জ্বলদর্চি

স্বপ্নেই আছি /মিলি ঘোষ

স্বপ্নেই আছি 

মিলি ঘোষ 

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি কি না, বোঝার আগে থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু। হয়তো সকলেরই। চিনির স্বাদ মিষ্টি আর উচ্ছের স্বাদ তেতো, না জানলে মানুষ কীভাবে বুঝবে কোনটা কেমন খেতে। না খেয়ে তো আর আস্বাদন নেওয়া যায় না।

যে দিন থেকে শিশু ভাবতে শিখেছে, সেদিন থেকেই সে স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। তার ভাবনার পরিসর যত বিস্তৃত হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে, ততই তার স্বপ্ন দেখার রকম পাল্টে পাল্টে গেছে। ছড়িয়েছে তার সীমানাও। পাশাপাশি, আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো তার স্বপ্নকে একটা নির্দিষ্ট পথে চালিত করার চেষ্টা করেছে।  

জীবনের প্রথম দিককার স্বপ্ন কারোরই মনে থাকার কথা নয়। কাচের মতো স্বচ্ছ তখন স্বপ্ন দেখার চোখ। জটিলতাহীন মন। তখন সে বোঝেই না, জীবন কত কঠিন, কত নিষ্ঠুর! তার জন্য কী কী অপেক্ষা করছে, সে'সব ভাবনার সে ঊর্ধে। দিন যাপনের সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে পরিষ্কার হতে থাকে স্বপ্ন আসলে কী। 

স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক কতটা, তা বুঝতেই মানুষ তার সীমিত জীবনের অনেকটা সময় পার করে ফেলে। 
তখন যদি বলা হয়, "জীবন, একটু ধীরে চলো। শুধু স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আমার অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল।" 
জীবন কি শুনবে ? শুনবে না। জীবন তোমার থেকে কড়ায় গন্ডায় উসুল করে নেবে, স্বপ্ন দেখার মাশুল। এই  চরম সত্যটা একবার বুঝে গেলে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে ক্রমশ কমতে থাকে। তবে তা সচেতন মনে। কিন্তু স্বপ্ন তো মানুষের অবচেতন মনের আশা নিরাশার প্রকাশ মাত্র। তাই ঠকে, ঠেকেও মানুষ আবার স্বপ্ন দেখে। 

তবে,কল্পনাপ্রবণ মানুষের স্বপ্ন দেখার প্রবণতা একটু বেশির দিকেই। বাস্তবতাকে খানিকটা হেয় জ্ঞান করেই চলতে থাকে তার স্বপ্নবিলাস। সে বুঝেও বোঝে না। দেখেও দেখে না। ঠেকেও শেখে না। স্বপ্নের জাল বোনা তার কাছে, এতটাই জরুরী। 

স্বপ্ন দেখার কিন্তু একটা স্বাদ আছে। নিজেকে কিছুক্ষণ অন্তত ভালো রাখা যায়। তা, নাই বা হলো পূরণ। দেখতে অসুবিধা কোথায় ? আমার চোখ, আমার মন, আমার চিন্তা-শক্তি। তাকে আমি লালন করব, আমার মতো করে। আমার কল্পনাবিলাসিতা অন্যের তো ক্ষতি করে না। স্বপ্ন দেখতে বাধা কীসের? 
তবে, স্বপ্নের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে দুঃস্বপ্নও সমানভাবে এসে হাজির হয়, একেবারে নিঃশব্দে। তবু মানুষের স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয় না। 

নিদ্রামগ্ন অবস্থায় যে সমস্ত ঘটনা এসে হাজির হয়, তার কয়েকটি বলি।
কতবার যে দেখেছি, পরীক্ষা হলে পৌঁছতে পারিনি। দুনিয়ার সব বাধা ওই সময়ে এসে জড়ো হয়েছে। যখন পৌঁছলাম, পরীক্ষা শেষ। অথবা সবচেয়ে পছন্দের বিষয়টিতে শূন্য পেয়ে বসে আছি। কিংবা হয়তো প্রচুর জল। ভেসে যাচ্ছে চারদিক। 
স্বপ্নে বারেবারেই ফিরে আসে মা, বাবা। সেই মা'কেই দেখি বারবার, যিনি দশভুজা। একার হাতে সংসারের সব কিছু সামলাচ্ছেন। শেষ জীবনের ক্লান্ত বিধ্বস্ত মা'কে খুব একটা দেখি না। বাবার ক্ষেত্রেও তাই। তবু ভালো। ঘুম ভাঙলে, বিষণ্ণতার মাত্রা একটু হলেও তো কম হয়।
কখনও স্বপ্নে আসে খণ্ড খণ্ড ঘটনা। জোড়াতালি দিয়েও বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। 
আর যা আসে স্বপ্নে, সেই চিরাচরিত ভয়, যাকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। যা অমোঘ। যা রাতের মতো ভয়ঙ্কর কিন্তু দিনের মতো সত্য। তা হলো মৃত্যু। 

ঘুমের ঘোরে বহু মানুষ ভয়ের স্বপ্ন দেখে। ঘুম ভেঙেও সে আতঙ্ক কাটে না। অনেক সময় প্রতি রাতেই দেখে।
এমনও শুনেছি, এক ভদ্রমহিলা রোজ রাতে দেখতেন, কেউ একজন তার চুলের মুঠি ধরে অনেক উঁচুতে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। পরপর বেশ কয়েক রাত দেখেছেন। আবার ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন যেমন এসেছিল, তেমন নিজের মতো চলেও গেছে। এ'সব ব্যাখ্যার অতীত। বা থাকলেও, আমার জানা নেই। তবে, ঘুমের মধ্যে পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন অনেকেই দেখেন। কিছু আতঙ্ক, কোনও না কোনও ভয় অনেক মানুষেরই থাকে। অবচেতন মনে তা'ই হয়তো এসে উপস্থিত হয়, একটু অন্য ভাবে। বা আরও ভয়ঙ্কর রূপে। 

ঘুম ভেঙে আফশোস হয়, এমন স্বপ্নের উদাহরণ আরও আছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে, ঠিক আমার পছন্দের খাবারগুলো কেউ আমার সামনে এনে সাজিয়ে দিয়েছে। খেতে যাব, ঘুমটা ভেঙে গেল। এরকম যাদের যাদের হয়, তাদের মধ্যে দু'একজন শুনেছি তারপরেও চোখ বন্ধ করে স্বপ্নটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু স্বপ্ন ততক্ষণে ছক্কা হাঁকিয়ে স্টেডিয়ামের বাইরে। 

একবার দেখেছিলাম, ট্রেনে করে আমেরিকা যাচ্ছি। ওটাই অন্তিম স্টেশন। 
    আমার এক নিকটজন, ট্রেনের দরজা খুলে দিয়ে  বলেছিল, "নেমে যা। সামনেই সিঁড়ি।"
তখন মধ্যরাত। এক নিকষ কালো অন্ধকার স্টেশন।  নামা মাত্রই ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেন ফিরে যেতে লাগল আমার নিজের দেশে।  
সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দিনের আলো। একে ওকে জিজ্ঞেস করে গন্তব্যে পৌঁছেছি। যে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল, তার ছেলের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম। দেখাও পেলাম। ও কাজে বেরচ্ছিল। আমাকে দেখে ফিরে এল। ওর বাড়িতে গিয়ে দেখি, আরও অনেক লোক। সবার মুখে মাস্ক। 
মধ্যে আরও অনেক কিছু ছিল, জট পাকানো। যেমন হয় স্বপ্নে।

এই স্বপ্নটার কথা দু'একজনকে বলেছি। শুনে হেসেছে। হাসির মধ্যে অবিশ্বাস ছিল। 
আর আমার স্নেহধন্য সেই আমেরিকাবাসী, সে কিন্তু  হাসেনি।
    বলেছে, "আমি বিশ্বাস করেছি। কারণ, যার স্বপ্ন দেখার চোখ থাকে, স্বপ্ন সে'ই দেখতে জানে।" 

কত কিছুই যে লুকিয়ে থাকে মনের মধ্যে, আমরা নিজেরাই জানি না। স্বপ্নই বুঝিয়ে দেয়, এ সবই আমাদের মনের ইচ্ছা। নিতান্ত গোপনে, নিজের অজান্তে যা আমরা লালন করে চলেছি। 

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে ধনীর দুলাল। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে পথশিশু। কিন্তু দু'জনের স্বপ্ন কি এক হতে পারে ? 
পথশিশু কখনও ঘুমের মধ্যে চার দেওয়ালের শান্তি, সাজানো সংসার, আরামের বিছানার স্বপ্ন দেখে না। নিজের তো মাথার ওপর খোলা আকাশ। কারোর বাড়িতে জানলা দিয়ে উঁকিঝুকি দিয়েও দেখার সাহস হয় বলে মনে হয় না। তাহলে তার স্বপ্নে সুখী গৃহকোণের চলমান চিত্র আসবে কীভাবে ? বড়জোর বন্ধ দু'চোখে সে আপাত সুখী মানুষগুলোর হাঁটাচলা, চালচলন দেখতে পারে। পিঠে ব্যাগ নিয়ে সমবয়সীদের স্কুলে যেতে দেখতে পারে। কিন্তু মানুষের প্রথম জীবনের যে এক বিরাট অংশ স্কুলেই কাটে, সেই জীবনের এক বিন্দুও রাস্তার ধারে পড়ে থাকা শিশুদের স্বপ্নে আসে কি?  
আবার চার দেওয়ালের নিশ্চিত আশ্রয় যাদের  জোটে, তাদের স্বপ্নে পথশিশুরা আসবে কীভাবে ? ফুটপাথের এক পাশে শতচ্ছিন্ন মলিন চাদর গায় দিয়ে ঘুমোনোর স্বাদ, তারা তো কখনও পায়নি। 
 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



তবু স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। 
প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে সারাদিন এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরির মাঝেও স্বপ্ন দেখা চলতেই থাকে।  
খাবারের দোকান বা জামাকাপড়ের বিশাল শোরুমের সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো কখনও দীর্ঘশ্বাস পড়েছে তাদের। ওই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই লুকিয়ে থেকেছে তাদের দিবাস্বপ্ন। যা, নিতান্ত গোপনেও কারোর কাছে তারা প্রকাশ করেনি। তাই হয়তো রাতের স্বপ্নে ঘুরে ফিরে দেখা দেয় দিবাস্বপ্নের প্রতিফলন।
 
স্বপ্ন যখন উত্তরমুখী, জীবন দক্ষিণে। তবু, নিজের অবস্থান থেকে প্রতিটি মানুষ স্বপ্ন দেখে। এতে না আছে পরিশ্রম, না লাগে অর্থ। যা আছে, তা শুধুই আশা। এটাই হয়তো আমাদের সুখের চাবিকাঠি।
 
স্বপ্ন কখনও সিম্বল দেখে আসে না। তিনি অমুক। তাই তিনি স্বপ্ন দেখার অধিকারী। আর ও তো একটা ইয়ে টাইপের। ও আবার স্বপ্ন দেখবে কী! এই একটি জায়গায় স্বপ্ন দেশ, কাল, জাতি, ধর্মের ঊর্ধে। পৃথিবীর ধনীতম মানুষটি যদি স্বপ্ন দেখতে পারেন। অনাহার ক্লিষ্ট শিশুটিও পারবে। এটা তার অধিকার। যদিও স্বপ্নের তফাৎ হবে আকাশ পাতাল। 

তাই আজও আমি স্বপ্ন দেখি। ভালোবেসেই দেখি।  বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে তা আমি ছুঁতে পারব না জেনেও দেখি। কিন্তু অন্যকে দেখাই না। কারণ, স্বপ্ন, স্বপ্নই।

Post a Comment

0 Comments