জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো /পর্ব -১৫ /সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো 
পর্ব -১৫
সুকন্যা  সাহা 

দোল যাত্রা 

দোল পূর্ণিমার   নিশি  নির্মল আকাশ
মৃদুমন্দ  বহিতেছে   মলয় বাতাস ...
আজ  আমাদের  ন্যাড়া পোড়া
কাল আমাদের দোল 
পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে   
বল হরিবোল..
বাঙ্গালীদের  দোল; অবাঙ্গালীদের হোলি ... রঙের উৎসব ... বসন্তের   আগমনে   রঙ্গীন  হওয়ার উৎসব ...এর  একটা  সর্বভারতীয়  চরিত্র আছে । কিন্তু  এখানে  সেকথা  বলব না । আজ বলব আমাদের ছোটোবেলায় দেখা দোল  উৎসবের   কথা । বৈষ্ণব  পরিবারে  বড় হওয়ার সুবাদে কৃষ্ণলীলা  সংশ্লিষ্ট  উৎসবগুলি  খুব কাছ  থেকে   দেখার সুযোগ   হয়েছে । যেমন  জন্মাষ্টমী, যেমন রাধাষ্টমী বা  এই দোল যাত্রা । আমার দাদু  ঠাকুমা   নবদ্বীপের গোঁসাইয়ের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন । তাই ক্যালেন্ডারের হিসাবমত যেদিন যে উৎসবের   তিথি  থাকত তার পরদিন পালিত হত সেই উৎসব। ঠাকুমা  বলতেন গোস্বামী মতে পরাহে । ছোটোবেলা  থেকে দেখে   আসছি দোলের দিন ঠাকুর ঘরের বাইরে খোলা ছাদে ইঁট দিয়ে  দোল মঞ্চ তৈরী  হত। সেই দোল মঞ্চ লাল নীল কাগজ  দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব ছিল আমাদের ছোটদের । দোলমঞ্চে পাতা হত রঙ্গীন কাপড়। আর তার ওপর   থাকত দোলনা ।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



 ঝুলনায় রাধাকৃষ্ণকে  বসানো হত ।খুব ভোরবেলা স্নান  সেরে আমি আর আমার  বোন রাধা কৃষ্ণের অষ্ট ধাতুর  মূর্তি স্নান  করাতাম  গঙ্গাজলে ... ফুলের পাপড়ি , অগঢ়ূ, মধু , চন্দন ও নানা  সুগন্ধী  দিয়ে তৈরী  করা   হত সেই  জল । স্নান  করিয়ে   বিগ্রহকে   পরানো হত   নতুন  কাপড় । তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে  দোলমঞ্চে  তোলা হত বিগ্রহকে । ফুল তুলসী ও আবীর বা ফাগ   দিয়ে অর্চনা   করা হত । ঠাকুমা   তখন ঠাকুরঘরে  ভোগ রান্নায় ব্যস্ত । দোলের   দিন খিচুড়ি, লাবড়া ,পাঁচ রকম ভাজা , চাটনি , পরমান্ন  ইত্যাদি  নিবেদন   করা হত  ঠাকুরকে ।  দোল পূর্নিমার  পবিত্র  দিনে আবির্ভাব  হয়েছিল  শ্রী চৈতন্যের । যে নদের নিমাই আজ থেকে পাঁচশ  বছর আগে  বাংলা   তথা  ভারতবর্ষকে হরি নাম সংকীর্তনে মাতোয়ারা করে তুলেছিলেন । ভোগ নিবেদনের আগে খোল  করতাল  সহযোগে  দাদু ও ঠাকুমা ভোগারতি  করতেন । আমার  দাদু মাটির মানুষ ছিলেন ... জীবন যাত্রায় অতীব  সাধারণ  এই মানুষটিকে আমার প্রকৃত  বৈষ্ণব  মনে  হত । আরতির  কীর্তন করার   সময়  গান   ধরতেন, " ভজপতিত উদ্ধারণ  শ্রী গৌরহরি ..." এই গানের  রুখা শুখা  এক মুষ্টি  করহ  ভোজন  কলি উচ্চারণের   সঙ্গে সঙ্গে দাদুর   দুচোখ দিয়ে   অশ্রু   ঝরে  পড়তে দেখেছি ।  প্রতিদিন  কৃষ্ণের অষ্টোত্তর   শতনাম জপ  করে     তবে  বিছানা  ছাড়তেন... নিয়ম সেবার  মাসে ভোরবেলায় আমাদের ঘুম ভাঙত  দাদুর কীর্তনের  আওয়াজে ... আদ্যন্ত  বিনয়ী এই মানুষটি ব্যবহারিক  জীবনে   ছিলেন   খুব সৎ  এবং অল্পে সন্তুষ্ট । ঠাকুরকে আবীর দেওয়ার  পর আমরা বড়দের পায়ে আবীর   দিতাম... তারপর   শুরু  হত আমাদের দোল খেলা ... ঘণ্টা  দু তিনেক রঙ খেলার  পর স্নান সেরে ভোগের খিচুড়ি খেতে বসতাম  সবাই  মিলে ... সেদিন  সব আত্মীয়  স্বজনদের  নিমন্ত্রণ  থাকত আমাদের বাড়ি। যৌথ  পরিবার ছিল  বলেই  বোধহয় কোনো  জিনিস একা  খাওয়া শিখি  নি । সবাইকে খাওয়াতে ও ভাগ করে   খেতে   এখনও আমার  তাই বড়  ভালো লাগে । উৎসব অনুষ্ঠানে  একসঙ্গে  খাওয়া দাওয়া লেগেই  থাকত  আর  থাকত আত্মীয়  স্বজনদের   ভীড় । কখনও তার জন্য আমাদের পড়াশোনার ক্ষতি  হচ্ছে  একথা মনে  হয় নি । এভাবেই  অভ্যস্ত   ছিলাম । দোলের   আগের  দিন বাঙ্গালীদের  ন্যাড়া পোড়া বা বুড়ির ঘর পোড়ানো  থাকত আর  অবাঙ্গালীদের হোলির  আগের  দিন  থাকত হোলিকা দহন...হোলিকা অসুরীর দহন,যা প্রতীকী মাত্র , যার মধ্যে দিয়ে সূচিত হত অশুভ  শক্তির উপর শুভ শক্তির জয়...  সে আবার   অন্য  গল্প ...                                              (ক্রমশ:)

Post a Comment

0 Comments