করেছিলাম যদি কোনোটা missing হয়ে যায়এই ভেবে। তবে অপরটা নিশ্চয়ই পৌঁছাবে।)

জেনারেল পোস্ট অফিস G.P.O., Calcutta তে পোস্ট করলাম। আমার অফিস পৌঁছাতে ১২-১০ হল। অফিসের কাজকর্ম সেরে বিকাল ৩-১৫ নাগাদ পায়ে হেঁটে সোজা C.M.P.O (Calcutta Metropolitan Planning Organization , 1 Garshin Place, Calcutta-1) র অফিসে মিঃ অজিত ভুইয়্যাঁ এবং বড়মামা শিশির নিয়োগীর সংগে দেখা করলাম।

অজিত ভুইয়্যাঁর সংগে দেখা করবার উদ্দেশ্য -উনি সম্প্রতি একটা বার্থ -এফিডেভিট করিয়েছেন-সেটার একটা কপি আমার প্রয়োজন। কারণ ওটার স্যাম্পল থাকলে কোর্টে গিয়ে কোনো এ্যাডভোকেট কাউকে দিয়ে এফিডেভিট করিয়ে নিলেই হল। C.M.P.O. থেকে বেরুলাম বিকাল ৪-২০। তারপর ট্রামে চেপে শিয়ালদা চলে এলাম ঠিক পাঁচটায়। একটু পরেই অর্থাৎ ৫-১০ এর ট্রেণে চেপে হাবড়ায় পৌঁছালাম ৬-৪৫ নাগাদ। একটা কথা লিখতে ভুলে গিয়েছি। আজ অর্থাৎ নভেম্বর ১৬১৯৭৪ আমার অফিস থেকে “ইঙ্কাম ট্যাক্স সার্টিফিকেট” নিয়েছি। কারণ ভিসা পাবার পরেই ইঙ্কাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন হবে প্লেনের টিকিট কাটার আগে। একটা কাজ অন্ততঃ আজকের দিনটায় গুছিয়ে নিতে পেরেছি।

রবিবারের সকালে নভেম্বর ১৭১৯৭৪ আর্গোসিতে বিছানা ছেড়ে উঠলাম সাতটায়। চা-বিস্কুট খেতে খেতেই বার্থ-সার্টিফিকেটের একটা Draft তৈ্রী করে ফেললাম।। তারপর ওটা নিয়ে ছোটমামার সংগে হাবড়ার অঞ্চল প্রধান প্রভাত রায়ের বাড়ীতে গেলাম ৯-১৫। প্রভাত বাবুর আগের দেওয়া সার্টিফিকেটে মায়ের maiden name উল্লেখ করা ছিল না। তাই ওটা accept করবে না কনস্যুলেট অফিস। এ সম্পর্কে প্রভাত বাবুর কাছ থেকে নতুন সার্টিফিকেট চাইলে উনি অরাজী হন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর্গোসিতে ফিরে এলাম দুজনেই।

আর্গোসিতে ফিরে এসে আবার বেরুলাম আমাদের পাড়া-প্রতিবেশি এ্যাডভোকেট-শ্রীযুক্ত মনীন্দ্র মোহন সিংহের কাছে । উনি রাজী হলেন। সবশুদ্ধ সাড়ে আট টাকায় বার্থ-সার্টিফিকেট এফিডেভিট হয়ে যাবে। বাড়ী ফিরে এলাম।

দিনটা গতানুগতিক পদ্ধতিতে কেটে গেল। চিন্তিত মনে শুয়ে পড়লাম রাত ১০-১৫। আমার কর্মব্যস্ততা শুরু হল নভেম্বর ১৮,১৯৭৪। সকাল সাতটায় উঠে-স্নান খাওয়া সেরে ৮-৩৬ এর হাবড়া লোক্যালে চেপে চলে এলাম শিয়ালদায়। ওখান থেকে আয়কর ভবন(এসপ্ল্যানেডএর দোতলায় শান্তিময় চ্যাটার্জ্জীর সংগে দেখা করে আমার পাস্পোর্ট ইঙ্কাম ট্যাক্স সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র ওঁর হাতেই জমা দিলাম। গল্পগুজব করে শান্তিমামার সংগে ওঁদের অফিসের ক্যান্টিনে রসগোল্লা চা খেয়ে বেরুলাম ১১-১৫ নাগাদ। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে ১২-১৫ নাগাদ আমার অফিস। অফিসের কাজ সেরে বেরুলাম ৫-২০ নাগাদ। সামনেই ট্রাম পেলাম । ট্রামে এসে শিয়ালদা থেকে বিকাল ৬-০৬ এর ট্রেন পেলাম। হাবড়ায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৭-৩৫। আর্গোসিতে পৌঁছে সঞ্চয়ের দেখা পেলাম। গল্পগুজব করে সঞ্চয়কে বিদায় জানিয়ে রাত্রের খাওয়া -দাওয়া সেরে ঘুমের আয়োজন করলাম । শুতে গেলাম ১০-১৫ কিন্তু ঘুম এল অনেক দেরী করে। মনে হয় প্রায় রাত বারোটায়।

(চলবে)

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments