জ্বলদর্চি

একমুঠো ভিয়েতনাম/ তৃতীয় পর্ব /স্বপন কুমার দাস

একমুঠো ভিয়েতনাম 
তৃতীয় পর্ব

স্বপন কুমার দাস

গাড়ি এসে থামলো হ্যানয়ের একটি বিখ্যাত প্যাগোডার মেইন গেটে। প্যাগোডা বৌদ্ধদের উপাসনালয় বা বৌদ্ধ মন্দির হলেও কোন ধর্মিয় বিধিনিষেধ নেই এখানে। সব ধর্মের মানুষ লাইন দিয়ে যাচ্ছে ভিতরে। আমরাও গেলাম।
প্রবেশ পথের ধারেই সারি সারি বিশাল আকৃতির কুর্ম অবতারের মূর্তি। ফটো নিচ্ছে সবাই। আমিও নিলাম।
মূল মন্দির গুলি অত্যন্ত সুসজ্জিত। সত্যিই দর্শনীয়। কাঠের কারুকার্য খচিত দৃষ্টিনন্দন সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত আছেন বেশ কয়েকটি মূর্তি। অবশ্য কোন পূজক নেই এখানে। প্রণাম করছে অনেকে। এখানেও চলছে ফটো নেওয়ার হিড়িক।

যাই হোক্, প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম প্যাগোডা থেকে। বৌমা বললো,”এবার আমরা যাবো সেন্ট্রাল জেলে।”
গাড়ি দাঁড়িয়েই ছিল অদূরে। পায়ে পায়ে গিয়ে সওয়ার হলাম আমরা। ড্রাইভার নিজের সীটে বসেই ছিল। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই ছাড়লো গাড়ি।
গাড়ির সীটে শরীরটা বসে থাকলেও মনটা চলে গেল ইতিহাসের পাতায়। চোখে ভেসে উঠলো কলেজ জীবনে দেখা যাত্রাপালা, ‘ বিপ্লবী ভিয়েতনাম ‘-এর সেই লোমহর্ষক নির্যাতনের দৃশ্য। মনে মনে শ্রদ্ধা জানালাম সকল দেশের, সকল কালের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের উদ্দেশ্যে। তারপর কী সব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে হ্যানয়   সেন্ট্রাল জেলের গেটে পৌঁছে গেছি, হুঁশ ছিল না আমার।
আমার নাতির ডাকে ফিরে পেলাম নিজেকে। একে একে সবাই নামলাম গাড়ি থেকে।
লাল পতাকা দিয়ে সাজানো হ্যানয় সেন্ট্রাল জেলের গেট।
গেটের পাশেই টিকিট কাউন্টার। লাইন দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করলো আমার ছেলে। তারপর একে একে ঢুকলাম জেলের ভিতর। কিন্তু একি! এ যে সেই একই ছবি?  হুবহু যেন আন্দামানের সেলুলার জেল। বন্দি কয়েদীদের মডেলগুলি যেন জীবন্ত।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



তাদের ব্যবহৃত খাবারের পাত্র এবং পোশাকগুলি দেখলে সভ্য সমাজের লজ্জা হতে বাধ্য। জেলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র নির্মম অত্যাচারের নিদর্শন। দেখতে দেখতে চোখের সামনে ভেসে উঠলো চীন, জাপান, ফরাসী ও আমেরিকার ভিয়েতনাম আগ্রাসনের নৃশংস ইতিহাস।মাঝে মাঝে চোখে জল এসে গেলেও পরক্ষণে বিদ্রোহী মনের প্রতিক্রিয়ায় শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো আমার।
পর পর কয়েকটি দরজা টপকে গিয়ে স্বচক্ষে চাক্ষুস করলাম কী ভাবে জেলের কয়েদীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করে জেলের বাইরে পালিয়ে গিয়েছিল। 
জেলের মধ্যে ক্ষিদে তেষ্টা ভুলে আমরা সবাই যেন এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে ভিয়তনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহড়া দেখছিলাম।
কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি।
ঘড়িতে তখন বাজে তিনটে। পেটের নাড়িভুঁড়ি গুলো বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে। অগত্যা চললাম খাদ্য অন্বেষণে।
কিন্তু এখানে হোটেল কোথায়?…..  একটা রেস্টুরেন্টও কাছেপিঠে নেই। সবাই হাঁটছে একটা গলি পথ ধরে। তাদের মধ্যে বিদেশী পর্যটকই বেশি। একই পথে আমরাও যাত্রী। 
কিন্তু একি! এ তো সাধারণ গলিপথ নয়, এটি একটি সিঙ্গল লাইন রেলওয়ে। দেখে অবশ্য পরিত্যক্ত বলেই মনে হয়। ভিনদেশীরা মস্তি করে ফটো তুলছে লাইনে দাঁড়িয়েই । রেল লাইনের গা ঘেঁষে দু’দিকে সারি সারি খাবারের দোকান। ভিয়েতনামি স্ট্রিট ফুডের বিপুল আয়োজন। শুধু স্ট্রিট ফুড নয়, আছে সব রকমের ড্রিঙ্কস আর ভিয়েতনামের স্পেশাল কফিও। বাড়িগুলি বেশির ভাগই দ্বিতল। উপরে এবং নিচে, দুইখানেই  টুল কিংবা হাল্কা চেয়ার টেবিলে বসে সুন্দর খাওয়ার ব্যবস্থা আছ। পর্যটকেরা বেশ মস্তি করে খাচ্ছে এখানে। নিচে রাস্তার ধারে উঠোনে টুল পেতেও চলছে সুন্দর খাওয়া দাওয়া। ভেতরে আছে এক চিলতে সাজানো কিচেন। খদ্দেরদের অর্ডার মতো খাবার বানিয়ে দিতে ওরা এক পায়ে খাড়া। এদের আমন্ত্রণ এবং আপ্যায়ন সত্যি মনে রাখার মতো।

টুলে বসে, একটি করে ভিয়েতনামি কচি ডাব দিয়ে খাওয়া শুরু করার সাথে সাথেই হঠাৎ হৈ হৈ চিৎকার। ভয়ে ডাব হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে যা দেখলাম, তা দেখে চক্ষু স্থির।
সব দোকানদারেরা হাত নেড়ে ভিয়েতনামি ভাষায় সবাইকে সতর্ক করছে, ট্রেন আসছে। মুহূর্তেই রেল লাইন এক্কেবারে শুনসান। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই হুস্ হুস্ করতে করতে একটা ডিজেল ইঞ্জিন এক্সপ্রেস ট্রেন আমাদের সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। তার পর,“ যথা পূর্বং তথা পরম্“।
আমি স্বস্থানে বসে ডাবটি শেষ করার আগেই আমার ছেলের অর্ডার করা খাবার, টেবিলে এসে হাজির হলো।গোগ্রাসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে দোকানের টুলে বসেই একটি তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। বিকেল প্রায় ৫টায় আমরা গাত্রোত্থান করলাম খাবারের দোকান থেকে। তারপর গাড়ি নিয়ে সটান হোটেল শেরেটনে।
পর পর কয়েকটা দিন বিদেশী খাবার খাওয়ার পর স্বদেশী খাবার খেতে খুব ইচ্ছে করছিল আমাদের। অগত্যা অনলাইন ইণ্ডিয়ান ফুডে ডিনার সমাধা হলো হোটেলেই। তারপর সোজা চলে গেলাম ঘুমের দেশে।
পরের দিন সকাল সকাল হোটেলে ব্রেকফাস্ট পর্ব শেষ করে, হাল্কা লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রসুন্দরী হ্যা লং বে -এর উদ্দেশ্যে। সকাল ঠিক ৮ টায় আমাদের গাড়ি ছাড়লো হোটেল থেকে। ড্রাইভার বললো, প্রায় ৪ ঘণ্টার পথ। মাঝে একটা ৩০ মিনিটের ব্রেক আছে। 
প্রশস্ত রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি চলেছে ঝড়ের গতিতে। রাস্তার দু’ ধারে সেই চেনা ছবি। মাঠ, ঘাট, নদী,নালা, পুকুর, ডোবা, সবই আছে। দেখতে দেখতে প্রায় দু’ ঘণ্টা পরে, রাস্তার ডান দিকে গাড়ি গিয়ে থামলো একটি অজানা ঠিকানায়। আরও অনেক গাড়ি ইতিমধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে এখানে। 
কিন্তু এটা কোথায়? কী আছে এখানে? ………
যাই হোক্ সবাই নামছে, আমরাও নামলাম একে একে। 
পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়। সামনেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝাঁ চকচকে বিশাল টয়লেট। সকলের জন্য উন্মুক্ত। বাম দিকে একটি সাজানো পার্ল-ফার্ম। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নানা রঙের উচ্চ মানের মুক্তা চাষ হচ্ছে এখানে। 

বানানো হচ্ছে মুক্তোর গহনাও। আছে সুসজ্জিত দোকান। পর্যটকেরা সাধ্যমতো পছন্দের গহনা কিনছে এখানে। আমরাও টুকটাক কেনাকাটা থেকে বাদ গেলাম না। 
কখন যে আধঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ ড্রাইভারের ডাকে চৈতন্য হলো আমাদের। তড়িঘড়ি গাড়িতে গিয়ে উঠলাম আমরা। ড্রাইভারও স্টিয়ারিং ধরলো সঙ্গে সঙ্গেই ঝড়ের গতিতে ছুটলো গাড়ি হ্যা লং বে -এর উদ্দেশ্যে।
ঠিক দুপুর ১২ টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সমুদ্র সৈকতে। তারপর লাগেজ নিয়ে হাজির হলাম নির্দিষ্ট ক্রুজ কোম্পানির অফিস কাম রিসেপশন কাউন্টারে। আমি পায়ে পায়ে সৈকতে গিয়ে তড়িঘড়ি একটা ফটো নিলাম হাস্যময়ী, লাস্যময়ী, রূপসী হ্যা লং সুন্দরীর। 
তারপর ফিরে এলাম স্বস্থানে। ক্রুজ কোম্পানির লোকেরা বুকিং লিস্ট ধরে সকলের নামগুলো মিলিয়ে নিচ্ছে এখানে। আমাদের নামগুলোও মিলিয়ে নিল ওরা। তারপর  চেয়ারে হেলান দিয়ে খানিক বিশ্রাম। 
কিছুক্ষণ পরেই ক্রুজ কোম্পানির লোকেরা জাহাজ ঘাটে লাইন করে দাঁড় করালো আমাদের। ততক্ষণে ঘাটে এসে ভিড়েছে ক্রুজ নয়, কয়েকটি স্পিড বোট। বোধ হয়, কম গভীরতার কারণে ঘাটে ভিড়বেনা আমাদের মস্ত ক্রুজ। স্পিড বোটে চড়ে গভীর সমুদ্রে সওয়ার হতে হবে আমাদের।
হলোও তাই। উপসাগরের নীল বুক চিরে আমাদের স্পিড বোট ছুটলো অ্যাডেলা অভিসারে। হ্যাঁ, অ্যাডেলা হলো আমাদের বিলাসবহুল সমুদ্র যান। সমুদ্রপৃষ্ঠে আমাদের দিন-রাত্রির নিঃশ্চিন্ত আশ্রয়।                            ক্রমশ…….

Post a Comment

1 Comments