জ্বলদর্চি

আমার জীবনের ঘটনা : দুই /মলয় রায়চৌধুরী


আমার জীবনের ঘটনা : দুই

মলয় রায়চৌধুরী


আবিল অনাবিল

ওহে, ঘণ্টাখানেক থেকে শুনছি, মনে হচ্ছে বেশি মদ খেয়ে ফেলেছ, যতোটা খেয়ে সামলাতে পারবে, ততোটা খেলেই তো হয় । দরোজায় টোকা দিয়ে বললুম । এককালে সিনিয়ার অফিসার ছিলুম বলে সবাইকে তুমি-তুমি করেই চালিয়ে দিই । 

লোকটা ওয়াক তুলে চলেছে, রাত বারোটা বাজে । আমি আর আমার বুড়ি বউ দুজনেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলুম রাত নয়টায় । কিন্তু সামনের ঘরের বাসিন্দার ওয়াক তোলার শব্দে ঘুমের দফা রফা । তাই বাধ্য হয়ে বলতে হলো ।


সাড়া পেলুম না । ওয়াক তোলা বজায় রইলো । কেয়ারটেকারকে ইনটারকমে এই মাঝরাতে ফোন করে বললুম, ওই লোকটিকে পাতিলেবুর জল এনে দাও, আমাদের তো কালকে সকালেই ফিরতে হবে। একটু তো ঘুমিয়ে নিই ।

নাকতলার ফ্ল্যাট বেচে দেবার পর কলকাতায় গেলে আমাদের অফিসের রানিকুঠি গেস্ট হাউসে উঠতুম। দাদার বাড়ি ছিল বাঁশদ্রোণীতে, কিন্তু ফ্ল্যাট বিক্রির সময়ে দাদাকে যখন বললুম ‘তোমার ওপরতলাটা আমাকে ভাড়া দাও, বউদি সরাসরি বলে দিলেন, ‘কোথাও একতলা ভাড়া করে থাকগে যাও’ । দাদা মুখ বুজে রইলো । কেন ? সেই গল্পটা আরেকদিন বলব ।

 কলকাতায় ছেলের ফ্ল্যাট ছিল দমদম বিমান বন্দরের কাছে অনুপমা আবাসনে । সেই ফ্ল্যাট থেকে মেন রাস্তা পর্যন্ত যাবার জন্য বেশ খানিকটা হাঁটতে হতো । পায়ের সমস্যার কারণে হাঁটতে পারতুম না। আমার বুড়ি বউয়ের অবস্হা তো আর্‌ও খারাপ । কলকাতায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা, রেশনকার্ড ট্রান্সফার ইত্যাদির জন্য গিয়েছিলুম । 

আমি এসেছি শুনে সকালবেলায় এক অধস্তন অফিসার, স্নেহময় বসু, দেখা করতে এসেছিল । আমার সঙ্গে ট্যুরে যেতো আর তথ্যগুলো সংগ্রহ করতো । আমি আর আমার স্ত্রী স্হানীয় জায়গাগুলো দেখে বেড়াতুম । লোকের বাড়ির ভেতরের হালচাল বোঝার জন্য আমার স্ত্রী চাষিতাঁতিদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে পারতো।

স্নেহময়কে বললুম সামনের ঘরের বাসিন্দার কথা, মদ খায় আর সামলাতে পারে না ।

স্নেহময় বলল, আরে স্যার ও তো অনাবিল, আপনার আন্ডারে অনেকদিন কাজ করেছিল কলকাতা অফিসে। অনাবিলকে ডেকে আনলো স্নেহময় । চশমাপরা ভূঁড়িদাস ভদ্রলোক । অনাবিল দাশগুপ্ত ছিল ছিপছিপে অ্যাথলেটিক চেহারার স্মার্ট অফিসার ।

জিগ্যেস করলুম, এ কী করেছ অনাবিল, এরকম বিটকেল চেহারা করেছ ! অতো মদ খেলে এরকম চেহারা তো হবেই । তোমার সেই মামলার কী ফয়সালা হলো শেষ পর্যন্ত ? আবার বিয়ে করেছ ?

অনাবিল বলল, স্যার, একজনকে তো বিশ্বাস করেছিলাম, তার কুকীর্তি তো আপনি জানেন ; আবার যাকে বিয়ে করব, সেও অমন হবে না বলে মনে হয় না । মন সায় দেয়নি।


অনাবিল দেড় বছরের জন্য মণিপুর অফিসে ট্রান্সফার হয়েছিল । ওর স্ত্রী আর ছেলে কলকাতাতেই থাকতো। মনিপুর থেকে আবার কলকাতায় বদলি হয়ে জানতে পারলো ওর আরেকটা ছেলে হয়েছে । ওর স্ত্রী আর শাশুড়ির দাবি যে, দ্বিতীয় ছেলেটাও ওরই । ও ডিএনএ টেস্ট ইত্যাদির দাবি করায় ওর স্ত্রী থানায় গিয়ে নালিশ ঠুকলো আর পুলিশ ওকে ধরে লকাপে পুরে দিল । পরের দিন আদালতে তোলার পর জামিন পেয়ে একটা কাগজে ঘটনাটা বিস্তারিত লিখে আমার কাছে জমা দিতে এলো ।

আমি গ্রেপ্তার হয়ে চাকরি থেকে পঁয়ত্রিশ মাস সাসপেণ্ডেড ছিলুম । এই যুবকের গ্রেপ্তারির কথা অফিসকে জানালে বিপদে পড়ে যাবে । কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বললুম, চেপে যাও । 

ওদের মামলা চলল, ডিভোর্স হয়ে গেল । তারপর আমি মুম্বাই চলে এলুম ।

জিগ্যেস করলুম, যোগাযোগ আছে ?

অনাবিল বলল, যোগাযোগ আর কী ! আদালতের নির্দেশে খোরপোষ দিই আর ছেলেদের মাসে একবার দেখতে যাই । আমি যাতে ওদের সঙ্গে কথা না বলি, তার প্রয়াস করে ওদের মা, উপস্হিত থাকে। এই ভাবেই জীবন চলছে ।

স্নেহময় বলল, আসলে ওর স্ত্রীকে ও এখনও ভালোবাসে, যদিও জানতে পেরেছে দ্বিতীয় ছেলেটার বাবার নাম-ধাম। কীই বা করবে, বলুন !

আমি বললুম, তুমি শালা ইডিয়ট । অনাবিল থেকে আবিল হয়ে আবার বিয়ে করতে পারতে; যা মাইনে পাও ভালো পাত্রী পেয়ে যেতে । 

অনাবিল মাথা নামিয়ে স্নেহময়ের সঙ্গে চলে গেল ।



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇






Post a Comment

1 Comments