পর্ব ৬৭
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
কালীপ্রসাদ পিতামাতাকে না জানিয়ে দক্ষিণেশ্বরে চলে এসেছিলেন। স্বভাবতই এটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তাঁকে চিন্তামুক্ত করেন শশী। কেননা কালীপ্রসাদকে তিনি জানান যে তিনিও বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে এসেছেন। সমবয়সি, সমমনোভাবাপন্ন শশীকে পাশে পেয়ে অনেকটা চিন্তামুক্ত হন কালীপ্রসাদ। পরদিন সকালে ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাতে ঠিক কী হয়েছিল তা জানার জন্য পুনরায় গম্ভীরানন্দজীর ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থটির শরণাপন্ন হতে হবে। ভক্তমালিকায় বর্ণনা এইরকম -- “অনুরাগের নবোদয়ে বিনিদ্ররজনী-যাপনান্তে কালীপ্রসাদ পরমহংসদেবের আহ্বানে ব্রাহ্মমুহূর্তে শ্রীগুরুসকাশে উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে, তিনি এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়িতেছেন এবং যোগশাস্ত্রের সহিত পরিচিত আছেন। তৎপরে তিনি সানন্দে কালীপ্রসাদকে উত্তরের বারান্দায় লইয়া গিয়া একখানি তক্তপোশে যোগাসনে বসাইলেন এবং স্বীয় মধ্যমাঙ্গুলি দ্বারা জিহ্বায় বীজমন্ত্র লিখিয়া দিয়া দক্ষিণ হস্ত দ্বারা বক্ষঃস্থল হইতে শক্তিকে উর্ধ্বদিকে আকর্ষণ করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কালীপ্রসাদ গভীর ধ্যানে মগ্ন হইলেন। কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর আবার শক্তিকে আকর্ষণপূর্বক অধোদিকে নামাইয়া দিলে তিনি বাহ্যভূমিতে ফিরিয়া আসিলেন। ইহার পর ঠাকুর তাঁহাকে ধ্যানাদি সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন এবং ধ্যানে যে সব দর্শনাদি হয় তাহা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিতে আদেশ করিলেন, অধিকন্তু কালীপ্রসাদকে অবিবাহিত জানিয়া বিবাহ করিতে নিষেধ করিলেন। অতঃপর কালীপ্রসাদ কালীমন্দিরে কিয়ৎক্ষণ ধ্যানান্তে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলেন। বিদায়কালে ঠাকুর তাঁহাকে মিষ্টি প্রসাদ দিয়া বলিলেন, ‘আবার এসো। যদি পয়সা যোগাড় না হয়, তবে এখান হতে দেওয়া হবে।’ সেদিন এক ভদ্রলোক গাড়ি করিয়া কলিকাতায় ফিরিতেছিলেন। ঠাকুরের ইচ্ছানুসারে তিনি কালীপ্রসাদকে গাড়িতে তুলিয়া লইলেন।”
এদিকে কালীর বাড়িতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। রবিবার বিকেল পর্যন্ত কালী বাড়িতে ফিরে আসেন নি। তাঁর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। কালীর গর্ভধারিণী কেঁদে সারা হন। ভাবেন পুত্র বুঝি গঙ্গায় ডুবে গেছে! সম্ভাব্য সমস্ত স্থানে তাঁর খোঁজ নেন পিতামাতা। অবশেষে জননীর মনে পড়ে সম্প্রতি কালী রানি রাসমণির মন্দির উদ্যান সম্পর্কে নানা খোঁজখবর করতেন। ফলে নিজ স্বামীকে সেখানে খোঁজ করতে যেতে বললেন। পরদিন সকালে রসিকলাল দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে গিয়ে জানলেন ইতিমধ্যেই কালী কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বর পরিত্যাগের সময় রসিকলাল পরমহংসদেবকে বললেন, “মহাশয়, কালী আমার পুত্র। অনুগ্রহ করে তাঁকে বিবাহ করে সংসারধর্ম পালনের উপদেশ দিন।” শ্রীরামকৃষ্ণ প্রত্যুত্তরে জানালেন, “তোমার পুত্রের মধ্যে এক মহান যোগী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। সে যখন বিবাহ করতে ইচ্ছুক নয়, তখন জোর করে তাঁকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে কি লাভ?” রসিকলাল জানান, “পিতামাতার সেবা করাই পুত্রের পরম ধর্ম।” শ্রীরামকৃষ্ণ নিশ্চুপ রইলেন, রসিকলাল গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।
আধ্যাত্মিক জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথ সবসময় রেশমের মতো মসৃণ নাও হতে পারে। ঈশ্বরানুসন্ধানী মানুষ বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ উভয় দিক দিয়েই বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে প্রথম দর্শনের পর থেকে তাঁর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন কালীপ্রসাদ। ফলে যখনই পারতেন তাঁকে দর্শন করতে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে উপস্থিত হতেন। কিন্তু পিতা রসিকলাল কালীর এহেন গতিবিধি রোধ করতে সচেষ্ট হলেন! গৃহের সদর দরজা তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করলেন যাতে কালী বাড়ির বাইরে সহজে পা না রাখতে পারে। একদিন বিকেলে কেউ ভুল করে সদর দরজা খোলা রেখেছিল। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন কালী। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে দৌড়ে পৌঁছলেন আহিরিটোলা ঘাটে এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে দক্ষিণেশ্বর। সেদিন রাত্রে ঠাকুরের কাছে থাকলেন।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
ঠাকুরের উপদেশানুযায়ী প্রতিদিন সকাল ও রাতে ধ্যান করতে শুরু করলেন কালীপ্রসাদ। এই সময় তাঁর যা যা দিব্য অনুভূতি হত সবই দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে ঠাকুরকে বলতেন। ফলে ঘন ঘন দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত। পড়াশোনাতেও অমনযোগ এল। বাড়ির লোকের নজরে পড়ায় তাঁরা বাধা দিতে লাগলেন। কালীপ্রসাদ নিজ সাধনায় রত থাকলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াতের সুবাদে অনেক ভক্তের সঙ্গে পরিচয় হয় কালীর। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের সেবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হলেন। দক্ষিণেশ্বরে ঝাউতলার দিকে যাওয়ার সময় কালীর কাঁধে হাত রেখে অনেক সময় চলতেন ঠাকুর। এই সময় অনেক উচ্চ তত্ত্ব সম্বন্ধেও ঠাকুর তাঁকে অবহিত করেন। একদিন কালী ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে জানালেন যে তিনি ধ্যানে ঈশ্বরের সর্বত্র প্রসারিত চক্ষুদ্বয় দর্শন করেছেন। আর একদিন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় ঠাকুরের শ্রীচরণে হাত বুলাতে বুলাতে। তিনি অনুভব করেন ঠাকুর জগজ্জননীরূপে তাঁকে স্তন্যপান করাচ্ছেন। অপর একদিন রাতে ধ্যানের সময় অনুভব করলেন, তাঁর আত্মা দেহ পরিত্যাগ করে উর্ধ্বলোকে চলেছে। বহু মনোরম দৃশ্য অবলোকন করতে করতে এক সুন্দর প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন। দেখলেন সেখানে সর্বধর্মের প্রতীক ও মূর্তবিকাশ রয়েছে। সেই প্রাসাদটির একটি বিশালাকায় কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন চারিপাশে বেদিতে বিভিন্ন ধর্মের দেবদেবী ও অবতারগণ উপবিষ্ট হয়ে আছেন। আর এঁদের মধ্যে একেবারে মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। ক্রমে দেখা গেল সমস্ত দেবদেবী ও অবতারগণ ঠাকুরের বিরাট জ্যোতির্ময় দেহে মিশে গেলেন। এইসব শুনে ঠাকুর কালীকে বলেছিলেন, “তোর বৈকুণ্ঠদর্শন হয়ে গেল; এখন হতে তুই অরূপের ঘরে উঠলি। আর রূপ দেখতে পাবি না।”
১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম থেকেই ঠাকুরের গলার ব্যাথা আরম্ভ হল। ঢোক গিলতে, খেতে, কথা বলতে কষ্ট হয়, কফ বা শ্লেষ্মায় অসম্ভব দুর্গন্ধ। চিকিৎসার সুবিধার্থে এই বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল তাঁকে। দিন সাতেক বলরাম ভবনে থেকে ৫৫ নং শ্যামপুকুর স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে তাঁকে নিয়ে আনলেন ভক্তেরা। লাটু ও কালী এই সময় সর্বদা সেবক হিসেবে তাঁর সঙ্গে থাকতেন। বস্তুতপক্ষে এই সময় থেকেই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ঠাকুরের সেবায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন কালী। শ্যামপুকুর থেকে তিনি ঠাকুরের সঙ্গে কাশীপুর গেলেন ডিসেম্বর মাসে। ঠাকুরের আদেশ অনুযায়ী সেবকদের কাজের সময় নির্দিষ্ট করে বেঁধে দিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ। কালী দিনে দুই ঘন্টা ও রাতে দুই ঘন্টা সেবা করতেন। দুপুরে ঠাকুরকে তেল মাখিয়ে গাড়ি বারান্দার ছাদের উপর রোদে স্নান করাতেন। একটি জলচৌকির উপর বসিয়ে দিতেন ঠাকুরকে এবং এই সময় ঠাকুরের শ্রীমুখনিঃসৃত তত্ত্বকথা শ্রবণ করে ধন্য হতেন।
0 Comments