লাগে দোল পাতায় পাতায় ( চতুর্থ পর্ব )
হার্দিক
মিলি ঘোষ
দুনিয়াটা কত স্বাভাবিক। রোদ ঝলমলে দিনে হঠাৎ আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে গেল, তেমনও নয়। দিব্য রোদ উঠেছে। ব্যালকনিতে যে'কটা চড়ুই রোজ আসে, আজও এসেছে। একই রকম কিচিরমিচির। মধু বিস্কুটের টুকরো দিলে, একইভাবে মুখ নিয়ে উড়ে যাওয়া। সব বাড়িতে সকালের রোজকার ব্যস্ততা। কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই। নিচের বারান্দা লাগোয়া অপরাজিতা গাছটাতে যে ক'টা ফুল ফোটার কথা, ঠিক সেক'টাই ফুটেছে। বাড়তি একটা পাতাও হয়তো ঝরেনি আজ।
অনুরাগের হঠাৎ পরিবর্তনে দুঃখ পেলেও অবাক হয়নি মধুবন্তী। এমন নয় যে, অনুরাগ এরকমই। বরং মানসিকতায় বহু মানুষের থেকে পৃথক ও উন্নত। দুঃখটা এখানেই মধুর। নাহলে, এই ধরনের ঘটনা সমাজ সংসারে নতুন কিছু নয়।
অনুরাগের বাবা, মা কিন্তু মধুবন্তীর পদোন্নতিতে খুবই খুশি। ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় সে উচ্ছ্বাস চেপেও রাখেননি পরিমলবাবু। অনুরাগ বুদ্ধিমান। বাবা, মা'কে বুঝতেও দেবে না ওর যন্ত্রণাটা কোথায়। ওঁদের সঙ্গে ব্যবহারে যে কোনওরকম ছেদ পড়েনি, সে মধুবন্তী ভালোই বুঝেছে।
মধুবন্তী রোজই মেসেজ দেয়। বেশ একটু দেরিতেই সিন হয়, একটা দু'টো মামুলি কথা, এ'টুকুই। তবু মধু'র দিক থেকে চেষ্টা একটা থাকেই। আর থাকে, মনের অন্তস্থল থেকে প্রার্থনা, অনুরাগের প্রমোশনের জন্য।
সব ঠিকঠাকই ছিল, অনুরাগের প্রোমোশন আগের মাসেই হবার কথা। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য হাতের তৎপরতায় আটকে গেল। সে জায়গায় হলো, নেহা আগরওয়ালের। এ ঘটনাও নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে এ'সব চক্রান্তের শিকার বহু মানুষ হয়েছে। তবু অন্যেরটা শোনা আর নিজে মুখোমুখি হওয়া তো এক নয়। মন মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে ছিল অনুরাগের। তার মধ্যে মধুর প্রোমোশনের খবরে কাটা ক্ষতে নুনের ছিটে লেগেছে।
নেহা কীভাবে প্রোমোশন পেয়েছে অফিসের সকলেই জানে। এই নিয়ে কলিগদের মধ্যে চটুল রসিকতাও চলছে। তাতে অংশ গ্রহণ করছে, মহিলা সহকর্মীরাও। যা সত্যি, তা সত্যি। সমালোচনা হবেই। সহানুভূতি না দেখালেও, অনুরাগের পাশে কলিগরা সকলেই আছে। অনুরাগ সেটা বোঝে। এতে যন্ত্রনায় প্রলেপ কিছুটা হলেও পরে।
মধুকে মজা করে বলেওছে একদিন, "তোর প্রোমোশনও আটকাবে না।"
মধুবন্তীর গা রি রি করেছিল।
বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ ঘুরিয়েছিল অনুরাগ। মধু জানে, অনুরাগ মজার ছলেই বলেছে। তাই অসম্মানিত হলেও কথাটা মনে রাখতে চায়নি।
মধুবন্তীর গান শুনে শুনে এতদিনে অনুরাগের কান ক্লান্ত। প্রসঙ্গও ওঠেনা। কথা যে বলে না, তা নয়। নিজে থেকেও বলে। আগের থেকে একটু স্বাভাবিক। তবু কোথায় যেন সুর কেটেছে। মনের সঙ্গে যুদ্ধ কি অনুরাগ করছে না ? করছে।
নিজেই নিজেকে বলে, "ঠিক করছি না। মধুর তো কোনও দোষ নেই। আমি যখন আগে জব পেলাম, মধু তো এমন করেনি। তাহলে আমি কেন মানতে পারছি না?"
স্বাভাবিক হবার চেষ্টাও করেছে অনুরাগ। তবু, শব্দ-ছন্দের মেলবন্ধন কিছুতেই হয়নি।
একটু বেশি রাতেই মধুবন্তী সেদিন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল। চারদিকটা বেশ অন্ধকার। অমাবস্যা কি ? মধুবন্তী তাকাল আকাশের দিকে। তারাগুলো ঝকঝক করছে। রাস্তার আলোগুলোও ঠিকঠাক জ্বলেনি আজ। কোনওটা যেন একা একাই হাসছে। এত হাসি আসে কোথা থেকে ? এরকম গায় পড়া হাসি দেখলে বিরক্ত লাগে মধুর। আর একটু এগিয়ে কোনাকুনি লাইটটা কেমন একা! একটু আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
মধু ভাবছে, "এমন নির্বাক কেন পোস্টটা ? ও কি কিছু হারিয়েছে ? প্রাণের চেয়েও প্রিয় কোনও জিনিস ?"
মধুবন্তী ঝুঁকে ওই না জ্বলা দুঃখী লাইট পোস্টটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। তখনই চোখে পড়ল একটা অলোকবিন্দু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
"জোনাকি!" মধুবন্তী অস্ফুটে বলল।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
বেশ আগে মাঝেমাঝে দেখা মিলত জোনাকিদের। এই আলোর শহরে ওরা বোধহয় আর নিশ্বাস নিতে পারে না। তবু শহুরে আদব কায়দা রপ্ত করতে কখন এসে আত্মগোপন করেছে, কে জানে! অন্ধকারের প্রতি কী তীব্র ভালোবাসা জোনাকির! ঝিম ধরা নিশুতি রাতে ঠিক বেরিয়ে পড়েছে। একবার মধুবন্তীর সামনে দিয়ে ঘুরেও গেল।
মধুবন্তী আপন মনে গুনগুন করতে থাকে,
"ও জোনাকি, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ ..."
মধু থামতেই অনুরাগ বলল, "সত্যি মধু, কী ভালো গাস রে তুই। অথচ, এক জায়গায় আটকে রইলি। কোথাও কোনও অডিশন দিলি না। কতবার বললাম তোকে।"
"ওসবে হ্যাপা আছে। সব জায়গায় ড্যাসিং পুশিং। অত টেনশন নিতে পারব না। তার চেয়ে এই ভালো, তোদের শুনিয়ে আনন্দ, আর আমার গেয়ে আনন্দ। মানুষ যা করে, সব নিজেকে ভালো রাখার জন্য।"
"বলছিস ?"
"অবশ্যই।"
"তাহলে, এই যে বলে, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। সেটা তাহলে মিথ্যে, সেখানেও কি স্বার্থ জড়িয়ে থাকে ?"
"মিথ্যে নয়, কিন্তু মা'ও সেটা করে, তার নিজের সন্তানের জন্য। এটা করতে তার ভালো লাগে, তাই করে, কোনও কিছু আশা না করে। তাই সেটা নিঃস্বার্থ।"
"আর যাঁরা সার্বিকভাবে কাজ করেন, বিভিন্ন মিশন, সংস্থা, তাঁরা কীসের টানে করেন ?"
"সেখানেও ভালো লাগাই কাজ করে। যদি বলিস প্রচার। সেটাও ভালো লাগা। এই কাজগুলো করে তাঁরা আনন্দ পান।"
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে ঘুরে তাকায় মধুবন্তী।
"কী হয়েছে বল তো ? মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি ?" শাশুড়ি মায়ের স্নেহের পরশে চোখে জল আসে মধুর।
মধুবন্তী কিছুই বলতে পারে না।
সুপ্রিয়াদেবী বললেন, "একা একা বকবক করছিস। দরজা দিয়ে শুয়ে পর। রাত হলো অনেক।"
মধুবন্তী খেয়াল করে দেখল, সেই রাতের পর থেকে সুপ্রিয়াদেবী, ওকে আর তুমি করে বলেন না।
এর মধ্যেও একদিন বলেছেন, "তোর বয়সটা আমিও পার করেছি।"
এই সমস্ত কথার কী উত্তর দেবে, বুঝেই উঠতে পারে না মধুবন্তী। কিন্তু ক'দিনে একটা গাঢ় বন্ধুত্ব যেন গড়ে উঠেছে মা-মেয়েতে।
মধু অফিস থেকে ফেরার সময় ভাবছিল, "মা কি তবে বুঝতে পেরেছে ? না কি অনু .... নাহ্, অনু বলার ছেলে নয়।"
এ'বছর পুজোয়, অনুরাগ বাড়ি এল না। কাজের চাপ। এটা জানাই ছিল। অবাক হয়নি মধুবন্তী, অবাক হননি সুপ্রিয়াদেবী।
পরিমলবাবু খালি বারবার বলছেন, "পুজোর দিনে ছেলেটা ঘরে না থাকলে, ভালো লাগে ?"
ভালো আর কার লাগে। ভালো কি অনুরাগেরও লাগছে ? ব্যাপারটা যে জেদাজেদির জায়গায় পৌঁছেছে, তা নয়। পরিবারের প্রত্যেকে আলাদা করে ওকে অনুরোধ করেছে, পুজোর ক'টা দিন কাটিয়ে যেতে। অনুরাগ নারাজ।
শেষমেশ সুপ্রিয়াদেবী, তাঁর স্বামীকে হয়তো কিছু বলেছেন।
পরিমলবাবু খেতে বসে বললেন, "পুণেতে তো তোমাদের অফিস আছে। চলে যাও। এখানে বুড়ো-বুড়ির সঙ্গে কতদিন কাটাবে ?"
আপত্তি করে মধুবন্তী, "অসম্ভব। আমি চলে গেলে, আপনাদের কে দেখবে ?"
"আমরা ঠিক আছি। তুই এবার চলে যা।" স্বামীকে সমর্থন করলেন, সুপ্রিয়াদেবী।
মধু বলল, "যেতে পারি, যদি তোমরা সাথে যাও।"
মোটামুটি ঠিক হলো, একবার সবাই মিলে পুণে যাবে। কিন্তু পরিমলবাবুর আকস্মিক অসুস্থতায় তাতে ছেদ পড়ল।
খবর পেয়ে ছুটে এল অনুরাগ।
মা যে এখন মধু'র সঙ্গে নিজের মেয়ের মতো আচরণ করছে, চোখে পড়েছে অনুরাগের। ও আসার আগেই, বাবাকে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছে মধু।
বাবা, বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে অনুরাগ। সেই মতো ছুটি নিয়েই এসেছে ও। কিন্তু বাবা বাড়ি ফিরে শুধু মধু আর মধু। নিজেকে কেমন ব্রাত্য লাগে অনুরাগের। দুই একবার নিজের মনে 'আদিখ্যেতা' শব্দটাও উচ্চারণ করেছে।
পুণেতে গেলে মধুবন্তী যে একা হয়ে পড়বে, তা সে বিলক্ষণ জানে। সে'জন্যই আরো যেতে চায়নি। আর এই মানুষ দু'টো ? তাঁদের ছেড়ে থাকার কথা আজকাল ভাবতেও পারে না মধু। কেমন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের সম্পর্কহীন দুই বাবা, মায়ের সঙ্গে।
( চলবে )
0 Comments