জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—লিবিয়া (আফ্রিকা)/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প—লিবিয়া (আফ্রিকা)
রাজার ঢাক
চিন্ময় দাশ


দেশের রাজা ভারি ভালোমানুষ। যুদ্ধ-টুদ্ধ তার একেবারেই পছন্দ নয়। খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, আনন্দ-ফূর্তিতে দিন কাটাতে ভালো লাগে তার।
আজব একটা ঢাক ছিল রাজার। ঢাকে কাঠি পড়লেই, অঢেল খাবার-দাবার জড়ো হয়ে যায়। চোখের পলক পড়তেও সময় নেয় না। 
কোন পড়শি রাজা যুদ্ধে আসছে জানলেই, যেখানে যত রাজা আছে, সবাইকে নেমন্তন্ন পাঠিয়ে দেয় রাজা। শত্রুমিত্র বাদবিচার না করেই। 
রাজা-উজিরের দল এসে হাজির হয়। আর, তখন তাদের চোখ ছানাবড়া। রাজবাড়ির মাঠে বিরাট ম্যারাপ বাঁধা। সারি সারি টেবিলে দুনিয়ার যত সেরা খাবার-দাবার সাজানো। খানা-পিনার এলাহি আয়োজন। সবাই পেট ভরে খায়। আর, ঢেকুর তুলতে তুলতে ঘরে ফিরে যায়।
যুদ্ধ? কারও মনেই থাকে না সে কথা। এমনই কেরামতি ঢাকের।
তবে, একটা ঝামেলা আছে লাঠিটাকে নিয়ে। নিয়ম হোল, কোন লাঠিকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারবে না ঢাকের মালিক। এমনকি, ধরো রাস্তায় গাছের একটা শুকনো ডাল পড়ে আছে। টপকানো যাবে না সেটাকেও। 
ভুল করেও যদি কেউ টপকায়, হাজার বার ঢাকে কাঠি দিলেও, খাবার দাবার আসা বন্ধ। উলটে, গুণে গুণে একশটা ষণ্ডামার্কা লোক এসে হাজির হয়ে যাবে। যেন মাটি ফুঁটে উঠে এল। সামনে যে-ই থাকবে, বেদম পেটাতে শুরু করবে সবাইকে। 
অগাধ টাকাকড়ি রাজার। চাকর-বাকরে ঘর ভর্তি। দশ-দশটা জাহাজ তার। পাল খাঁটিয়ে সেগুলো বাণিজ্যে যায় দূর দূর দেশে।   
আর আছে বউ। গুণে গুণে পঞ্চাশটা বউ রাজার। আর ঘর ভর্তি ছেলেপুলে। প্রাসাদটা সব সময় জমজমাট। 
এমন একটা ঢাক আছে তার ঘরে। তাই মাসে মাসে ভোজের আসর বসায় রাজা। রাজ্যের যত প্রজা সবাই এসে জড়ো হয়। পেট ভরে চর্বচোষ্য খেয়ে যায় তারা।
এমনকি, বনের যত জীব, নিয়ম করে তারাও নেমন্তন্ন পায় রাজার। হাতি আর জলহস্তি, চিতাবাঘ আর হরিণ, ঈগল আর বন মোরগ সবাই আসে ভীড় করে।
প্রজারা হোক বা বনের জীব, সবাই জানে রাজার ঢাকটার কথা। খেয়ে দেয়ে ঘরে ফেরার সময়, সকলেরই সাধ হয় মনে—আহা, আমি যদি ঢাকটা পেতাম!
একদিন রাজার এক বউ গিয়েছে ঝর্ণায়। মেয়েকে স্নান করাতে। মায়ে-ঝিয়ে স্নান করছে, টুক করে একটা খেজুর খসে পড়ল গাছ থেকে। 
খেজুর কার না ভালো লাগে? বাচ্চা মেয়ের তো লাগবেই। সে কুড়িয়ে নিয়েই মুখে পুরে দিল টসটসে ফলটা। ঝামেলা যা হওয়ার, হয়ে গেল তাতেই। 
হয়েছে কী, ঝর্ণাটার পাশেই একটা খেজুর গাছ। একটা কচ্ছপ গাছে চড়ে, খেজুর পাড়ছিল, রাতের খাবারের জন্য। তারই একটা পড়ে গেছে হাত ফসকে।
রাজার মেয়ে খেজুর খেয়ে ফেলছে দেখে, ভারি আনন্দ হোল কচ্ছপের। এমন মওকা সহজে পাওয়া যায় না কি? 
তরতর করে গাছ থেকে নেমে এল কচ্ছপ। রাজার বউকে বলল—আমার খেজুর দাও।
রাজার বউ বলল—খেজুরটা তো মেয়ে খেয়ে ফেলেছে।
কচ্ছপ তেড়িয়া হয়ে বলল—খেয়ে ফেলেছে, বললেই হোল? আমি যাচ্ছি রাজার দরবারে। বলব, রাজার বউ চুরি করেছে। দেখি, কী বিচার পাই। 
রাজার বউ তো অবাক—চুরি করবো কেন? ঝরা ফল, কুড়িয়ে খেয়েছে মেয়ে। তা, ঠিক আছে, চলো, আমিই তোমাকে দরবারে নিয়ে যাচ্ছি।
রাজা দরবারেই ছিল। রানির কাছে সব শুনে, কচ্ছপকে বলল— খেজুরটা তো আর দেওয়া যাবে না। তার বদলে টাকা-কড়ি, কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবার কী চাই, বলো। 
মওকা পাওয়া গেছে। কচ্ছপ বলল— তাহলে, ঐ ঢাকটা চাই। অন্য কিচ্ছু না।
হাসি মুখেই ঢাকটা দিয়ে দিল রাজা। কিন্তু ভুল করেও কখনও একটা কাঠি ডিঙ্গিয়ে ফেললে, কী দশা হবে, সে কথা কিছু বলল না কচ্ছপকে।
ঘরে ফিরে, সে কী দেমাক কচ্ছপের! বউ বাচ্চাদের ডেকে ডেকে বলতে লাগল—আমার মত বড়লোক কেউ নাই এদেশে। ঢাক বাজাব, আর খাবার আসবে।
দিন কয়েক ভূরিভোজন চলল কচ্ছপের বাড়িতে। 
কিন্তু সবাইকে না দেখালে, বড়লোকি কিসের? পাড়া-পড়শিদের নেমন্তন্ন করে এলো কচ্ছপ—ভোজ খাবে আমার বাড়িতে। চলো সবাই। 
কচ্ছপ ঢাক বাজাল আর ভুরিভোজ খাওয়াল। সবাই অবাক, সবাই খুশি। তিন দিন ধরে চলল ভোজসভা। ধন্য ধন্য করল সকলে।
কেবল পাড়াপড়শি জানলে তো চলবে না। আরও নাম হওয়া দরকার। জানানো দরকার দেশের সকলকে। এবার বড় ভোজসভা বসাবার সাধ হোল কচ্ছপের। একেবারে রাজার মতোটি করে। 
রাজ্যের যত লোকজন, বনের পশুপাখি, এমনকি রাজাকেও নেমন্তন্ন করে দিল কচ্ছপ। 
দেশের লোকেরা তো হেসে বাঁচে না। হতভাগার নিজের জোটে না। সে খাওয়াবে নেমন্তন্ন! কচ্ছপ কি রাজা হয়ে গেল না কি? তবু, কয়েকজন গেল কচ্ছপের বাড়ি, মজা দেখবে বলে।
আসলে কিন্তু বেশ জমজমাট আসরই বসল খাওয়া-দাওয়ার। আকন্ঠ খেল সবাই। যারা আসেনি, খুব আফশোষ করতে লাগল তারা। 
এবার থেকে হালচাল বদলে গেল কচ্ছপের। দেমাকে পা পড়ে না মাটিতে। কাজকর্ম করা ছেড়েই দিল একেবারে। খানা-পিনা ছাড়া আর কিছুই নাই তার জীবনে।
একদিন হোল কী, যতক্ষণ মন চায়, পেট ভরে তালের রস খেল কচ্ছপ। খানিক বাদে মাথা ঝিমঝিম। শরীর টলমলো। ভাবল, একটু নদীর দিকে যাই। হাওয়া খেয়ে আসি।
খানিক দূর যেতে না যেতে, পা টলতে লাগল। গাছের একটা সরু ডাল পড়ে ছিল রাস্তায়। চলতে চলতে সেটা ডিঙ্গিয়ে ফেলল বেচারা। তাতেই ফ্যাসাদ যা হবার, হয়ে গেল সবার অজান্তে।  
ঘরে ফিরল যখন, সূয্যি ডুবে গেছে। শরীর অবশ। ঘরের এক কোণে গড়িয়ে পড়ল কচ্ছপ। সাথে সাথে ঘুমিয়ে একেবারে কাদা। 
পরদিন কত বেলায় ঘুম ভাঙল বউ-বাচ্চাদের ডাকে। খিদে লেগেছে তাদের। খিদে লেগেছে কচ্ছপের নিজেরও। 
ঢাকটা টেনে নিয়ে, কষে ঘা কয়েক বসিয়ে দিল। কিন্তু সেদিন অন্য ঘটনা। কোথায় খাবার দাবার? কোথায় কী? এক দল ষণ্ডামতন লোক হাজির হয়ে গেল কোথা থেকে। যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল লোকগুলো। সবার হাতে লাঠি। দমাদম পিটাতে লাগল ঘরের সবাইকে।
আর, সে কী মার! প্রাণ বেরিয়ে যায় যেন। কাঠিটা  ধরাই ছিল কচ্ছপের। মারের চোটে শরীর অবশ। কাঠিটা পড়ে গেল হাত ছাড়িয়ে। 
আর, পড়বি তো পড় ঢাকটার উপরেই। যেই না আবার ঢাকে কাঠি পড়ল, থেমে গেল সব কিছু। লোকগুলোও উবে গেল একেবারে। 
একটু সুস্থ হয়ে একটা ফন্দি এল কচ্ছপের মাথায়। ভোজ তো আমি আর আমার বউ-ছেলে-মেয়ে একা খাইনি। সবাই ভোজ খেয়েছে। তাহলে, মারধোরটা আমরা একা খাবো কেন? সবাইকেই ভাগ দেওয়া দরকার।
আবার একটা ভোজের আয়োজন করা হোল। এবারের আয়োজনটা বেশ বড় মাপেরই। রাজামশাই যেমন সভা বসায়, তার চেয়েও বড়। 
কাতারে কাতারে লোক এসে জড়ো হোল। লোকজন যেন ঝেঁটিয়ে এলো। গতবারের ভোজের কথাটা কানে গিয়েছিল সবারই। এবার আর কেউ বাদ যেতে রাজি নয়।
বনের পশুপাখিদেরও ডাকা হয়েছে। বাঘ-সিংহ থেকে কাঠবেড়ালি আর ইঁদুর, বড় বড় ঈগল-বাজ থেকে টুনটুনি-মৌটুসি—কেউ বাদ গেল না।
কচ্ছপের বাড়ি সেদিন ফাঁকা। রাত ফুরোবার আগেই, বউ আর বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে রেখে এসেছে। পাড়াপড়শিও টের পায়নি কেউ।
সবাই জড়ো হয়েছে। সমগম করছে জমায়েত। ঢাকে বেশ করে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল কচ্ছপ। দিয়েই সুড়ুত করে লুকিয়ে গেল কপাটের আড়ালে।
তখুনি একেবারে গতবারের মত ঘটনা। ধুমসো ধুমসো শতখানেক লোক হাজির। হাতে মোটা মোটা লাঠি সবার। বেধড়ক মারতে লাগলো সবাইকে। 
সেই জমায়েতে চিতাবাঘটা ছিল এক্টুখানি বাইরের দিকে। এমন বেমক্কা একটা লাফ দিল চিতাটা, যেন তীর ছিটকে বেরোল শিকারির ধনুক থেকে। লম্বা এক লাফে কতো দূরে গিয়ে পড়ল চিতাটা। সরে পড়তে পারল সে একাই।  
আড়াল থেকে উঁকি মেরে সবই দেখছে কচ্ছপটা। কতক্ষণ মারের চোটে কাতরাতে কাতরাতে সবারই তখন মড়ার মত অবস্থা। আড়ালে থেকে ঢাকে জোর একটা ঘা লাগাল কচ্ছপ। সাথে সাথে সব থেমে গেল। লোকগুলোও কোথায় উধাও! 
এদিক ওদিক পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে সবাই। ঢাকটাকে পিঠে তুলে নিয়ে, কচ্ছপ চলল রাজার বাড়ি। অনেক শিক্ষা হয়েছে। আর নয়। যার জিনিস, তার কাছে থাকাই ভালো। 
সেদিনও রাজা দরবারে বসেছে। কচ্ছপ ঢাক নামিয়ে বলল—এই রইল আপনার ঢাক। বদলে যা দেবার কথা বলেছিলেন, সেসব দিন আমাকে। 
রাজা বুঝে গেল, ভালো মতনই শিক্ষা হয়েছে নিশ্চয় ব্যাটার। তাই ছুটে এসেছে। হাসি ফুটল রাজার মুখে, বলল—তা কি হয়, বাপু? আমার মেয়ে খেজুর খেয়ে ফেলেছিল তোমার। ক্ষতিপূরণ হিসাবে ঢাক নিয়েছ তুমি। এখন কী করে ফেরত নেব? দেওয়া জিনিষ রাজা কখনও ফেরত নেয় না।
কচ্ছপ তো ভয়ে অস্থির—না, না। এ ঢাক আমি রাখব না।
পিঠের ঢাক নামিয়ে দিল সে। গুটি গুটি পায়ে সরে পড়তে লাগল সভা থেকে।
রাজা ডেকে বলল—একটা কথা শুনে যাও। আমার রাজ্যে গাছে খেজুর ফলে সারা বছর। সেটি আর হবে না এখন থেকে। এখন থেকে বারো মাসে একবারই ফলবে খেজুর। খেজুর খাবার মজা দূর করে দিলাম তোমার। 
কী আর করবে কচ্ছপ বেচারা। চুপচাপ বেরিয়ে গেল দরবার থেকে। ঢাকটা ঝেড়ে ফেলা গেছে, এই বাঁচোয়া। 
সেদিন থেকে দুটো জিনিষ হয়েছে নতুন করে। কচ্ছপ আর রাজবাড়ির রাস্তা মাড়ায় না কোন দিন। দ্বিতীয় হয়েছে খেজুরের ব্যাপারটা। সেই কতো হাজার হাজার বছরের ঘটনা এটা। তখনকার দিনে, সারা বছরই গাছে খেজুর ফলতো। একেবারে ডাব-নারকেলের মতই। কিন্তু সেদিন থেকে গাছে খেজুর ফলছে বছরে এক বারই।
অবশ্য, তাতে কচ্ছপের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। না খেয়ে থাকতে হয় না তাদের। হয়েছে কী, শাস্তিটা দিয়েছিল রাজা। কিন্তু বিধাতা পুরুষ তো অতো নির্দয় নয়। বিধাতাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে কচ্ছপের জন্য। বছরে এক বারই ফললে কী হবে, সারা বছর জমিয়ে রাখা যায় খেজুরকে, নষ্ট হয় না।
আমরাও সবাই ভালোমতন জানি, অন্য সব ফল নষ্ট হয়ে যায় দুদিন না যেতেই। এক মাত্র খেজুরই নষ্ট হয় না। জমিয়ে রেখে খাওয়া যায় খেজুরকে। 
গল্পটা যদি কারও বিশ্বাস না হয়, খেজুরের ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারো, সত্যি কি না। কিংবা ভেবে দেখতে পারো চিতার লম্বা লাফের ব্যাপারটাও। আরও একটা কাজ করতে পারো সবাই। বাঘ কিংবা জেব্রার চেহারার দিকে তাকিয় দেখতে পারো তোমরা। লাঠির বাড়ি বেশি খেয়েছিল তারা। সেই থেকে চিরদিনের মতো পিঠের দাগ রয়ে গেছে বেচারাদের।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments