জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-১/ মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 

মলয় সরকার

পর্ব-১ (প্রথম পর্ব)


কোথাও বেড়াতে বের হওয়ার আগে আমার সব সময়ই মনে পড়ে কবিগুরুর গানের ক’টি কলি

,"----আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া–
টুটবে আগল বারে বারে তোমার দ্বারে
লাগবে আমায় ফিরে ফিরে  ফিরে আসার হাওয়া,
ভাসাও আমায় ভাঁটার টানে   অকূল পানে
আবার  জোয়ার জলে তীরের তলে ফিরে তরী বাওয়া– 
পথিক আমি, পথেই বাসা-
আমার যেমন যাওয়া  তেমনি আসা–"। 

কবি কথাটি যে অর্থেই ব্যবহার করুন, আমার এই লাইন ক’টিকে নিজের অর্থে প্রয়োগ করতেই ভাল লাগে।

নিজের মনেই বলি, কেবল দেশ দেখতে, ছুটি কাটাতে আর ঘুরে আনন্দ করতেই কি যাই! চিরপথিক আমি, পথেই আমার মনের বাসা।তাই বারে বারেই যাই সারা পৃথিবীর মানুষ চিনতে, মানুষ দেখতে, ইতিহাসের সন্ধানে, সৃষ্টিকর্তার আশ্চর্য সৃষ্টির শিল্পনৈপুণ্য দেখতে। এক কথায় অচেনাকে চিনতে আর অজানাকে জানতে।তবু সে কি শেষ হয়? তাই এক পথ শেষ না হতেই পথের টানে বেরিয়ে পড়ি আর এক পথে।
ভূপেন হাজারিকার মত বলতে ইচ্ছা হয়, " বহু যাযাবর লক্ষ্যবিহীন আমার রয়েছে পণ, রঙের খনি যেখানে দেখেছি, রাঙিয়ে নিয়েছি মন-"। আর, এ এক আশ্চর্য নেশা।পথ যেন কুহকিনীর মত আকর্ষণ করতে থাকে। ঘরবাড়ি চেনা পরিবেশ সব যেন তখন তুচ্ছ হয়ে যায় সে নেশার কাছে।তবু মনে হয়, কি যেন দেখা হল না, কি যেন চেনা হল না, বোঝা হল না।তখন মনে পড়ে, বুঝতে পারি, মহাভারতের মহাপ্রস্থানের পথে একক যাত্রী যুধিষ্ঠির কেন স্বজনদের মৃত্যুতেও বিচলিত না হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন নতুনের পথে।

এবারে আমার যাওয়া এক অন্য বিচিত্র সন্ধানে।

আমেরিকার সভ্যতার জয়যাত্রার ঢক্কানিনাদ অনেক শুনেছি, দেখেছি তার বাহ্যাড়ম্বর। ভেবেছিলাম,  দেখে আসব, এই সমস্ত সভ্যতার বিজয়রথ যাদের বুকের উপর দিয়ে চলেছে তাদের। সেই সমস্ত আদিম উপজাতিদের অস্তিত্বের সন্ধান করে আসব।দেখে আসব, আজ তারা কেমন আছে, কেমন ছিল ইতঃপূর্বে।

তাই এবারের লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম, আমেরিকার প্রায় নবতম প্রদেশ,(অর্থাৎ এর পর যুক্ত হয়েছে মাত্র আরিজোনা, আলাস্কা ও হাওয়াই ) উত্তর আমেরিকার একেবারে নীচের দিকের প্রদেশ নিউ মেক্সিকোকে।

যদিও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গাতেই এরা আজও কিছু কিছু রয়ে গেছে, তবু নিউ মেক্সিকোতেই, বলা হয়, সব থেকে বেশি মানুষ রয়েছে, সেই আদিম ধারা বহন করে।তাই এই জায়গাকেই বাছতে হল।

যে কোন জায়গায় যাওয়ার আগে আমাকে কিছু পড়াশোনা করে নিতেই হয়। কোন দেশ দেখতে গেলে আমার উদ্দেশ্য যেখানে, সেখানটার সম্বন্ধেই বেশি করে জানতে হয়। এছাড়া, সমস্ত দেশ ঘোরা তো আর সম্ভব হয় না। প্রধান জায়গাগুলোকেই ‘টার্গেট’ করতে হয়।বসলাম বইপত্র নিয়ে। 

আমেরিকা মহাদেশের ম্যাপের একেবারে তলার দিকে যদি কেউ দেখেন, অর্থাৎ একেবারে দক্ষিণ দিকে একটি প্রদেশ রয়েছে, যার একপাশে রয়েছে আরিজোনা আর একপাশে রয়েছে টেক্সাস।তার নাম নিউ মেক্সিকো।
এই প্রদেশটা সম্বন্ধে খুব বিস্তারিতভাবে কিছু বলছি না।অনেকেই হয়ত জানেন, তবু দু চার কথা না বললেই নয়।

আমেরিকার যে মোট পঞ্চাশটি প্রদেশ আছে, তার মধ্যে এটি আয়তনে পঞ্চমস্থান দখল করেছে।কিন্তু এর লোকসংখ্যা খুবই কম, সেই হিসাবে এটি ৩৬ তম জায়গা নিয়েছে। কাজেই এখানে সব কিছুই বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মাইলের পর মাইল শুধু ফাঁকা জায়গা। এটি মেক্সিকোরই অংশ ছিল ১৮৪৮ সালের আগে পর্যন্ত। তার পর এটি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমেরিকার সাথে যুক্ত হয়। আমেরিকা এটিকে ৪৭ তম প্রদেশ হিসাবে মান্যতা দেয় ১৯১২ খীষ্টাব্দে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


রাত প্রায় ১০ টা নাগাদ পৌঁছালাম নিউ মেক্সিকোর El Paso এয়ার পোর্টে। গাড়ি আগে থেকে 'বুক' করাই ছিল।সঙ্গেও ছিল খাবার। গাড়ী ছুটল অন্ধকারের বুক চিরে ধূ ধূ মাঠকে দু টুকরো করে দুপাশে ফেলে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। আপাতঃ লক্ষ্য রাতের আস্তানা হোটেলের নরম কোমল নিশ্চিন্ত এক শয্যার আরাম। কারণ,আগামী কালই রয়েছে সূর্য ওঠার আগের ভোরের এক পরিকল্পনা।

হোটেলে পৌঁছালাম যখন, প্রথম রাতের পাখীরাও তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।রাতও তখন চলতে চলতে মধ্যপথে। ঘড়ি বলছে দেড়টা।শুতে শুতে দুটো বাজল।

পরদিন ভোর পাঁচটায় ছাড়তে হল বিছানা। ৫.৩০ টার মধ্যে মোটামুটি তৈরী হয়ে বেরোলাম - উদ্দেশ্য এক পাখীর আস্তানায় জলাভূমিতে পাখী দেখা।চোখে তখনও ঘুম ভাল করে ছাড়ে নি। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, দিনের ঘুমও তখন ছাড়ে নি। কুয়াসা তাকে জড়িয়ে রেখেছে।আমাদের উদ্দিষ্ট জায়গার নাম Bosque  del apache wildlife refuge।এখানে প্রায় ৫৭০০০ একরের এক জলাভূমিতে হাজার হাজার Sandhill cranes, Snow geese, Ross geese, Ducks  এবং বহু জলচর পাখী দেখা যায়।এছাড়া Hawk, Eagle ইত্যাদি নানা পাখীও যায়।জন্তুর মধ্যেও Coyote, Mule deer, Jack rabbits ইত্যাদি দেখা যায়।Rio Grande র কাছে এই বিশাল জলাভূমিতে শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেয় হাজার হাজার পাখী। Chupadera এবং San Pascual পর্বতের মাঝে Chihuahuan মরুভূমির উত্তর দিকে এই পার্ক।এটি ছড়িয়ে রয়েছে আমেরিকার New Mexico প্রদেশের San Antonioতে এবং Socorro Countyতে।১৯৩৯ সালে এই পার্কটি মানুষের দর্শনীয় হিসাবে খুলে দেওয়া হয়।

 এখানে মানুষ জড়ো হয় সূর্য ওঠার আগে থেকে। কারণ সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাখীরা সাধারণতঃ তাদের এই রাত্রি আবাস ছেড়ে রওনা হয় আরও দূর পথে।সেই ওড়ার সময় এই হাজার হাজার পাখীর ডানার শব্দে এবং তাদের সাদা পাখায় প্রথম ঊষার অরুণালোকের বিচ্ছুরণে যে অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তাই এখানকার প্রধান দর্শনীয়।তবে সব সময়েই যে পাওয়া যায় তা নয়।

গিয়েই দেখি বহু মানুষ ভীষণ লম্বালম্বা টেলিলেন্স লাগানো ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন জায়গা খুঁজে। অপেক্ষা করছেন বিশেষ মূল্যবান মুহুর্তের,যা ধরে রাখবেন তাঁদের যন্ত্রের স্মৃতিতে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল ঘাস আর ছোট ছোট ঝোপ গাছ আচ্ছাদিত জলাভূমি।কোথাও অল্প জলা, কোথাও শুধু কাদা, কোথাও বা শুষ্ক।দূরে দূরে কিছু পাহাড়ও দেখা যাচ্ছে।এখানে ওখানে বেশ কিছু পাখী দেখলাম।
বিভিন্ন জায়গায় তৈরী করা রয়েছে ফ্লাইট ডেক। ফ্লাইট ডেক হল স্থলভূমি থেকে কাঠের পাটাতন দেওয়া একটা মঞ্চ, যা জলাভূমিতেও কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে।এখান থেকে পাখী দেখার প্রশস্ত সুযোগ ও ব্যবস্থা আছে। এক জায়গায় দেখলাম Sandhill cranes এর এক বিশাল ঝাঁক, ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের খোঁজে। কিন্তু দেখার ইচ্ছা ছিল উড়ন্ত পাখীর ঝাঁক।সেটা যদি সামনে দিয়ে মাঠ ছেড়ে উঠে যায় বড় সুন্দর সে দৃশ্য।কিন্তু সেটা আর হল না।আকাশ এখনও মেঘলা মেঘলা। ফলে শীতের ভাব রয়েছেই। এতক্ষণে ভোর হচ্ছে।সূর্যদেব আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কুয়াশার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে।কিন্তু কুয়াশা বা মেঘও কম শক্তিশালী নয়।লড়াইয়ে জমি তারাও ছাড়তে রাজী নয়।

সেই লড়াইয়ের মধ্যেই আমরা ঘুরে নিলাম পুরো 'রিম'।রিম হল, এই বিশাল ক্ষেত্রটি ঘুরে দেখার জন্য এর চারধার ঘিরে যে হাঁটা, বাইকিং বা গাড়ি চলার মত রাস্তা করা আছে সেটি। উদ্দেশ্য, যদি বিরাট কিছু পাখীর ঝাঁক কোথাও চোখে পড়ে–। 

তবে আমাদের কপাল তত সুপ্রসন্ন নয়। পাখী যদিও অনেক দেখলাম, কিছু কিছু উড়ন্তও দেখলাম তবে বিশাল ঝাঁক বেঁধে ওড়ার যে সৌন্দর্য তা দেখতে পেলাম না।চোখে পড়ল কিছু উড়ন্ত ঈগল, আর র‍্যাভেন্স বা দাঁড়কাকের মত বড় কাক।অনেকে বলল, আসলে এই মেঘলা দিনে পাখী কম আসে।জানি না এর সত্যি মিথ্যে।তবে আমাদের কপালে যে মেঘের ছায়া, সেটা ভালই বুঝলাম।

যাই হোক, এতবড় একটা জলাভূমি ও পাখীদের স্বর্গরাজ্যের বিচরণক্ষেত্র দেখলাম,এত  রকম পাখীও দেখলাম, তাই বা কম কি!

গাড়ী ,এর পর, একটু বেলা বাড়তেই ছুটল অন্য এক লক্ষ্যের দিকে।প্রায় ২৫০ কিমি দূরে এবং পৌনে তিন ঘণ্টার রাস্তা।
রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত ফাঁকা জমি, আর মাঝে মাঝে পড়ছে কিছু কিছু জঙ্গল, দু চারটে বাড়ি।
একসময় শেষে পথও ফুরালো।যখন এসে পৌছালাম, তখন বেলা দুপুর।
চারপাশটা বেশ ফাঁকা ধূ ধূ মরুভূমির মতই।সামনে যে ভিজিটর সেন্টার রয়েছে তা- ও একটু অন্যরকমের দেখতে।এখানকার অনেককিছুই কেমন যেন গ্রাম্য মাটির বাড়ির মত দেখতে।রংটাও সেই রকমই। সাধারণ, ঝাঁ চকচকে যেমন আমেরিকার বাড়ি হয়,মোটেই সে রকম নয়।কাঠের কড়িবরগা দেওয়া মাটির একটা বেশ বড়সড় একতলা বাড়ির মত, যদিও তার ভিতরে গিফট শপ থেকে শুরু করে রেস্টরুম পর্যন্ত সবই আছে।একটা ছোট ডকুমেন্টারি ফিল্মও দেখানো হয় আগ্রহী পর্যটকদের।এর সামনে বেশ বড় বড় কিছু ঘাসের ঝোপ ছাড়া গাছপালা বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না।কেমন যেন শুকনো মরুভূমির পরিবেশ।

এখানে আমরা আর বেশি সময় নষ্ট করলাম না।এটাই সেই বিখ্যাত সাদা বালির মরুভূমি বা White Sands National Park, যা দেখতে আমাদের আসা।

দূরে দেখতে পেলাম, ঘন নীল আকাশের নীচে ঊজ্বল সূর্যের ঝকঝকে আলোয় সাদা ধবধবে বালির পাহাড়ের সারি। সাদা দুধসাগরের ঢেউ যেন হঠাৎ কোন মন্ত্রবলে স্থির হয়ে জমে রয়েছে।তাদের গায়ে আলো পড়ে চিকচিক করছে।

পার্কের ভিতরে টিকিট কেটে ঢোকা গেল।বালি দুপাশে সরিয়ে মাঝে গাড়ি যাওয়ার মত রাস্তা করা আছে। অনেক গাড়িই এসেছে।তবে গাড়ির চাকা যেন রাস্তা ছেড়ে বালির উপরে না যায় তার জন্য সতর্কতা বাণীও আছে।
আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে ঢুকল পার্কে।
সঙ্গে থাকুন পরবর্তী পর্বেও–

ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments