জ্বলদর্চি

হাওড়া রামরাজাতলা এবং অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক উৎসব /মৌমিতা চ্যাটার্জী

হাওড়া রামরাজাতলা এবং অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক উৎসব

মৌমিতা চ্যাটার্জী


আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে স্থাপত্য, লোককথা। এরা চিরকাল অন্তরালেই থাকে। আড়ালে থেকে যায় কত প্রাচীন কাহিনি। এমন‌ই এক বর্ণময় কাহিনির নায়ক হাওড়ার রামরাজাতলার রামঠাকুর।

হাওড়ার সাঁতরাগাছির আগের স্টেশন‌ই হল রামরাজাতলা। স্থানীয় নাম রামতলা। হাওড়া ডিভিশনে দক্ষিণ পূর্ব শাখায় অবস্থিত। 
আজ থেকে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ বছর আগেকার কথা। এই সময় এখানকার জমিদার ছিলেন অযোধ্যারাম চৌধুরী। তিনি একবার স্বপ্নে রামচন্দ্রের পুজো করার আদেশ পান। তাঁর গৃহদেবতা ছিলেন রাম। তিনি চিন্তিত হন এই রামের মূর্তি কিরূপ হবে। সে সমাধান‌ও স্বপ্নে‌ই হয়। তিনি  স্বপ্নেই রাম সীতার রূপ দর্শন করেন এবং সেইমতো মূর্তি তৈরী হয়। শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। রামপুজোর মূর্তি প্রস্তুতির বাঁশ আনা হয় ষষ্ঠীতলার নির্দিষ্ট বাঁশঝাড় থেকে। এই রীতি আজ‌ও মানা হয়।
রামরাজাতলার রাম এর সাথে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার রামের মিল নেই। এখানকার রামমূর্তিতে বাঙালীয়ানার সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। 
      এখানে অন্য একটি কাহিনিও আছে। এই অঞ্চলে স্থানীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবার মহাসমারোহে সরস্বতীপুজো করতেন। পুজো উপলক্ষ্যে মেলা, পুতুলনাচ, কীর্তন ইত্যাদি চলত। কিন্তু অযোধ্যার কর্তৃক রাম পুজোর প্রচলন হবার পর সরস্বতী পুজোর সঙ্গে একটি মতবিরোধ তৈরী হয়।
তখন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা। সেই সময় থেকে স্থির হয় নবমী থেকে রামপুজো শুরু হবে এবং শ্রীপঞ্চমীতে মূর্তি উদ্বোধন হবে। সেই অনুযায়ী এখন‌ও এই প্রথা চালু আছে। এক‌ই মঞ্চে সমস্ত দেব দেবীর মূর্তি সজ্জিত থাকে এবং সরস্বতী দেবী থাকেন সবার উপরে। বর্তমানে প্রায় তিন চার মাস ধরে এই পুজো চলে। পুজো উপলক্ষ্যে মেলাও বসে। রামের সাথে এখানে সাবিত্রী সত্যবান,মহাবীর, দশাবতার প্রত্যেকে পূজিত হন আলাদা আলাদাভাবে।
শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে রাম বিসর্জন হয়। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



এই এক‌ই সময় আর‌ও দুটি পূজা অনুষ্ঠিত হয়। হাওড়ার ইছাপুর অঞ্চলে পূজিতা হন দেবী শমীচন্ডী। ইনি মা দূর্গার‌ই রূপ। দেবী শমীচন্ডী মূলতঃ বাড়ুই সম্প্রদায়ের আরাধ্যা দেবী। হাওড়ার আমতা অঞ্চলের কুন্ডুপাড়া গ্রামে প্রায় ২০০ -২৫০ বছর যাবৎ দেবীর পূজা হয়। আগে বৈশাখে এই পূজা হত কিন্তু পরবর্তীকালে এই পূজার আয়োজন শীতকালে করা হয়। দেবীর ডানদিকে দেবী লক্ষ্মী ও বাঁদিকে দেবী সরস্বতী অবস্থান করেন। এছাড়াও থাকেন দুই পরী ও দুই ঋষি । দেবীর চারহাতের দুহাত বেষ্টিত শঙ্খ, চক্রে এবং অন্যান্য দুই হাত মুদ্রাবেষ্টিত।

বাকসাড়া অঞ্চলে নতুন ও পুরাতন নবনারীতলায় চলে কৃষ্ণরূপী নারায়ণের আরাধনা। পুরোনো নবনারীতলায় পুজো শুরু হয় বুদ্ধপূর্ণিমার দিন ও নতুন নবনারীতলায় পুজো শুরু হয় অক্ষয়তৃতীয়ার দিন থেকে। নবনারীতলার এই পুজোয় রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে ন'জন নারীও পূজিতা হন। পুরাণ অনুসারে, গোকুল ত্যাগের পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের কথা দিয়েছিলেন যে, কংসবধের পর তিনি পুনরায় প্রত্যাবর্তন করবেন। কিন্তু তা না হ‌ওয়ায়, গোকুলের ন'জন গোপিনী পুরুষের ছদ্মবেশে কৃষ্ণকে পুনরায় গোকুলে ফিরিয়ে আনার উপক্রম করেন। এই নয় নারীই নবনারী হিসেবে পূজিতা হন। এই প্রত্যেকটি পুজোর শেষে বিসর্জন হয় শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার অর্থাৎ রাম বিসর্জনের সঙ্গে। 
আঞ্চলিক উৎসব হিসাবে এই উৎসব আজ‌ও যথেষ্ট গূরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে ও এবং অদূর ভবিষ্যতেও এই উৎসবের গুরুত্ব এক‌ই ভাবে বজায় থাকবে আশা করা যায়।

Post a Comment

0 Comments