জ্বলদর্চি

সুজয় চক্রবর্ত্তী (নাট্যকার, অভিনেতা, সংগঠক : কোলাঘাট)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৩

সুজয় চক্রবর্ত্তী (নাট্যকার, অভিনেতা, সংগঠক : কোলাঘাট)

ভাস্করব্রত পতি 

তাঁর কাছে জীবনের মূল উপজীব্য নাটক। এই নাটকই বেঁচে থাকার একমাত্র ভাবনা। চলার পথের পাথেয়। নাটককে আঁকড়ে জীবনের অনেক কিছু না পাওয়ার বেদনা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন। নাটককে সঙ্গী করে চলমান জীবনের হতাশাগুলো নিংড়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলে দেন। নাটককে আত্মস্থ করে ঋদ্ধ করতে চেষ্টা করেন মেদিনীপুরের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর গঠনমূলক সৃষ্টিগুলো। এভাবেই মঞ্চের নাটক যখন কারোর জীবনের রূপ রস রঙে entry নেয়, তখন সেই জীবনের মালিকের জীবনযাত্রায় খুঁজে পাওয়া যায় বেঁচে থাকার জীবন্ত রসদ। এই আলোআঁধারির ফোটনকনায় আলো হয়ে ফুটতে চাওয়া মানুষটি আজ নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন।
সুজয় চক্রবর্ত্তী। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের বাসিন্দা। রূপনারায়ণের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন ক্র্যাচ ধরে। জীবনের অসম লড়াইতে তিনি হারতে হারতেও জিতে গিয়েছেন। সুজয়ের একটি পা নেই। গণনাট্যের নাটক করতে গিয়ে ঝাড়গ্রামের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে বাস। বাদ দিতে হয় বাঁ পা'টি। না, তবুও থমকে যায়নি সুজয়ের নাটকের স্বপ্ন। মুষড়ে পড়েননি। এক পায়ে ভর দিয়েই আজ তিনি নাটকের ফেরিওয়ালা। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো নাটকের সুগন্ধ ছড়িয়ে শিশু কিশোরদের মননে চিন্তনে এবং স্মরণে প্রোথিত করতে পেরেছেন সাংস্কৃতিক অভিবাসনের বীজ। যে বীজ বেঁচেবর্তে থাকে এই মানুষটির অকৃত্রিম ভালোবাসায়। কর্তব্য এবং নিষ্ঠার অমোঘ টানে। আর দুচোখ ভরা স্বপ্ন দেখার উর্বর বাগিচায়।
১৯৮৯ তে জন্ম নিয়েছিল 'অংকুর'। আগামী ডিসেম্বরে ৩৫ এ পা দেবে। নাচের স্কুল, অঙ্কন, আবৃত্তি, থিয়েটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আজ অংকুরের মুকুট। চলার পথে ১৯৯০ থেকেই মিলেছে ড. শ্যামল বেরার সান্নিধ্য। এরপরেই অংকুরের অভিমুখ গতি বাড়াতে শুরু করে। ১৯৯৪ থেকে শুরু হয়ে যায় 'অংকুর' পত্রিকার প্রকাশনা। যা আজও চলছে।

সুজয় চক্রবর্তী তাঁর এই নাটক পাগল ভাবনায় পাশে পেয়েছেন স্ত্রী মৌসুমী চক্রবর্তীকে। এঁদের সবাই চেনেন 'নাটক দম্পতি' নামেই। স্ত্রী এবং ছেলে স্মার্তকে নিয়ে একটা নাটকের পরিবারই যেন গড়ে উঠেছে কোলাঘাট স্টেশনের পাশে। কিন্তু এঁদের নাটকের পরিবেশ পরিস্থিতি অন্যদের চেয়ে অনেকটাই অন্যরকম। গতানুগতিক ভাবনার নাটক দলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

নাটকের ভাবনা এবং তার রূপায়ণে সুজয়ের এখন একমাত্র সঙ্গী বলতে তাঁর স্ত্রী মৌসুমী। আবৃত্তি, নাচ আর কোরাস গানের ট্রেনিং মৌসুমীই দেয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতা অবলম্বনে রতন ঘোষের লেখা নাটক 'ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়' প্রযোজনাটি ছিল অন্যতম উপহার।
ক্র্যাচে ভর দিয়ে নাটকের মঞ্চ সাজানো, নাটক লেখা, নাট্যরূপ ফুটিয়ে তোলা সবকিছুতেই যেন অন্য মাত্রার উপস্থিতি। উত্তরপাড়ার থিয়েটার প্রসেনিয়ামের অম্বর চম্পটির ভূমিকাও এখানে অনেকটা উল্লেখযোগ্য। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ যদি ক্র্যাচে ভর দিয়ে মঞ্চ দাপাতে পারে, তবে তা নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে অনুপ্রেরণীয়। নাটক ছেড়ে থাকা যে কি দুঃসহ, তা এঁরা অনুভব করেন প্রতিনিয়ত। আসলে নাটক আজ এঁদের কাছে জীবনের কথাকলি, ভারতনাট্যম। সেই রসালাপের রসাস্বাদন করতে হলে এখানে না এলে সম্ভব নয়।

কোলাঘাটে বাড়ির পাশেই রেললাইনের ঝুপড়িতে বাস করে অনেক শিশু। তাঁদের জীবনের ঘুড়ি লাটাইয়ের সুতো আজ নির্দিষ্ট হাতে ধরা নেই। গোঁত্তা মেরে উড়তে থাকা সেই 'পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা'দের বাগিয়ে ধরেছেন আজ নিজের হাতে। অবৈতনিকভাবে ঐসব ছেলে মেয়েদের সমস্ত কিছুই শেখাচ্ছেন স্ত্রীকে পাশে নিয়ে। নাচ গান আবৃত্তি নাটক নিয়ে হাজির হয়ে যান সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার। তাঁদের নিয়েই ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন কোলাঘাটের বলাকা মঞ্চে। সমাজের পিছিয়ে পড়া আর পেঁচিয়ে যাওয়া শৈশবের আঙিনায় জমে থাকা ধুলো সাফসুতরো করে তিনি চেয়েছেন 'আলোর পথযাত্রী' বানাতে। আগামী দিনে এইসব ছেলে মেয়েদের অংকুর পত্রিকাতেও যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। অংকুরের 'ইচ্ছেডানা'তে'তে রয়েছে এঁদের ছবি। এঁদের নিয়ে লেখা হয়েছে নাটক। লক্ষ্য যখন স্থির, তখন সফলতা নয়, ধারাবাহিকতা বজায় রাখাটাই মূল কাজ। একদিন ফুল ফুটবেই।

এই মুহূর্তে চলছে নাটক NOT FOR SALE, সুলুক সন্ধান এবং FACEBOOK পরিনয়। আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ এই মানুষটির কাছে কাজটাই প্রচার। কাজে ফাঁকি দিয়ে সাফল্য আসেনা। এই আপ্তবাক্য মেনে চলেছেন নিজের কাজ দিয়েই। সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে হজমশক্তি, বিষফুল, ডানা ভেজা পাখির গান, সুলুক সন্ধান, নট ফর সেল ইত্যাদি। 'কৃষ্ণকথা' নাটকটি অংকুরের কাছে একটি মাইলস্টোন। এটি লিখেছেন ড. শ্যামল বেরা। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫০ টি পথনাটক এবং শ্রুতি নাটক করেছেন। একাঙ্ক নাটক করেছেন ৪০ টি। টানা ৩৫ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বুকে নাটক চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। যা কিনা বিরলতম নজির।
সুজয়ের পরিচালনায় এখানে আজও ছোটদের এবং বড়দের নাটক অভিনীত হয়। এই নাট্য দল নিয়ে প্রতিবন্ধী শিল্পীর পথচলা শহর থেকে প্রান্তর। বর্ধমান, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, তমলুক, কলকাতা, হুগলী, হাওড়া, গিধনী, হলদিয়া — সর্বত্র তিনি ছুটে গিয়েছেন নাটকের দল নিয়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। নাটক করেই সুতাহাটা, তমলুক, হাওড়া, পাঁশকুড়া, হলদিয়া ইত্যাদি এলাকা থেকে এনেছেন প্রথম পুরস্কার।

সেইসঙ্গে তাঁরা শুরু করেছেন পথনাটক। বেশ কয়েক বছর আগে রাজ্য সরকারের যুব কল্যাণ আধিকারিকের উদ্যোগে এক পথনাটক উৎসবে অংশ নিয়েছিল সুজয় - মৌসুমীর 'অঙ্কুর'। আর থামা নয়। শুধুই এগিয়ে যাওয়া। সুজয়ের কথায় নাটক প্রতিযোগিতা তুলে দিয়ে নাট্য উৎসব করলেই ভালো হয়। নাটক প্রতিযোগিতায় কিছুটা প্রতিষ্ঠিত দলকে খুশি করার প্রক্রিয়া চলে বলে তাঁর অভিমত। নাট্য উৎসব করলে দর্শক, সংগঠক এবং নাট্য দলগুলোর আত্মিক মেলবন্ধন ঘটে বেশি করে। 

নাটককে যে একটা পরিবারের সদস্য করা যায়, তা সুজয়দের না দেখলে বোঝা মুশকিল। স্রেফ নাটকের জন্যই নিবেদিত প্রাণ তাঁরা। এই অবক্ষয়িত সমাজে সুজয় মৌসুমী যেন রূপনারায়ণের দমকা হিমেল হাওয়া। সেই হাওয়াতে মানুষ চিনতে পারে সাদা কালা'র তফাৎ।



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

1 Comments

  1. সাধুবাদ জানাই এই অদম্য প্রাণশক্তির মানুষটিকে।

    ReplyDelete