জ্বলদর্চি

পঞ্চকোট রাজবংশ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৬৪

পঞ্চকোট রাজবংশ

সূর্যকান্ত মাহাতো


দীর্ঘ ১৯০০ বছর ধরে একটা রাজবংশ টিকে ছিল এটা ভাবলেই কেমন যেন অবাক হয়ে যাচ্ছি। সত্যিই কি 'খ্রিস্টাব্দের' শুরু থেকেই এই রাজবংশ ছিল! অনেক প্রশ্ন নিয়ে পুরুলিয়ার এক বিজ্ঞ মানুষকে ধরেছিলাম। তারপর কেবলই অবাক হওয়ার পালা।

"বাংলা সাহিত্যে প্রথম 'পুরুলিয়া' শব্দের ব্যবহার কে করেছিলেন জানো?"

কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, "কে?"

"'মাইকেল মধুসূদন দত্ত'। বাংলা সনেটে 'পঞ্চকোট' সনেটের সংযোজন তার হাত ধরেই (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)।"

"'মধুসূদন দত্ত' হঠাৎ পুরুলিয়ার সঙ্গে এতটা আত্মিক হয়ে উঠেছিলেন কীভাবে?"

"আরে ১৮৭২ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কাশীপুর রাজবাড়ীর ম্যানেজার পদে বেশ কিছুদিন নিযুক্ত ছিলেন।(পঞ্চকোট রাজপরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/ দিলীপ কুমার গোস্বামী) এটাই ছিল মূল কারণ।"

"পুরুলিয়ার 'পঞ্চকোট' রাজবংশ শুনেছি জঙ্গলমহলের অন্যান্য রাজবংশের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমী। এই ব্যতিক্রমটা ঠিক কী?"

"ব্যতিক্রমটা হল, এর দীর্ঘ সময়কাল। সুদীর্ঘ ১৯০০ বছর ধরে শাসন করেছিল এই রাজবংশ। কিন্তু রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রজাদের বিদ্রোহ কখনো দেখা যায়নি। বরং অনেক সময় প্রজারাই দুঃসময়ে এই রাজ পরিবারকে সুরক্ষা দিয়েছেন।"

"এমনটা হওয়ার কারণ?"

"কারণটা ছিল রাজাদের ভূমিকা। প্রতিটি জাতিকে রাজারা তাদের স্পেস টুকু দিতেন। তাদের জীবন যাপন, ধর্ম পালন, উৎসব-অনুষ্ঠানে রাজারা কোনরকম বাধা তো দিতেন না, বরং একটা উৎসাহ জোগাতেন। রাজারা নিজেদেরকে সংকীর্ণতার উপরে তুলে ধরে প্রজা বৎসল হয়ে উঠেছিলেন।"



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



"বাহ! খুব ইন্টারেস্টিং রাজ পরিবার তো। এর ইতিহাসটা একটু শুনতে চাই।"

"পঞ্চকোট রাজ্য হল সবথেকে প্রাচীন রাজ্য। আনুমানিক ৮০(মতান্তরে ৮১) খ্রিস্টাব্দে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। (পঞ্চকোট রাজ পরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/ দিলীপকুমার গোস্বামী, পৃষ্ঠা ১০২) রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন 'দামোদর শেখর'। তার পিতা 'জগদ্দেও' সুদূর 'ধার' স্টেট থেকে এসেছিলেন এই ঝালদায়। সেখানেই 'দামোদর শেখর' এর জন্ম।"

"কিন্তু সময়কালটা যে '৮০' খ্রিস্টাব্দ এমনটা নিশ্চিত হওয়া গেল কীভাবে?"

"এই রাজবংশের বংশ তালিকায় তার উল্লেখ আছে। (পঞ্চকোটের ইতিহাস /পৃষ্ঠা ১৯, রাখাল চন্দ্র চক্রবর্তী)

"পুরুলিয়ায় 'পঞ্চকোট' রাজাদের আগমনের পূর্বে আরো একটি অবাক করা ইতিহাস আছে।"

"কী সেই ইতিহাস?"

"'অনার্য' অধ্যুষিত এই পুরুলিয়ায় প্রথম পা রেখেছিলেন যে 'আর্য' মানব তার নাম জানলে অবাক হবে।

"কে তিনি?"

"২৪ তম জৈন তীর্থঙ্কর 'মহাবীর'। ২৬০০ বছর আগে প্রথম আর্য মানুষ হিসাবে তিনি এখানে এসেছিলেন।(অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০২)

"তার মানে জঙ্গলমহলের সব রাজবংশই বহিরাগত!"

"শুধু জঙ্গলমহল কেন, সমস্ত বাংলাদেশের রাজারাই তো বহিরাগত। 'বল্লাল সেন' থেকে শুরু করে 'আলীবর্দী সকলেই।(পঞ্চকোট রাজপরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/ দিলীপ কুমার গোস্বামী) 'ভূম' অঞ্চলের সব শাসকেরাই এই বন জঙ্গলে ঘেরা দুর্গম এলাকায় এসে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।"

"যেমন---"

"যদি বীরভূম থেকে উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে একটি সরলরেখা টানা যায়, তাহলে যে 'ভূম' অঞ্চলগুলো গড়ে উঠবে, তাদের নামগুলো একবার দেখো---বীরভূম, শিখরভূম, ধলভূম, বরাভূম এবং ভঞ্জভূম। এদের শাসকেরা বহিরাগত হয়েও শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার রাজবংশের কথায় ফিরে আসি। 'দামোদর শেখর' রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর 'ঝালদা' ও 'পাট ঝালদা' এই দুটি পরগনায় এলাকাকে ভাগ করেন। পরে ছোটনাগপুরের রাজকন্যাকে বিয়ে করে 'দামোদর শেখর সিংহদেও' এই উপাধি গ্রহণ করেন। 'পাড়া' কে তিনি তার দ্বিতীয় রাজধানী রূপে গড়ে তুলেছিলেন। তার দুই পুত্র হলেন 'ইন্দ্রশেখর' এবং 'প্রতাপ শেখর'। ৮০ থেকে ১৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।"(অহল্যা ভূমি পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা ১০৩)

"'পাড়া' যদি দ্বিতীয় রাজধানী হয়, তাহলে প্রথম রাজধানী কোথায় ছিল?"

"তার জন্মস্থান 'ঝালদা'-য়। এরপর 'পাড়া' থেকে রাজধানীকে স্থানান্তরিত করা হয় 'পঞ্চকোট' পাহাড়ের পাদদেশে। তথা পঞ্চকোটে ৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। তখন রাজা ছিলেন 'কীর্তিনাথ শেখর'। তিনি 'পঞ্চকোট' দুর্গও নির্মাণ করেছিলেন। এখানে পরবর্তী ৩২ জন রাজা দীর্ঘ সময় ধরে রাজত্ব করেছিলেন। এত দীর্ঘ সময় ধরে শাসনকার্য পরিচালনা আর কোথাও কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না। তুমি একটা ঘটনার কথা জানলে অবাক হবে।"

"কোন ঘটনা?"

"সেন বংশের রাজা 'বল্লাল সেন' এর কন্যা 'সাধনা'-কে বিয়ে করেছিলেন এই পঞ্চকোটেরই রাজা 'কল্যাণ শেখর'। 'কল্যানেশ্বরী' মন্দিরটি তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। তবে মহারাজা 'বলভদ্র শেখর' (১৬৩৭- ১৭০৩ খ্রী.) এর রাজত্বকালেই পঞ্চকোটের রাজবংশের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়ে মোঘলদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়।"

"এই রাজবংশের আমলে শুনেছি বহু মন্দির গড়ে উঠেছিল। সেগুলো ধ্বংস হল কীভাবে? সবই কি কালের নিয়মে?"

"না, না। কালাপাহাড়  ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে এখানকার বহু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তখন পঞ্চকোটে রাজা ছিলেন 'গরুড় নারায়ন'। রাজা 'হরিশচন্দ্র শেখর' (১৫৯৮ -১৬২৫) যদিও পরবর্তীকালে এই মন্দিরগুলির অনেকাংশ সংস্কার সাধন করেছিলেন।"(পঞ্চকোট রাজপরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/ দিলীপ কুমার গোস্বামী)

"বিষ্ণুপুরের 'মল্ল' রাজাদের সঙ্গে পঞ্চকোটের রাজাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?"

"ভালো খারাপ দুটোই। বিষ্ণুপুরের ঊনপঞ্চাশ তম 'মল্ল' রাজা 'বীর হাম্বীর' তো কিছুদিনের জন্য পঞ্চকোট দখলও করেছিলেন বলে মনে করা হয়।"

"কেন মনে করা হয় কেন?"

"কারণ পঞ্চকোটের 'দুয়ারবাঁধ' ও 'খড়িবাড়ি'-র দুটি তোরণে 'বীর হাম্বীরের' নাম খোদাই করা একটি লিপি আছে। 'বীর হাম্বীরের' নাম দেখেই প্রত্নতত্ত্ববিদ জে. ডি. বেগলার সাহেব এই ধারণা করেছিলেন। কারণ ওই লিপির সময়কাল ছিল ষোড়শ শতাব্দী। এবং লিপিতে দেখা যায়, 'মল্ল' রাজ্য 'পঞ্চকোট' রাজ্যের দিকে যে অন্তর্ভুক্তি তার একটা ইঙ্গিত বহন করছে (সাহিত্য পরিষদ, বর্ষ ৮৭, পৃষ্ঠা ৩০, শ্রী তরুণ দেব ভট্টাচার্য)।"

"পঞ্চকোটের শেষ রাজা ছিলেন, 'মণিলাল শেখর' (১৭৫১- ১৭৯২)। তিনি তাঁর রাজধানী প্রথমে 'মহারাজ নগর' (চতুর্থ রাজধানী) ও পরে 'রামবনী'-তে স্থানান্তরিত করেন। শোনা যায় তার ৭ বছর বয়সে এক চরম হত্যালীলা ঘটেছিল।"

"হত্যালীলা কেন!"

"রাজ সিংহাসনের অধিকার নিয়ে খুল্লতাতদের সঙ্গে যে প্রবল রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাকেই 'হত্যালীলা' বলা হয়েছে। মণিলালের মৃত্যুর পর তার পুত্র 'ভরত শেখর' 'রামবনী' থেকে রাজধানী 'কেশরগড়ে'(ষষ্ঠ রাজধানী) স্থানান্তরিত করেছিলেন। এখানে তিনজন রাজা রাজত্ব করেন। 'ভরত শেখর'(১৭৯২-১৮৫৩), 'চেৎসিংহ' ১৮১৫- ১৮১৮) এবং 'জগজীবন' (১৮১৮- ১৮৫১)। সবশেষে রাজধানী 'কাশীপুরে'(সপ্তম রাজধানী) স্থানান্তরিত হয়। এখানে সাত জন রাজা রাজত্ব করেছিলেন। জগজীবন (১৮১৮- ১৮৫১), নীলমনি(১৮৫১-১৮৯৮), হরিনারায়ণ(১৮৯৮- ১৯০১), জ্যোতিপ্রসাদ(১৯০১- ১৯৩৮), কল্যাণীপ্রসাদ( ১৯৩৮- ১৯৪৭), শঙ্করীপ্রসাদ(১৯৪৭-১৯৫৪), এবং ভুবনেশ্বরীপ্রসাদ(জন্ম- ১৯৪৩ ২রা অক্টোবর, মৃত্যু ১৯৭২)"

"'কাশীপুরে' রাজধানী স্থানান্তরের পিছনে কি কোন কারণ ছিল?"

"অবশ্যই। আসলে কেশরগড়ের রাজা 'জগজীবন' জমিদারী ব্যাপারে ছিলেন চরম উদাসীন। সেইসব দেখভাল করতেন তাঁর ছোট ভাই রামজীবন। পরে পরে রাজ মহিষী সেই দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনি বুঝতে পারেন 'কেশরগড়' তাঁর ও তাঁর শিশুপুত্র নীলমণির পক্ষে নিরাপদ নয়। তাই রাজ মহিষীর নির্দেশেই রাজধানী কাশীপুরে সরে আসেন। রাজা জগজীবন 'কাশীপুর রাজভবন' তৈরি করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন কিন্তু তা সত্যি নয়। রাজভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন এই রাজ মহিষীই। কাশীপুরে এসে তিনিই রাজকার্য পরিচালনা করতেন নীলমণির বড়ো হয়ে ওঠা পর্যন্ত।(পুরুলিয়া/ তরুণদের ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা - ১৬৬)

"দাঁড়াও দাঁড়াও! এতগুলো রাজধানী পরপর আর একবার বলো। কেমন যেন গুলিয়ে ফেললাম।"

"'পঞ্চকোট' রাজবংশের প্রথম রাজধানী ছিল 'ঝালদা'। এরপর ক্রমান্বয়ে 'পাড়া', 'গড় পঞ্চকোট', 'মহারাজনগর', 'রামবনি', 'কেশরগড়', এবং সর্বশেষ 'কাশীপুর'।"

"এই দীর্ঘ ১৯০০ বছরের রাজত্বে কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা কিছু আছে?"

"এই সময় পঞ্চকোটে 'রাঘবানন্দ চক্রবর্তী' তার 'সিদ্ধান্ত রহস্য' এবং 'দীনচন্দ্রিকা' গ্রন্থ দুটি রচনা করেন।বহু ব্রাহ্মণদের উপাধি প্রদান করেছিলেন রাজারা। সর্বোপরি কল্যাণেশ্বরী, আসানসোল, হিরাপুর গড়পঞ্চকোট, রঘুনাথপুর, আদ্রা, পুরুলিয়ার মতো ২২টি জনপদ 'পঞ্চকোট' রাজবংশই তৈরি করেছিলেন।(আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) একটি 'গ্রাম' থেকে 'কাশীপুর' 'সাংস্কৃতিক রাজধানী'-তে রূপান্তরিত হল। বিশাল বড় রাজপ্রাসাদ তৈরি হল। এমনকি 'কাশীপুর'-কে "দ্বিতীয় নবদ্বীপ"ও বলা হত।(পঞ্চকোট রাজপরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস/ দিলীপ কুমার গোস্বামী)

তথ্যসূত্র: ১) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, ১ম পর্ব/ সম্পাদনা দেবপ্রসাদ জানা
২) পুরুলিয়া/ তরুণদেব ভট্টাচার্য

Post a Comment

0 Comments