জ্বলদর্চি

রামনবমী (राम नवमी) /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬৪

রামনবমী (राम नवमी) 

ভাস্করব্রত পতি

একসময় রাজা দশরথের যৌবনকাল শেষের পথে। কিন্তু তাঁর কোন সন্তান হল না বংশে। কি হবে উপায়? বংশ রক্ষা হবে কি করে? এতে রাজা দশরথ খুবই চিন্তায় দিন কাটাতে লাগলেন। শেষে তিনি কুল পুরোহিত বশিষ্ঠদেবের শরণাপন্ন হলেন। তিনি রাজাকে বললেন, তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একসাথে শিবদুর্গার মন্ত্র জপ করতে। এর পর রাজা দশরথ খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ওই মন্ত্র জপ করতে লাগলেন সস্ত্রীক। রাজা দশরথের নিষ্ঠা ও ভক্তি দেখে স্বয়ং মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, “আমি তোমার জপ ও নিষ্ঠায় খুবই প্রসন্ন হয়েছি। একদিন তোমার মনস্কামনা ঠিকই পূরণ হবে। তবে তুমি অবিলম্বে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার ব্যবস্থা কর। তার পরেই রাজা দশরথ রাজপুরোহিতের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার আয়োজন করলেন। অনেক কষ্টে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে সাদরে আহ্বান করে যজ্ঞের কাজ সম্পন্ন করলেন। যজ্ঞ শেষ হওয়ার পর সেই যজ্ঞের চরু দশরথের তিন রাণী কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রাকে খেতে দেওয়া হল। যজ্ঞের চরু খাওয়ার অল্পদিন পরেই রাণী কৌশল্যা সহ বাকি দুই রাণী গর্ভবতী হলেন। তারপর দশ মাস দশ দিন যেদিন পূরণ হল, সেদিন ছিল চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথি। পুনর্বসু নক্ষত্রের উদয় হওয়ার পর শুভলগ্নে স্বয়ং ভগবান কৌশল্যা দেবীর গর্ভে রামচন্দ্র রূপে ভূমিষ্ঠ হলেন। এটি ছিল অতি পুণ্যের দিন। এই উপলক্ষ্যে রাজ্যজুড়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল সেদিন। অতিব পুণ্য দিন বলেই চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের নবমীর দিন পরিচিত হয়ে উঠলো 'রামনবমী' নামে। এই দিনটি চৈত্র নবরাত্রিরও শেষ দিন হিসেবে পরিগণিত। তাই, রামনবমীকে 'রাম নবরাত্রি'ও বলা হয়। 

প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, চৈত্র মাসের শুক্লা নবমীর দিন এই লৌকিক উৎসব পালন করা হয়। বিধান অনুসারে এই রামনবমীর দিন উপোস করে থাকতে হয়। সেইসাথে পিতৃপুরুষের তর্পণ করতে হবে। শেষে রামনবমীর ব্রতকথা শোনার পর উপোস ভঙ্গ করতে হবে। 

সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে পরিষ্কার জামা কাপড় পরে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য হিসেবে আঁচলা ভরা জল কিংবা দুধ প্রদান করতে হয়। এবার তুলসী পাতা, পদ্ম ফুল, চন্দন, গঙ্গাজল, অন্যান্য ফুল, ধান, চাল, দুর্বা দিয়ে ভগবান শ্রীরামের উপাসনা করেন ভক্তরা। শ্রীরামচন্দ্রের পূজা করার সময় বলতে হয় -- "শ্রী রামচন্দ্র কৃপালু ভজমান হারান ভাবা দারুণম" 

প্রসাদ হিসেবে নানা ধরনের ফল এবং মিষ্টি দেওয়া হয়। এদিন ভক্তরা ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে হলুদ বর্ণের পোশাক পরিয়ে দেন। রামচন্দ্রের কপালে তিলক কেটে দেন যত্ন সহকারে। সেইসাথে পরিবারের সকলের কপালেও তিলক কাটা হয়। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের ধ্যানমন্ত্র --
ওঁ কোমলাঙ্গং বিশালাক্ষ মিন্দ্ৰনীল সমপ্রভং। 
দক্ষিণাংশে দশরথং পুত্রাবেষ্টন তৎপরং।
পৃষ্ঠতো লক্ষণং দেবং সচ্ছত্রং কনকপ্ৰভং॥
পার্শ্বে ভরতশত্রুঘ্নৌ তালবৃন্ত করাবুভৌ।
অগ্রে ব্যগ্রং হনুমন্তং রামানুগ্রহকাঙ্ক্ষিণম্ ৷৷

রামনবমী দিনটি সকল রাম ভক্তদের কাছে অন্যতম পবিত্র দিন। রামচন্দ্রের লীলা কাহিনী শ্রবণ করেন সারাদিন ধরে। নদী বা জলাশয়ে ডুব দিয়ে শুচি হতে চেষ্টা করেন। এই অনুষ্ঠানের মূল উপচার পালিত হয় অযোধ্যা তে। কিন্তু সারা দেশের অন্যান্য এলাকার মতো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন যায়গাতেও ভক্তপ্রাণ হিন্দুরা পালন করেন রামনবমী ব্রত। বিভিন্ন মন্দিরে আয়োজিত হয় ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পূজাপাঠ। 

মানুষের বিশ্বাস, এ দিন নিষ্ঠা সহকারে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পুজো করলে মনের যাবতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা এবং মনোভিলাশ পূরণ হয়। রামচন্দ্রের কৃপায় যাবতীয় সংকট থেকে মুক্তি মেলে। এদিন শুধু রামচন্দ্র নয়, এর সাথে দেবী দুর্গারও পূজা হয় কোথাও কোথাও। এরফলে নাকি সব ধরনের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। 

গবেষকদের মতে, চৈতন্য মহাপ্রভুই বৈষ্ণব ধর্মের জাগরণের জন্য বৈষ্ণবীয় ভাবনাকে প্রস্ফুটিত করতে নানা ধরনের তিথি পালনের উপর জোর দিয়েছিলেন। যেমন বামন দ্বাদশী, রামনবমী, নৃসিংহ চতুর্দশী ইত্যাদি। ফলে বৈষ্ণবরা এই তিথিগুলি পালন করেন। রামনবমীর দিন শ্রীরামচন্দ্রের কীর্তন, পূজাপাঠ আয়োজিত হয় গৌড়ীয় মঠে। 
হাওড়ার রামরাজাতলায় রয়েছে রাম সীতার যুগল মূর্তি। আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে জনৈক ভূস্বামী অযোধ্যারাম চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পূজা শুরু করেছিলেন। রামরাজা ঠাকুরের নামেই 'রামরাজাতলা' নামকরণ হয়েছে। এখানে রামনবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার এই যুগল মূর্তির বিসর্জন হয়। উচ্চতায় ২৩ ফুট, প্রস্থে ১৫ ফুট। এই যুগল মূর্তির সাথে থাকে আরও ২৬ টি বিগ্রহ। তবে সবার উপরে স্থান দেবী সরস্বতীর। আসলে বহু আগে এখানে সরস্বতী পূজা হত। তাই এখনও সেই ধারা জারি রাখতে সরস্বতীর স্থান সবার উপরে রাখা হয়েছে। এখানে প্রথম সারিতে শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তির বামে সীতাদেবী, ডানে লক্ষ্মণ, ভরত এবং ব্রহ্মা। দ্বিতীয় সারিতে শত্রুঘ্ন, বিভীষণ এবং সবার নীচে হনুমান, জাম্ববান, নন্দী, ভৃঙ্গী, বাল্মিকী, বশিষ্ঠ প্রমুখদের বিগ্রহ রয়েছে। রামরাজাতলার রামনবমী উৎসব এরাজ্যের উৎসবপ্রিয় বাঙালিদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় উৎসব।

Post a Comment

0 Comments